টালিগঞ্জ এই শহরের এক জনবহুল জনপদ। বড় বড় অট্টালিকা আজ মুখ ঢেকেছে টালিগঞ্জের আকাশের। ঝা চকচকে শপিং মল থেকে সিনেমা হল সবই রয়েছে এখানে।কিন্ত আজ থেকে ৩০\৪০বছর আগে কেমন ছিল এই অঞ্চল। কীভাবে হোগলার বেড়া দেওয়া টালিগঞ্জের কলোনি গুলিতে আজ আর কাঁচা বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায়না ।এই উত্তরণের রহস্য জানতে গেলে জানা প্রয়োজন টালিগঞ্জের অতীত ইতিহাস। যে ইতিহাস হচ্ছে ছিন্নমূল সব হারানো মানুষের লড়াই জেদ আর সংগ্রামের ইতিহাস।


১৯৪৭র ১৫ই আগষ্ট মধ্য রাতে যখন সারা ভারত স্বাধীনতার আনন্দে মেতে উঠেছে সেই সময় বাঙালির জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ংকর এক যন্ত্রণা। যার নাম দেশভাগ।কলমের এক খোচায় বাংলাকে ভাগ করে দেওয়া হলো।নিজের জমি, বাসস্থান,সম্পাদ,সম্মান সব হারিয়ে এই ছিন্নমূল মানুষগুলি এসে হাজির হলেন এপার বাংলায়।তাদের প্রথম আশ্রয় হলো শিয়ালদহ রেলস্টেশনের মতো স্টেশনগুলি।
খাদ্য নেই,আশ্রয় নেই,নিরাপত্তা নেই অন্যদিকে কলেরার মতো রোগ। কদিন আগে পর্যন্ত যে পরিবারের বড় কর্তা ওপার বাংলায় তার আত্মীয়দের আশ্রয় দিতেন বিপদে আপদে সাহায্য করতেন আজ সেই বড় কর্তাই পরিবারের মুখে একটু খাওয়ার তুলে দেওয়ার জন্য শহর কলকাতার অচেনা রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে।


আস্তে আস্তে এই মানুষগুলির কেউ পৌঁছালো রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে কেউ টালিগঞ্জে। শুরু হলো তাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায় প্রথমে নিজেদের মাথা গোজার জন্য কেউ আশ্রয় নিল মুসলিম পরিবারের পরিত্যক্ত বাড়িগুলিতে কেউ বা তৈরি করলেন হোগলার বেড়া দিয়ে ঘর।কিন্ত বিধি বাম যে জমিতে তারা এসব করছে সে জমির মালিক তো তারা নন এসে হাজির জমিদারের লেঠেল বাহিনী সঙ্গে পুলিশ। ভেঙে সাফ করে দিতে হবে জবর দখল কলোনি গুলি।
আর এই সময়েই তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন কিছু মানুষ তাদের কারোর নাম নিরঞ্জন সেন কারোর নাম প্রশান্ত শূর কারোর নাম সমর মুখার্জী এরা এই সমস্ত জবরদখল কলোনি গুলির আইনি স্বীকৃতির জন্য কলোনির মানুষদের সংঘবদ্ধ করলেন। দেশভাগের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে আসা এই মানুষগুলির যে পুর্নবাসন পাওয়ার ন্যায্য অধিকার আছে সেই দাবিতে প্রধানত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেই গড়ে উঠল আন্দোলন। তৈরি হলো ইউসিআর সি(কেন্দ্রীয় সম্মিলিত বাস্তুহারা পরিষদ)।
কিন্ত তৎকালীন কংগ্রেস সরকার পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের পুর্নবাসনের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা নিয়েছিল বাংলার ক্ষেত্রে তার ঠিক উল্টো ভূমিকা নেয়।বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রতি নেহেরু সরকার বৈমাতৃ সুলভ আচরণ শুরু করে।


একদিকে কেন্দ্রের বঞ্চনা অন্যদিকে রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের অসহযোগীতার কারনে এই উদ্বাস্তুদের জীবন যন্ত্রনা বাড়তে থাকে।
কিন্ত এই মানুষগুলি তো হারতে শেখেনি ভাঙ্গা বুকের পাঁজর নিয়েই তারা শুরু করে বসত গড়ার সংগ্রাম।আর সেই সংগ্রামে তাদের সাথী হয় লাল ঝান্ডা আর কমরেড নিরঞ্জন সেন,কারণ প্রশান্ত শূর,কমরেড সমর মুখার্জীর মতো কমিউনিস্ট নেতারা। সরকারের অসহযোগীতা এই মানুষগুলির প্রতি এমন ছিল যে পানীয় জলের জন্য টিউবয়েল থেকে নিকাশির নালা কিছুই জবরদখল কলোনি গুলিতে করতে দিত না সরকার। এমন ও নজির এই টালিগঞ্জের কোনও কোনও কলোনিতে আছে যেখানে টিউবয়েল বসাতে গিয়ে সরকারী লেঠেল বাহিনীর হাতে মাথা ফেটেছে উদ্বাস্তু যুবকদের। নোংরা জল যাওয়ার জন্য মানুষকে সংঘবদ্ধ করে কোদাল হাতে ড্রেন কেটেছেন প্রশান্ত শূরের মতো নেতারা।


১৯৪৭থেকে ১৯৫২ বামেদের আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রের সরকার বাধ্য হয় কলোনি গুলিকে কিছু আইনী স্বীকৃতি দিতে। এইবার শুরু হয় লড়াইয়ের আরেক অধ্যায় এই লড়াই নতুন ভাবে গড়ার লড়াই। এই লড়াই পরিকল্পনা মাফিক পাড়ায় পাড়ায় বিদ্যালয় ,কলেজ গড়ার লড়াই। উদ্বাস্তু মানুষদের লড়াইয়ের ফলেই তো টালিগঞ্জের বিজয়গড় আর নেতাজী নগর কলেজ দুটি প্রতিষ্ঠিত হয়।আর এই দুটি কলেজ গঠনের প্রান পুরুষ ছিলেন কমরেড প্রশান্ত শূর। এরপর এই কলোনিগুলির উপর দিয়ে বহু ঝড় বয়ে গেছে বহুবার তাদের বানভাসি হতে হয়েছে কিন্ত বন্যার জলে সব ভেসে গেলেও তাদের বন্ধু লাল ঝান্ডার মানুষগুলি কিন্ত তাদের ছেড়ে যায়নি।নিরাপদ আশ্রয়ে কলোনির স্কুল বাড়ি গুলিতে তাদের নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দেওয়া থেকে তাদের খাওয়ার যোগানো সবই করতো তারা। এরপর এই কলোনির মানুষগুলির উপর আসে ৭০দশকের সেই ভয়ংকর কালো দিন গুলি যেখানে সিপিআই এম করবার অপরাধে কলোনির অধিকাংশ যুবক কে পাড়া ছাড়া হতে হয়।টালিগঞ্জের রিজেন্ট কলোনি ,অশোক নগর,আজাদগড়,নেতাজী নগর,বিজয়গড় কলোনির বহু তরতাজা প্রান সেদিন ঝরে গেছিল কংগ্রেসের গুন্ডা হাতে আর পুলিশের গুলিতে।গোটা টালিগঞ্জের অধিকাংশ কলোনিগুলিতে সেই সন্ত্রাসের স্মৃতি বহন করে আজোও রয়েছে শহীদ বেদিগুলি।


অবশেষে আসে ১৯৭৭সালের জুন মাস কমরেড জ্যোতিবসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা।আর এই সরকার উদ্বাস্তুদের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়ায় তাদের। দেওয়া হয় নির্শত দলিল।বহু সংগ্রামের পরে কলোনির মানুষের নামের পাশে আর জবরদখল কারী শব্দটি রইল না বামফ্রন্ট সরকার তাদের নির্শত দলিল দিয়ে তাদের জমির আইনি স্বীকৃতি দিলেন,তারা হলেন নিজের জমির মালিক। শুধুমাত্র টালিগঞ্জ নয় গোটা বাংলা জুড়েই উদ্বাস্তুদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন পরিচালনা করেছিল কমিউনিস্ট পার্টিই।