“ফ্যুসের”- “যার বাংলা দাঁড়ায় ক্ষিপ্ত ঝড়ের বুলেট”। কিন্তু কে সে! যদিও জানে সবাই কারণ , এখন

 “Che Guevara, from Communist Firebrand to Capitalist Brand”। ইতিহাসের এক নন্দিত চরিত্রের নাম চে গ্যেভারা। জীবন কেটেছে সংগ্রামে, বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত আর অসংখ্য বৈচিত্রতায়। তার জন্ম ১৯২৮ আজকের দিনে ১৪ জুন। চে গ্যেভারা ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় মার্ক্সবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। আর বিপ্লবীর প্রেম তা সবসময়ই দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কিংবদন্তি নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সহযোদ্ধা ছিলেন। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে বিশ্বজুড়ে লড়াইয়ে কখনো নিজে তার অংশীদার হয়েছেন কখনো পথ দেখিয়েছেন। চে হচ্ছে সব দেশে সর্বকালের প্রতিবাদের স্বারক। মানুষের অন্তরে মুক্তির মশাল হয়ে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন সবার মাঝে। আমাদের শিরা থেকে মজ্জায় ধাবিত শরীরের হিমোগ্লোবিন জুড়ে, আমাদের চেতনা থেকে হৃদয় জুড়ে চে’এর প্রেম আজীবনকাল।

তাঁর প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গ্যেভারা দে লা সের্না। তবে তিনি সারাবিশ্বে “লা চে বা কেবলমাত্র চে’’ নামেই পরিচিত। কিন্তু অদ্ভূত বিষয় কী জানেন জিন্দা থাকলে নিন্দা, মরলে প্রসংশা, অবশ্য মরার হাতির দাম লাখ টাকা এটাও ভুললে চলবে না। যাইহোক আবারও ফিরি আমাদের “ফিউজারের” কথায় ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর  দুপুর ১.১০ নাগাদ তিনি মৃত্যু বরণ করেন মাত্র ৩৯ বছর বয়সে। মৃত্যুর পর তাঁর শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়। তিনি চলে যান এই রহস্যভরা পৃথিবী ছেড়ে। তাঁর জন্মদিনে তাকে বিশেষভাবে স্মরণ করছি আমরা। ওহো বলতেই ভুলে গেছি কে এই ফিউজার, বিপ্লবী হওয়ার সাথে সাথে তাঁর চরিত্রের আরো উল্লেখযোগ্য দিক আছে যদিও আপনারা জানেন তবুও আসি ফিউজারের প্রসঙ্গে পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন জৈষ্ঠতম। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী চে ভালবাসতেন কবিতা শুনতে ও লিখতে। শৈশব থেকেই তিনি কার্ল মার্কস, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সরগারির, পাবলো নেরুদা, জন কিটস, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান– অনেকেই তাঁর মনে ও মননে স্বপ্ন ও কল্পনার মায়াজাল বুনে দিয়েছিল। এর  পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু, আলবার্ট ক্যামাস, ভ্লাদিমির লেনিন , রবার্ট ফ্রস্টের বইও পড়েছেন। তিনি স্বয়ং ভালো আবৃত্তিও পারতেন। পছন্দের তালিকায় ছিল সাঁতার, ফুটবল,গলফ, শুটিং, দাবা খেলা। চে সাইক্লিংয়েও ছিলেন পারদর্শী। ১২ বছর বয়সে দাবা খেলা শেখেন তার বাবার কাছে এবং স্থানীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন। তিনি রাগবি ইউনিয়নের একজন অতি আগ্রহী সদস্য ছিলেন এবং বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয় রাগবি দলের হয়েও খেলেছেন। রাগবি খেলার ক্ষিপ্রতার জন্য তাকে ‘ফিউজার’ নামে ডাকা হতো। এই হলো আমাদের কমরেড ফিউজার।

 লা চে-এর খুব শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্রদের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তাঁর ভিতর তৈরি হতে থাকে। তাঁর বাবা ছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে (Spanish Civil War) রিপাবলিকানদের একজন গোড়া সমর্থক। ছাত্রাবস্থায় মোটরসাইকেলে লাতিন আমেরিকা ভ্রমণকালে সেখানকার দারিদ্রতা তাঁকে ভীষণ ভাবে নাড়িয়ে দেয়। জাগতে শুরু করে সুপ্ত বিপ্লবী চেতনা। সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন।

এবার আসি চানচোর বিপ্লবী সন্ধিক্ষণে, যে-লগ্নে এক তরুণ চিকিত্‍সকের মনে জন্ম নিল এক বিপ্লবীর ! ক্ষুধা আর শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জেদ। অদম্য অফুরন্ত প্রাণশক্তি, দুর্দমনীয় মনোবল, অসম্ভব প্রত্যয় নিয়ে নিজ লক্ষ্যে অবিচল, অকুতোভয় চে ঘোষণা করলেন জেহাদ অনিয়ম আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কেড়ে নিতে চাইলেন নিজেদের অধিকার। ওহো চানচো কে? আপনারা জানেন না! আরে জানেন জানেন বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা তাকে ডাকতো চানচো (pig) বলে, কারণ তিনি অনিয়মিত স্নান করতেন এবং সপ্তাহে একবার মাত্র পোশাক পাল্টাতেন। কি মজার মানুষ বলুন তো! আহা প্রেমিক বুঝি এমনই হয়। আসুন ফেরা যাক ফ্যুসেরের কথায়। বিপ্লবের পরিকল্পনায় ফিদেল কাস্ত্রোর প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো থেকে কিউবায় আক্রমণ চালানো। ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে তারা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই বাতিস্তার সেনাবাহিনী তাঁদের আক্রমণ করে।

সে যাত্রায় মাত্র ২২ জন বেঁচে যান। চে গ্যেভারা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময় তিনি তাঁর চিকিৎসাসামগ্রীর সঙ্গে একজন কমরেডের ফেলে যাওয়া এক বাক্স গোলাবারুদও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তুলে নিয়েছিলেন। যা তাঁকে পরিশেষে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে পরিণত করল!

যাক অনেক হলো ইতিহাসের রোমন্থন, যত ঘাটবেন তত শাসকের হাড়ে মজ্জায় শিরা-উপশিরায় হিম হয়ে উঠবে। কোন বেইমান বিপ্লবকে ভয় পায় না বলুন। ভুলে গেলে চলবে “দ্রোহের আগুন নেভালেও লাল”। তাই তো কবির কবিতার ছন্দে বলতে ইচ্ছে করে বার বার

“সিগারেট হাতে তোমার ছবি আজও হাজারো মেয়ের ক্রাশ,
বন্ধুক হাতে তুমি আজও ফ্যাসিবাদের ত্রাস”…

আসি এবার একটু ফ্যাসিবাদীদের প্রশ্নে, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, চে-র বিরুদ্ধে পুরো অভিযান চলেছিল সিআইএর নেতৃত্বে। বনজঙ্গলে ঘেরা বলিভিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম লা হিগুয়েরাতে। বলিভিয়ার সামরিক সরকার নিরস্ত্র চে গ্যেভারাকে-কে বন্দি অবস্থায় বিচার না করে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। আসলে কী জানেন “ নির্বোধ ঘাতক জানেনা , মরণেই থামেনা জীবন’’। ওরা ভুলে গিয়েছিলো দেশে-দেশে চে-র ঘর আছে।

 কিউবার সফল বিপ্ল­বের কমান্ড্যান্ট হিসেবে মৃত্যুর আগেই লা চে হয়ে উঠেছিলেন সারাবিশ্বের বিপ্ল­বীদের অনুপ্রেরণার উৎস। চে গ্যেভারার মহান আত্মত্যাগ আর মৃত্যু লাতিন আমেরিকার দেশে-দেশে এবং একই সঙ্গে রোম, প্রাগ, নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদসহ বিভিন্ন জায়গায় নানা মতাদর্শের দল ও গোষ্ঠীর কাছে মহত্ত্বের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৮ সালে প্যারিসের ছাত্র ও যুবদের বিদ্রোহে লাল পতাকা হয়ে সামনে ছিলেন চে গ্যেভারা। ১৯৬৮ সালের শেষে আমরা পেয়ে যাই জলপাই রঙের প্রচ্ছদে চে-র বলিভিয়ান ডায়েরি। 

১৯৬৭ সালের ১২ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘গ্যেভারা’স ডেথ, দ্য মিনিং অব ল্যাটিন আমেরিকা’। এতে গ্যেভারাকে কিউবা বিপ্লবের সুদক্ষ রণকৌশলী ব্যক্তিত্ব ও বিপ্লবের আদর্শ হিসেবে প্রশংসা করা হয় এবং তিনি বীরোচিত মৃত্যুবরণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তখন লিখেছিল, ‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।’ ১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণকবরে চে ও তার সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। মৃত্যুর এতোবছর পরও দেশে দেশে বিপ্লবীদের আজও প্রেরণার উৎস চে গ্যেভারা।

বিশ্বে আজ পর্যন্ত যত জন মানুষকে নিয়ে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সাম্যবাদী বিপ্লবের প্রতীক চে আর্নেস্তো গ্যেভারা। টাইমস পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশিত হয়। চে গ্যেভারা কিউবান ভাষায় লিখেছেন প্রায় ৭০টি নিবন্ধ, ধারণা করা হয় ছদ্মনামে কিংবা নামহীন অবস্থায় লিখেছেন ২৫ টি। এছাড়া তিনি লিখে গিয়েছেন পাঁচটি বইয়ের ভূমিকা। তাঁর লেখালেখি নিয়ে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে নয় খণ্ড রচনাবলি।  কিউবার অত্যাচারী বাতিস্তা সরকারের সঙ্গে প্রায় দু’বছরের সংগ্রামের পর সেই সরকারের পতন হয়। ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারী চে’- বাহিনী রাজধানী হাভানা দখল করে। কিউবায় প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্ট হলেন ফিদেল। চে’-কে প্রথমে শিল্প মন্ত্রণালয়( ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত) এবং পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে গ্যেভারা বিশ্বের বিপ্লবীদের কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি পান। তাই তিনি কিউবার প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান করার জন্য নিঊয়র্ক শহরে যান। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাৎকারটা দিয়েছেন প্রায় ২৫০-এর কাছাকাছি। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে সংগৃহিত আছে ৭০টির মতো। মনে করছেন এখানেই শেষ না না, শুরু তো শেষ থেকেই হয়।

আপনি অতি রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী হতে পারেন, হতে পারেন গোঁড়া ধার্মিক, বিশ্বাস করতে পারেন ধান্দার ধনতন্ত্রে– কিন্তু বিভিন্ন দেশে ঘুরে মানুষের স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত করা মনুষ্যত্বকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারবেন না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, প্রতিবাদে, সংগ্রামে চে রক্তধারার মতো মিশে আছেন। এই নাস্তিকই শিখিয়েছেন কিভাবে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। মানুষের জাগরণে অনুপ্রেরণা হয়ে, প্রণোদনা হয়ে প্রতিদিনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আর সেই লড়াইয়ের প্রথম শর্ত শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে নতজানু হয়ে নয় ‘বাস্তববাদী হয়ে ’, ‘অসম্ভব’কে দাবি করতে শেখায়।’ অতীতের মতো এখনো লাতিন আমেরিকায় চে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, অনেক বেশি জাগ্রত। শুধু লাতিন আমেরিকা কেন, সারাবিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের বিপ্লব, বিদ্রোহ ও উত্থানে সহযাত্রী হয়ে আছেন চে গ্যেভারা।