বামপন্থী অথবা সমাজবাদী স্বরকে  ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনঠাসা করতে চাওয়ার ইতিহাসটি অলোচনা করলেই বোঝা যাবে কেনো স্বাধীনতার পরপরই সাম্প্রদায়িকতার মতো একটি বিষয়  রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির আনাচ কানাচ দখল করেছিলো।

১৯২৫ এ হিন্দুমহাসভার জন্ম হলেও, কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও কিছু জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব প্রচ্ছন্নভাবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মনোভাব লালন করতেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, গোবিন্দ বল্লভ পন্থ প্রমূখ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরেই ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সোমনাথ মন্দির সংস্কারের।  এই সিদ্ধান্তের হোতা ছিলেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল। এই সিদ্ধান্তকে হাতিয়ার করেই হিন্দু মহাসভা পথে নামে অযোধ্যায় মন্দির সংস্কারের।  তারা কিছু সাধু, বৈরাগীদের জমায়েত করে ১৯৪৯, অক্টোবরে  রামায়ণ মহাসভা তৈরি করে এবং  নয়দিন যাবত তুলসী দাসী রামায়ণের পাঠ করা হয়। এই পাঠের আয়োজন সম্পর্কে মহন্ত দিগবিজয় নাথ বলেন, কোনো এক দৈব ঘটনার তারা স্বাক্ষী  হতে চলেছেন এবং ঠিক তিন সপ্তাহের মধ্যেই সেই “মিরাকেল” ঘটলো। কয়েকজন বৈরাগী নাগা সন্ন্যাসী অভিরাম দাসের নেতৃত্বে ডিসেম্বরের শীতের রাতে মসজিদের তালা ভেঙে রাম সীতার মূর্তি রেখে আসেন। অথচ ঐ চত্ত্বরের বাইরে পুলিশ প্রশাসন মোতায়েন ছিলো।

এই ঘটনায় উত্তেজনা ছড়ালে অযোধ্যার স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে প্রথম যিনি রিপোর্ট  করেন, তিনি হলেন, একজন কনস্টেবল মেটা প্রসাদ, ১৯৪৯, ২৩ ডিসেম্বর। যা আশ্চর্যের,  তা হলো, ফৈজাবাদের জেলা প্রসাশক কারানকর নায়ার পূর্বেই এই ঘটনার কথা জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেন নি।  তাঁর স্ত্রী শকুন্তলা নায়ার ছিলেন বাবরি মসজিদ চত্ত্বরে বৈরাগীদের সেই ভজন পূজনে। প্রধন্মন্ত্রী নেহেরু এই ঘটনা জানতে পারেন পরেরদিন। এবং তখনি নির্দেশ দেন, মূর্তি সরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু জেলাশাসক নায়ার এই নির্দেশ মানেননি। বলেছিলেন,  এমন কোনো নির্দেশের কথা তাঁর জানা ছিলো না।

কে এই নায়ার?

নায়ার ছিলেন আর এস এসের ঘনিষ্ঠ সদস্য। সেই সময়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা গোবিন্দ বল্লভ পন্থ। তিনি কিভাবে এই অযোধ্যায়  বাবরি মসজিদকে মন্দিরে পরিণত করায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই ইতিহাস কম আলোচিত।

 কংগ্রেসের মধ্যে ১৯৩৪ সাল থেকেই একটি সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই ধারাটিকে নেতৃত্ব দিতেন আচার্য নরেন্দ্রদেব। তিনি স্বধীনতা পূর্ব সময় থেকেই ফৈজাবাদ- অযোধ্যা সংসদীয় আসনটির প্রতিনিধিত্ব করতেন। ১৯৪৮, এ তাঁরা ১৩ জন বিধানসভার সদস্য কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ফলত, ঐ আসনে পুনরায় নির্বাচন ঘোষিত হলে তিনি নিজে সমাজতান্ত্রিক প্রতিনিধি  হিসেবে নির্বাচণে কংগ্রেসের আসনের বিপক্ষে দাঁড়ান। তাঁকে পরাজিত করতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতা গোবিন্দ বল্লভ পন্থ সরাসরি হিন্দু মহাসভার সাহায্য চেয়ে বসেন।বাবা রাঘব দাস, যিনি একসময়ে আচার্য দেবের অনুরাগী ছিলেন, তাঁকেই নরেন্দ্রদেবের বিপরীতে কংগ্রেস দাঁড় করিয়ে দেয়। বাবা রাঘব দাস ছিলেন  দেওরিয়া জেলার সাধু। এই নির্বাচনে ধর্ম, রাম, অযোধ্যা,  মন্দির ভীষণ ভাবেই প্রাসংগিক হয়ে ওঠে। বাবা রাঘব দাস হিন্দু ভোটারদের মধ্যে  তুলশী পাতা বিতরণ করে তাঁকে জেতানোর আবেদন রাখেন। এই বাবা রাঘব দাসকে সেদিন জেতানোর জন্য পন্থ ঘৃন্য সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেন। তিনি জেতেন।

অযোধ্যায় মসজিদ মন্দির নিয়ে সংকট শুরু হয়েছিলো ১৮৮৫ থেকেই।  স্বাধীনতার পর সেই সংকট মেটানোর চেষ্টা না করেই, শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক মুখ নরেন্দ্র দেবকে আটকাতেই দক্ষিনপন্থী জাতীয়তাবাদী অংশ আর এস এসের মতো অতি রক্ষণশীল গোষ্টীর সাথে হাত মেলান। পন্থ পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পদে আর এস এসের সমর্থকদের বসিয়ে রাখেন। তাদের চোখের সামনেই মসজিদের ভেতরে রামের মূর্তি বসিয়ে দেওয়া হয়।

সেদিন যদি, নরেন্দ্রদেব নির্বাচনে পরাজিত না হতেন, তাহলে হয়তো ঘটনাক্রম অন্যখাতে বইতো। ১৯৪৯ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত  মুসলিম ও হিন্দু উভয়েই একে অপরের থেকে  মাত্র পনেরো ফিটের দুরত্বে প্রার্থনা করতেন। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেছিলো ১৯৪৯ এর পর। সেই পরিবর্তনের ফলাফল ছিলো ১৯৯২ এর ৬ ডিসেম্বর, মসজিদ ভাঙা   হলো। পরবর্তীতে সুপ্রীম কোর্ট পুরাণ নির্ভর রায় দিয়ে দিলেন। একটি মসজিদ মন্দিরে পরিণত হয়ে গেলো। যার রাষ্ট্রীয় উদ্ধোধন হতে চলেছে ২০২৪ এর জানুয়ারিতে। 

এ লজ্জা ভারতীয় গনতন্ত্রের।  এর থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রীদের কোনঠাসা করার যে কোনো চেষ্টাই গনতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে শুভ হয় না। ইতিহাস বলে অতি জাতীয়তাবাদীরা কখোনোই ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। এরা দক্ষিণপন্থী শক্তির দানে বামে থেকে তাকেই সাহস যোগায়। ভারতের ইতিহাস দেখায় সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার প্রসার রুখে দিতে চাওয়াগুলো কি ধরণের বিপর্যয় এনেছিলো।