সেই সব দিনগুলোর কথা অনেকেরই মনে থাকবে না, অনেকেই জানবেনা। জানবে না তারা, যারা কোনদিন আক্রান্ত হয়নি, যারা সেদিন আক্রান্তের পাশে থাকেনি, যারা কোনদিন প্রয়োজন মনে করেনি দরজা টুকু খুলে বাইরে এসে দাঁড়াবার, বা জানলাটা খুলে মুখটা মুখটা বার করে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর খোঁজ নেবার, জানবেনা তারা, যারা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরিনের তীব্র চিৎকার কে উপেক্ষা করে নিচিন্তে ঘুমোতে গেছিল, যারা পাশের বাড়ির স্বজন হারানোর তীব্র কান্নায়, কানে হাত চাপা দিয়ে বসেছিল, অন্তত যাদের সামর্থ্য ছিল পাশে দাঁড়ানোর, শক্তি দিয়ে হোক বা অর্থ দিয়ে। যারা ১০ তলা উচু বিল্ডিং এ ড্রয়িং রুমের বসে খবরের কাগজের পাতায় পড়েছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের মিছিলের কথা মাইলের পর মাইল এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিল নিরুপায় হয়ে, তাদেরই ভোটে জেতা রাষ্ট্র ব্যবস্থা যাদের দিকে একবার ফিরেও তাকানোর প্রয়োজন মনে করেনি, যারা টিভির পর্দায় দেখেছিল রেল লাইনের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েক টুকরো রুটি, কয়েকটা ছেঁড়া টাকার নোট আর সেইসঙ্গে কতগুলো ছিন্ন ভিন্ন দেহ।  তারা জানেনা সেই ভয়ঙ্কর আতিমারীর  দিনে ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত বিষন্ন খুব ছোট আর রাষ্ট্রের কাছে “সাধারণ খুব সাধারণ ” গল্প গুলোর কথা, কত স্বপ্ন ভাঙার গল্প, কত স্বজন হারানো ব্যথা,  আর অগুনতি ভুখা পেটের দীর্ঘ পথ চলার দিনগুলোর সেই হার হিম করা কাহিনী গুলো। সেদিন ১৬ তলা উচু বিল্ডিং এর দেয়াল জোড়া টিভি আর পডকাস্ট এর নিশুতি রাতের কল্প কাহিনীর মাঝে হারিয়ে গেছিল সহ নাগরিকের আর্ত চিৎকার, স্বজন হারানোর কান্না। রাজনৈতিক নেতাদের টিভি জোড়া ভাষণ, থালা- ঘটি – ঘন্টা বাজানোর আওয়াজ আর ‘বিগ বি’ এর বিগ মোমবাতির আলোয় কর্পোরেটের ব্যালান্স শিট থেকে হাইরাইজের ব্যালকনি গুলো আলোকিত হলেও দীর্ঘ ছায়া ফেলেছিল শহরতলীর নগর কলোনি থেকে, খালপাড়ের বস্তি হয়ে গ্রামের মেঠোপথে।

     এর আর একটা দিকও ছিল। যারা জেনেছিল, যারা জেগেছিল। যারা জেগেছিল শ্মশানে চুল্লির পাশে, যারা জেগে ছিল পুলিশের পোশাকে রাস্তায় লাঠি হাতে, যারা দীর্ঘ একাধিক রাত জাগতে জাগতে বারবার ঢুলে পড়ছিল অবসন্ন দেহে টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে পিপি কিট পড়ে হসপিটালে রোগীর বেডের পাশে, যারা এম্বুলেন্স স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে ঠোটে জ্বলন্ত সিগারেটে রাত জেগে ছিল, যারা ক্যামেরা আর বুম নিয়ে বারবার ছুটে গেছে শহরের এ প্রান্ত থেকেও প্রান্তে।  জেগেছিল তারাও, যারা নিজেরা জাগতে না পারলেও যারা জাগছে তাদের পাশে সমস্ত রকম আর্থিক মানসিক সাহায্য নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, জেগেছিল রহিম চাচা, রহমত ভাই, জেগেছিল ব্যানার্জি দা, মন্ডল কাকু – মাধুকরী করে, অসহায় – উপার্জন রোহিত মানুষগুলোর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল খাদ্য, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে।

      অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রেখে ঠায় রাত জেগে ছিল দেশ বিদেশের তাবড় বিজ্ঞানীরা, বহুকাঙ্খিত জীবন দায়ী ভ্যাকসিনের সন্ধানে,

      আর রাত জেগে ছিল একদল হিংস্র লোভী কর্পোরেট – রাজনৈতিক হায়না, যারা শেণ্য দৃষ্টি আর লালা ঝরা মুখে অপেক্ষা করছিল সেই মুহূর্তের জন্য যখন হাতে পাওয়া যাবে সেই প্রাণ দায়ী প্রতিষেধক, যাকে বাজারজাত করে চলবে মুনাফা লাভের প্রতিযোগিতা আর সুবিধাবাদী রাজনৈতিক প্রচারের ঢক্য নিনাদ।

       জেগেছিল আরো একদল মানুষ, ভোটের বাক্সে যারা শূন্য হয়েও সমস্ত জড়তা এবং ক্লান্তিকে পেছনে ফেলে পিঠে একাধিক সিলিন্ডার নিয়ে নিজেদের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দৌড়ে গেছিল এক বাড়ির দরজা থেকে আরেক বাড়ির উঠানে, রাতের পর দিন – দিনের পর রাত অক্লান্তভাবে রাজনৈতিক দল মত নির্বিশেষে, জাতি ধর্মনির্বিশেষে যারা দাঁড়িয়ে ছিল মানুষের পাশে জীবন বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে।  যারা মহামারী – মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল সহ নাগরিকদের জন্য, যারা সগর্বে বলেছিল মানুষের জীবনের দামের ঊর্ধে রাজনীতি নয়।

     যারা পিপি কিট পড়ে অবসন্ন শরীরে চলতে চলতেও রুখে দাঁড়িয়ে, ছিল প্রতিবাদ করেছিল মুনাফা লোভী মালিক, অপদার্থ প্রশাসন আর কালোবাজারির বিরুদ্ধে। যাদের হাতে ছিল সকল পরিবারকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেবার প্ল্যাকার্ড আর পিঠে ছিল অক্সিজেনের সিলিন্ডার। ওরা রেড ভলেন্টিয়ার্স, ভোট যায়, সময় পাল্টে যায়, যুগ চলে যায়, ওরা থাকে, ওরা বেঁচে থাকে মানুষের মনে, ওদের কাজে, ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়ে।

         ওরা বাঁচে, ওরা বাঁচায়, বেঁচে থাকে ওদের আদর্শ।  ওরা বামপন্থী, ওরা রেড ভলেন্টিয়ার্স। গতকাল ওদের দিন, বাইশে এপ্রিল, রেড ভলেন্টিয়ার্স ডে, আজ লেনিনের জন্মদিন।