ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতির পথে অন‍্যতম প্রধান অন্তরায় ছিল একথা ঐতিহাসিকভাবে যেমন সত‍্য, তেমনি একথাও সত‍্য যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের সাংগঠনিক সূচনা পর্ব থেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছে। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবির পাশাপাশি  ভারতের জাতীয়  কংগ্রেসের অভ‍্যন্তরে এই কারণে কমিউনিস্টরা নিজেদের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আদর্শগত অবস্থানের স্বাতন্ত্র‍্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনে আলাদা প্রার্থী ঘোষণা করে কমিউনিস্ট পার্টি পাকাপাকিভাবে নিজেদের পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্ব জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছিলেন। সে সময়  তাঁদের আহ্বানের ভাষা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ,” ভারতবাসী ভারতবাসীর বিরুদ্ধে লড়িও না। যে ব্রিটিশরা আমাদের দাস করিয়া রাখিয়াছে সমস্ত ভারতবাসী একত্রে তাহাদের বিরুদ্ধে লড়ো।” এই আহ্বানের ব‍্যখ‍্যা দেওয়া হয়েছে এইভাবে,”কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান চেষ্টা হইল চূড়ান্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম যাহাতে আরম্ভ হইতে পারে,সেজন‍্য স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের মধ‍্যে অনৈক্য দূর করিয়া এক সম্মিলিত স্বাধীনতা ফ্রন্ট সংগঠন করা।” ১৯৪৬ সালের নির্বাচন উপলক্ষে তখনকার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় ইস্তাহারে এই আপসহীন রাজনৈতিক অবস্থান আজও শুধু কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের নয় সমগ্র বামপন্থী ভারতীয়দের গর্বের বিষয়। এই নির্বাচনী ইস্তাহার আরও একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পরিস্থিতি তৈরী করা যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য তা এত স্পষ্ট ভাষায় এদেশের আর কোনো রাজনৈতিক দল ব‍্যক্ত করেনি। ব্রিটিশ শাসককে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি তাদের ইস্তাহারে অনাবৃত করেছে কঠোরভাষায়,” তাহাদের পরিকল্পনা হইতেছে ভারতবর্ষকে এক হিন্দু প্রধান রাজ‍্যে ও এক মুসলমান প্রধান রাজ‍্যে বিভক্ত করা। এই দুই রাজ‍্যের শাসনতন্ত্র পৃথক পৃথকভাবে ব্রিটিশ গর্ভণমেন্টের সহযোগিতায় রচিত হইবে।…… ভারতবর্ষকে স্থায়ীভাবে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার ও নূতন এক ধরণের দাসত্ব কায়েম করার এ এক চতুর পরিকল্পনা। ” তারপরেই “মুক্তি নয় লজ্জা” শীর্ষক পরিচ্ছেদে লেখা হচ্ছে, আমাদের দেশকে নূতন দাসত্ব শৃঙ্খলে বাঁধিবার জন‍্য এবং স্থায়ীভাবে বিভক্ত করিবার জন‍্য সাম্রাজ‍্যবাদীরা যে পরিকল্পনা করিয়াছে তাহার বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি তাহার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিতেছে।”

স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়কার ধর্মীয় বিভেদকামী শক্তির সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য ছিল। কারণ বিশেষত ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গ বিভাজন ও দেশভাগের পরিকল্পনাকে কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সাম্রাজ‍্যবাদী পদক্ষেপ হিসাবে প্রচার করলেও হিন্দু মহাসভা বাংলার  হিন্দুদের জন‍্য একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করার আহ্বান জানায় এবং ২২শে এপ্রিল নয়াদিল্লীতে একটি জনসভায় শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ‍্যায় ঘোষণা করেন, পাকিস্তান যদি গঠিত না ও হয়… বাংলার হিন্দু প্রধান অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করতে হবে।  ১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগষ্ট কলকাতা মহানগরীতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরে বঙ্গভঙ্গের জোরালো দাবি ওঠে। হিন্দু মহাসভার নেতারা মুসলমানদের হাত থেকে হিন্দুদের আত্মরক্ষার জন‍্য এই দাবি তোলা হয়,যা হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐক্যবদ্ধ বাসভূমির আদর্শের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। বঙ্গভঙ্গের দাবী উঠেছিল মুসলমান বাঙালিদের থেকে হিন্দু বাঙালি কে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্য নিয়েই। ঐক্যবদ্ধ ভারত ইউনিয়নের পক্ষে কমিউনিস্টদের প্রবল প্রচার করা কমিউনিস্টদের সঙ্গে হিন্দু মহাসভার মতো ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনের মতৈক‍্যের কোনো সুযোগ নেই। অপর পক্ষে মুসলিম লীগের গুরুত্ব ভারতের মুসলমান অধিবাসীদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব মূলক সংগঠন হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক মঞ্চ কংগ্রেসের সমান্তরাল হলেও ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের দাবি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার লক্ষ্যে পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনের গতিকে ব‍্যহত করছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দল এই বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে নিজেদের আদর্শগত অবস্থান প্রকাশ করেনি। শ্রমিকের ন‍্যায‍্য মজুরির অধিকার,কৃষকের জমি ও ফসলের অধিকার,বেকার যুবকের কাজের অধিকার তখনও কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান দাবি হিসাবে গণ‍্য ছিল। মজুতদারদের ফসলের দাম নিয়ে প্রতারণা ও বৃহত্তম শিল্পমালিকদের শ্রমিকদের মজুরি চুরি নিয়ে সেই সময় নির্বাচনী প্রচারে ঝড় তুলেছিলেন জ‍্যোতি বসু,বি টি রণদিভেরা। বিশেষত বাংলার মানুষের কাছে তাঁরা প্রশ্ন রেখেছিলেন জনগণের শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবেন নাকি জনগণকে বিভক্ত করে ভ্রাতৃযুদ্ধে বাংলার শ‍্যামল মাটিকে কলঙ্কিত করবেন?

ক্ষমতার রাজনীতির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে আপসকামী নীতি দেশভাগ ঠেকাতে পারেনি। কারণ ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক  আইনসভা নির্বাচনে মোট  ১৫৪৫টি আসনের মধ‍্যে ১০৮টি আসনে প্রার্থী দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি মাত্র আটটি আসনে জয়লাভ করেছিল। সাম্রাজ‍্যবাদের ওপর শেষ আঘাত হানার পরিস্থিতি তৈরি না হলেও কমিউনিস্টদের লড়াকু অবস্থান প্রাক স্বাধীনতা পর্বের ভারতের ইতিহাসের উজ্জ্বল এক অধ‍্যায়।