৯৪ সাল। বাড়ির বাধ্য চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রের নিয়মিত রুটিন ছিল পড়াশোনা শেষ করে রাত ১০.৩০ মধ্যে ঘুমিয়ে পরা। ওই বছরের জুন মাসে চারিদিকে কেমন একটা হইচই পড়লো। স্কুলে যাওয়া আসার পথে দেখছি বিশাল বড় বড় অচেনা পতাকা টাঙানো, বিকালে গড়ফা যুব সম্প্রদায়ের খেলার মাঠে দাদাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক! কৌতুহল বাড়ছিল। বাবা কৌতুহল নিরসন করলেন এবং সেই প্রথম বড় হওয়ার অনুভুতির প্রথম দরজা টা খুলে গেলো আমার সামনে। রাত ১০.৩০ টায় ঘুমের নিয়ম আপাতত কিছুদিনের জন্য মুলতুবি ঘোষণা হলো, কারণ বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখা যাবে মাঝরাতে। সেই প্রথম চিনতে শেখা হলুদ – সবুজ জার্সি। প্রথম বাবার সাথে ফ্লাস্কে রাখা চায়ে চুমুক দেওয়া। প্রথম আলাপ রোমারিও, বেবেতো, কাফু, লিওনার্দো, দুঙ্গা নামগুলোর সাথে। সদ্য আলাপেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই মুগ্ধতার ট্র‍্যাডিশন সমানে চলছে! কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ড ছাড়া আর বিশেষ বেগ পেতে হয়নি সেবারের ব্রাজিল কে। ফাইনালে টাইব্রেকারে রবার্তো বাজ্জোর শট গোলের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমরাও হাওয়ায় উড়তে শুরু করেছিলাম।

বড় হওয়ার সাথে সাথে ভালোলাগা বাড়তেই থাকে। ৯৮ বিশ্বকাপে ফাইনালে হারের যন্ত্রণা ২০০২ সালে লাঘব হয়। ২০০২ সালে রবার্তো কার্লোস, রোনাল্ডো, রিভাল্ডো, রোনাল্ডিনহোর দাপটে বাকি সব টীম ম্লান হয়ে গেছিলো। গোটা বিশ্বকাপে অপ্রতিরোধ্য অলিভার কানকে হারিয়ে রোনাল্ডোর দুহাত ছাড়িয়ে হালকা চালে দৌড়ে, আর পাড়ায় পাড়ায় ব্যান্ডপার্টি এবং ব্রাজিলের পতাকা নিয়ে মিছিল…বহুদিন মনে থেকে যাবে।

আরো একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে জীবনে এল রাজনীতি। ২০০৩ সালে বামপন্থী লুলা নির্বাচিত হলেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে। জীবন শুরু করেছিলেন খুবই অল্প বয়সে শ্রমিক হিসাবে। শ্রমিকের দাবী আদায়ে ধর্মঘট করার কারণে সামরিক শাসকের হাতে গ্রেপ্তার ও হয়েছিলেন। পুরনো কাগজের পাতায় ব্রাজিলের খেলার বিশ্লেষণ হতো, যে ওরা খেলে আনন্দ দেওয়ার জন্য, শুধুই জেতার জন্য নয়। ব্রাজিল কখনোই অঙ্ক কষে খেলত না। এক অন্যরকম জীবনদর্শন। তীব্র দারিদ্র্য, খাদ্য সমস্যায় জর্জরিত থাকা দেশ ব্রাজিল। বিগত ৩ বছরে ব্রাজিলে প্রায় ৯৬ লাখ লোকের আয় কমে গেছে। এই তীব্র যন্ত্রণার উপশম ওরা খুঁজে পায় ফুটবলের মধ্যে। ময়লার গাদার মধ্যে ফুটবল নাচাতে নাচাতে বিপথে যাওয়ার হাজার প্রলোভন কে উপেক্ষা করে গোটা বিশ্বকে পায়ের যাদুতে মুগ্ধ করে। চোখ ধাঁধানো ড্রিবল। দূরন্ত বল কন্ট্রোল। মুহুর্মুহু আক্রমণের ঢেউ প্রতিপক্ষের বক্সে। চকিতে ফলস দিয়ে প্রতিপক্ষকে বোকা বানানো। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য আর দলগত সংহতির অভূতপূর্ব যুগলবন্দী। পেলে, গ্যারিঞ্চা থেকে শুরু করে এই আমলের নেইমার… গোটা বিশ্বকে অসাধারণ শিল্প উপহার দিয়ে চলেছে।

ক্লোভিস ফার্নান্ডেজ। নামটা অনেকেরই হয়তো মনে নেই, কিন্তু ২০১৪ তে সেই যন্ত্রণা ক্লিষ্ট খেলায় ফলাফলের পরে, অসহায় দৃষ্টিতে চোখে জল নিয়ে বিশ্বকাপের রেপ্লিকা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যে বয়স্ক মানুষটি, যার ছবি পরেরদিন কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছয়লাপ হয়েছিল…তিনিই ক্লোভিস ফার্নান্ডেজ। স্রেফ ফুটবল ভালবেসে, ব্রাজিল কে ভালোবেসে কাজকর্ম ছেড়ে দেশে দেশে ঘুরতেন ব্রাজিলের খেলা দেখতে। শরীরে মারণরোগ বাসা বাঁধলেও তাকে আটকাতে পারেনি ব্রাজিলের খেলা থেকে। ২০১৪ সালে সেই সেমিফাইনাল ম্যাচের পর কান্না চেপে বিশ্বকাপের রেপ্লিকায় চুম্বন দিয়ে তা জার্মানির এক খুদে সমর্থকের হাতে তুলে দেন, যোগ্যতার স্মারক হিসাবে। সেই জীবনদর্শন, যা অনুসরণযোগ্য। মারণরোগের কাছে ২০১৫ সালে পরাজিত হন ক্লোভিস। কিন্তু গোটা জীবন দিয়ে ফুটবলকে, ব্রাজিলকে ভালোবাসার আবেগ কে হারতে দেননি।

এখনো পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিটি বিশ্বকাপে একমাত্র অংশগ্রহণকারী টীম ঢুকে পড়েছে কাতারে। এমন এমন খেলোয়াড়দের টীমের বাইরে রাখতে হয়েছে যাদের পেলে অন্য দেশ ধন্য হয়ে যেতো। জার্সিতে ৫টি তারা রয়েছে সেই ২০০২ সাল থেকে। পৃথিবীতে বহু এমন মানুষ আছেন, যারা মনে করেন ব্রাজিল জিতলে আসলে তারাই জেতেন। জীবনযুদ্ধে হারতে হারতে ওই ৯০ মিনিটে তারা জিতে যেতে চান, ব্রাজিলের ভরসায়। তাদের জন্য, জার্সিতে তারার সংখ্যা বৃদ্ধি পাক এই বারেই।