অধিকাংশ ঐতিহাসিক রামমোহনের সঙ্গে তুলনায় ডিরোজিও ও তাঁর ইয়ং বেঙ্গলকে ‘বিপ্লবী’ আখ্যা দিলেও, রামমোহনকে তাঁরা ‘আধা বিপ্লবী’ বা আদৌ বিপ্লবী নন বলে মনে করেছেন। তাঁর সংস্কার কর্মগুলিকে ‘হাফ মেজার’ বা আধা খেঁচড়া বলে নিন্দা করেছেন। বিপ্লব এবং স্বাধীনতা বিষয়ে রামমোহন চরিত্রের সম্যক ধারণার অভাব থেকেই এই ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ বিশ্লেষণে উপনীত হয়েছেন ওই অর্বাচীন  ঐতিহাসিকগণ।

 রামমোহন সম্বন্ধে তাঁর শিষ্য ও ঘনিষ্ঠ সহচর উইলিয়াম অ্যাডাম বলেছিলেন, “He would be free or not be at all—freedom was perhaps the strongest passion of the soul” অর্থাৎ “রামমোহন হয় স্বাধীন থাকবেন, নয় তাঁর অস্তিত্বই থাকবে না, এই ছিল রামমোহনের চরিত্র বৈশিষ্ট্য। মনে হয় তাঁর অন্তরে সকলের চেয়ে শক্তিশালী প্রবৃত্তি বা আবেগ ছিল স্বাধীনতা।” এই মূল্যায়নের অভ্রান্ততা প্রমাণিত হয়েছে রামমোহনের আয়ুষ্কালব্যাপী পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ঘটনাবলীতে তাঁর জীবন, মনন, সত্তা প্রভাবিত ও আন্দোলিত হবার নানা ঘটনায় ও সাক্ষ্যে।

  রামমোহনের জন্ম ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে, প্রয়াণ ১৮৩৩-এ। তাঁর সমগ্র জীবনকাল পৃথিবীর ইতিহাসে একটি যুগসন্ধি কাল। সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশতন্ত্রের আবসানের কাল, জাতীয়তা ও প্রজাতন্ত্রের উন্মেষকাল। তাঁর বাল্যদশাতেই সংগঠিত হয়েছে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, যার মেয়াদকাল ১৭৭২ থেকে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ। ফরাসি বিপ্লবের প্রথম পর্বও (১৭৮৯-৯৯) সংঘটিত হল তাঁর যৌবন দশায়। যে বিপ্লব তাঁর চেতনার তন্ত্রীতে এক বিপুল অনুরণন সৃষ্টি করেছিল। এই সময়েই তিনি ধর্ম বিষয়ে মতভেদের কারণে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে সুদূর তিব্বতে পাড়ি দিচ্ছেন। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বাণী তখন তাঁর চেতনা জুড়ে বিশাল ছায়া ফেলেছে। তাই ধর্মীয় অনুশাসনে তিনি বাঁধা পড়বেন কেন? পরবর্তীকালে এই ধারার বহমানতাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উদারনৈতিক ধর্মমত ব্রাহ্মধর্মের পত্তনে।

  জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্মবস্তুকে আত্মস্থ করার লক্ষ্যে রামমোহন নিষ্ঠার সঙ্গে ইংরাজি শিখলেন। বহুভাষায় পন্ডিত রামমোহন বুঝেছিলেন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় এক নতুন ভারতবর্ষকে গড়ে তুলতে গেলে ইংরাজি ভাষা শেখার গুরুত্ব। তৎকালীন ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা জেরেমি বেন্থাম রামমোহনের ইংরাজি ভাষায় তুখোড় পান্ডিত্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ইংল্যান্ড সহ ফ্রান্স, জার্মানি ও দক্ষিণ আমেরিকার বহু দেশের আইনসভার  আইন ও নীতি প্রণয়নে সবচাইতে বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন বেন্থাম। সেই বেন্থাম রামমোহনকে অসীম শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য করার জন্য প্রয়াস নিয়েছিলেন। যদিও রামমোহনের আকস্মিক মৃত্যুতে সেই প্রয়াস ফলপ্রসূ হয় নি।

  ইংরাজি ভাষার দৌলতে রামমোহন আমেরিকার স্বেচ্ছাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীদের গড়ে তোলা স্বাধীনতা সংগ্রামের হাল হকিকৎ সম্বন্ধে অবগত হতেন। ওই সময়েই মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে বিশাল স্প্যানিশ উপনিবেশ সাম্রাজ্যে ভাঙন ধরার শুরু। ১৮২১ সাল থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে একের পর এক স্বাধীনতা ঘোষণা করল স্প্যানিশ উপনিবেশের দেশগুলি। প্যারাগুয়ে ও ভেনেজুয়েলায় স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুন জ্বলে উঠল  ১৮১১ সালেই। ১৮২১ সালে জন্ম হল স্বাধীন পানামার। ১৮২২ সালের জানুয়ারিতে জেনারেল বলিভারের নেতৃত্বে গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, এল সালভাদর, কোস্টারিকা ও নিকারাগুয়া এই পাঁচটি উপনিবেশ নিজেদের স্বাধীন রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করল। এই বলিভারের নামানুসারেই পরবর্তী কালে বলিভারিয়ান সংস্থার জন্ম হয়েছে। ১৮২৫ সালে বলিভিয়া ও ১৮২৮ সালে উরুগুয়ে  স্বাধীন হল। ১৮৩০ সালে স্বাধীন হল ইকুয়েদর। আর ওই বছরই রামমোহন সমুদ্রযাত্রার শাস্ত্রীয় বিধান লঙ্ঘন করে ‘কালাপানি’ পার হয়ে বিলেত যাত্রা করলেন।

   বিশ্বজুড়ে জাতীয় জাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে রামমোহনের জন্ম ও জীবন পরিক্রমা। ফ্রান্স, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আমেরিকা, স্পেনের কাদিজ, ইতালির নেপল্স, আয়ারল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশের সংগ্রামের বীররস পূর্ণ গৌরবগাথায় তাঁর মানসিক পুষ্টি ও বৃদ্ধি। রামমোহন হলেন স্বাধীনতা প্রাণ, বিপ্লবের বন্ধু এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বোধসম্পন্ন নবযুগের পথদ্রষ্টা ও স্রষ্টা।

  ১৮২২ সালে গুয়েতেমালার মুক্তিসংগ্রাম চলাকালীন সে দেশের বিপ্লবী দেল ভালে সম্পর্কে  রামমোহন অবগত হয়েছিলেন জেরেমি বেন্থামের লেখা পত্র থেকে। ওই পত্র থেকেই জানা যায় দেল ভালেকেও  রামমোহন সম্পর্কে বেন্থাম অবগত করেছিলেন। কারণ বেন্থামের মতে দুজনেই হলেন সমগোত্রীয় মানুষ। তাই দুই মুক্তপ্রাণা মহান ব্যক্তির মধ্যে পত্র যোগাযোগ গড়ে তোলার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন বেন্থাম সাহেব।

  স্পেনের কাদিজ প্রদেশের রাজধানী কাদিজ শহর ১৮১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাসি সৈন্য দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল। ১৮১২ সালের ১৯শে মার্চ কাদিজের বিপ্লবীরা অবরোধ মুক্ত করেন ও একনায়ক রাজার কাছ থেকে একটি সংবিধান আদায় করেন। ওই বিপ্লবীরা স্প্যানিশ ভাষায় লেখা ওই সংবিধানের একটি খণ্ড উপহার পাঠিয়েছিলেন রামমোহনকে। ওই বিপ্লবীদের সঙ্গে রামমোহনের এই যোগসূত্রের মাধ্যম ছিলেন সম্ভবত  দেল ভালে। কারণ স্পেনের বিপ্লবীদের সঙ্গে স্পেনীয় উপনিবেশ গুয়েতেমালার বিপ্লবীদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল বলে মনে হয়। আর বেন্থাম মারফত দেল ভালের সঙ্গে রামমোহনের যোগাযোগ ও সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়।

  অষ্ট্রিয়ার দাসত্ব-শৃংখলে শৃংখলিত ইতালির স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি ‘কার্বনারি’র প্রতি অপার সহানুভূতি ছিল রামমোহনের। যখন অষ্ট্রিয়া, রাশিয়া, প্রুশিয়া প্রভৃতি দেশের সম্মিলিত মদতপুষ্ট অষ্ট্রিয় সেনাবাহিনী ১৮২১ সালে নেপল্সে নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমনের কাজটি চালায় এবং বিপ্লবী দুই নেতা মোরেলি ও সিলভাটিকে ফাঁসিতে হত্যা করে তখন রামমোহন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “আমি তাদের সাধনাকে আমার সাধনা, তাদের শত্রুকে আমার শত্রুবলে মনে করি। তবে স্বাধীনতার শত্রু ও স্বেচ্ছাতন্ত্রের মিত্ররা কোনওদিন জয়ী হয় নি, শেষ পর্যন্ত  কোনওদিন জয়ী হবেও না।”

   রামমোহনের ওপর ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবের প্রসঙ্গ রচনার প্রথম দিকে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি তাঁর নিজ ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত অবৈতনিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম চিন্তানায়ক ভলতেয়ারের  বইয়ের ইংরাজি অনুবাদ পাঠ্য করেছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের প্রতি তাঁর আবেগ ও অনুভূতি এতটাই প্রবল ছিল যে বিলেত যাত্রার সময় মাঝ সমুদ্রে ফরাসি জাহাজ দেখতে পেয়ে জাহাজ থামিয়ে সেই জাহাজে গিয়ে ফ্রান্সের বিপ্লবী তেরঙ্গা পতাকাকে  অভিবাদন জানান। এই সময়েই আবেগের আতিশয্যে জাহাজের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হন এবং বাকি জীবন খোঁড়া হয়ে থাকেন।

  নিপীড়িত, নিষ্পেষিত বিপ্লবী আয়ারল্যাণ্ডের প্রতি রামমোহনের ছিল অসীম দরদ ও ভালোবাসা। আয়ারল্যাণ্ডের সঙ্গে তিনি ভারতের তুলনা করতেন। আয়ারল্যাণ্ডের প্রতি ইংল্যান্ডের অবিচার ও আয়ারল্যাণ্ডের অসন্তোষের কথা তিনি ফার্সি ভাষায় ছাপা তাঁর বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘মিরাৎ-উল-আখবার’ মারফত সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফলে এদেশের ইংরেজ শাসকদের রোষের শিকার হয়ে সেই সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল।

 আমেরিকার ক্রীতদাসত্ব বিরোধী সংগ্রামের যোদ্ধাদের ওপরেও ছিল রামমোহনের প্রভাব। একথা জানা যায় যে, মার্কিন কংগ্রেসের অধিবেশনে ক্রীতদাস প্রথা বিরোধী বক্তব্য রাখার সময় জনৈক প্রতিনিধি রামমোহনের নাম উল্লেখ করে বক্তৃতা শেষ করেছিলেন।

  সুতরাং একথা বলা যায় স্বাধীনতা ও বিপ্লবের বন্ধু এবং স্বেচ্ছাতন্ত্র ও দাসত্বের শত্রু হিসাবে রামমোহন রায়ের নাম তাঁর জীবদ্দশাতেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইতালির নেপল্সে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, “ইউরোপের দেশ এবং এশিয়ার দেশগুলিও, বিশেষ করে যেগুলি ইউরোপের উপনিবেশ, সেগুলি তাদের স্বাধীনতা ফিরে পাবে, এই জিনিসটি আমি আর দেখে যেতে পারব না।” ‘ইউরোপের উপনিবেশ ‘ কথাটির মধ্যে এটা পরিষ্কার যে, রামমোহন তাঁর জীবদ্দশাতেই ভারতের স্বাধীনতা অর্জন প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন। তাই ধর্ম থেকে শুরু করে সমাজ, শিক্ষা সব বিষয়েই তাঁর সংস্কার কর্ম ভারতের স্বাধীনতা চিন্তার রূপ পেয়েছে একথা বলা যায়। ভারতের স্বাধীনতার জন্য আকুতি তাঁকে করে তুলেছিল বিশ্ববিপ্লবের  বন্ধু।