উনিশশো বাহাত্তর সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও অপর্ণা সেন অভিনীত ‘জীবন সৈকতে’ ছবিতে এ সময়ের বিচারেও অভাবনীয় দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত। দুটি পাশ্চাত্য সুরশৈলীর অনুসরণে বাঁধা গানের মধ‍্যে সুপারহিট রোমান্টিক গান “রাত এখনও অনেক বাকি” গাইয়েছিলেন আশা ভোঁসলেকে দিয়ে এবং অপেক্ষাকৃত চটুল যৌন আবেদনময় “কেন যে মনে হয়” গানটি গেয়েছিলেন সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়। শিল্পী দুজনেই দক্ষতার তুঙ্গে সে সময়। আশা ভোঁসলের এই ধরনের গানের রেকর্ড থাকলেও সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়ের কণ্ঠে এ ধরনের গান সে সময়  শ্রোতারা শুনতে অভ‍্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু সুধীন দাশগুপ্ত পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়কে নিয়ে। “তোমাকে যেখানে আরো কাছে গো পাই” অংশে নীচু পর্দায় খসখসে নাটকীয়তা এনে তার পরেই “বলো না” অংশে খাড়াভাবে চড়া পর্দায় সুর লাগিয়ে সমুদ্র সৈকতের দৃশ‍্যে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিলেন বাংলা গানে শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম শোনানো সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়।

সুধীন দাশগুপ্তের আগেও রবীন চট্টোপাধ্যায়,অনুপম ঘটকরা ম‍্যাজিক দেখাতেন। কারণ সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়েরা ছিলেন। শিল্পে ম‍্যাজিক করা যায় সাহস থাকলে। রবীন চট্টোপাধ্যায় “ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা” বা অনুপম ঘটক “গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু”-র মতো তথাকথিত স্লো-নাম্বার তৈরি করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ‍্যায়ের জন‍্য এবং  ষাট বছর পেরিয়েও তা জনপ্রিয় থেকে যায়। কারণ সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়ের মতো শিল্পীর কণ্ঠে সুরেলা অভিব‍্যক্তি সহ উচ্চারণে সে গান কালজয়ী হয়েছে। শাস্ত্রীয় সংগীতে স্বতন্ত্র অনন্যসাধারণ বললে সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায় সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। আকৈশোর পেশাদারিত্ব তাঁকে রেওয়াজ করার বাইরেও গায়কিতে নিজস্বতা অক্ষুণ্ণ রেখেই  নমনীয়তা আনতে শিখিয়েছে। যিনি “জলতরঙ্গ বাজে” গাইতে পারেন তিনিই “ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ কে জানে”-তে শ‍্যামল মিত্রের সঙ্গে যুগলে আশ্চর্য মানানসই হয়ে যান। আবার হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের সঙ্গে “রাগ যে তোমার মিষ্টি আরও অনুরাগের চেয়ে”এবং মান্না দের সঙ্গে “চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে”-র মতো গানেও চিরকালীন আসনে অধিষ্ঠান করেন। ‘জয়জয়ন্তী’ ছবিতে “কেন ডাকো বারে বারে” গানটির প্রারম্ভে আলাপে ধৈবত ও নিষাদ পর পর যে ভাবে লাগান তাতে গানটির আবহ তৈরি হয়ে যায় আপনিই। অপর্ণা সেনের মতো অভিনেত্রীর দক্ষতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি গানটির ভাব সন্ধ‍্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ফুটে উঠেছে বলে কার্যত ‘জয়জয়ন্তী’-র থিম সং হিসাবে গানটি কতকটা অযাচিতভাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছে। শাস্ত্রীয় সংগীতের সিদ্ধ সাধক মানবেন্দ্র মুখোপাধ‍্যায় “আমাদের ছুটি ছুটি”-র মতো গান বেঁধে যতটা চমকে দেন,ততটাই দিয়েছেন সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায় গানটি গেয়ে,বিশেষত তাল ফেরতা “ওই দূরে রাখালিয়া” অংশে। চড়া পর্দায় কতটা অনায়াসে বিচরণ এই অসামান্যার “বাঁশি রে!” শব্দ দুটির স্পর্শে (হ‍্যাঁ,এই শব্দটিই ব্যবহার করলাম সচেতনভাবেই)। আমাদের মতো অক্ষম অযোগ্য ছাত্রদের পিতা ও পিতৃতুল্য গুরুরা উপদেশ দিতেন স্বরস্থান স্পর্শ করে শিখতে। আমরা খাটতে ভয় পেতাম বলে আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেল গান। আমরা তাই চোখের জলে ভাসতে ভাসতে শুনি মান্না দে, সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ‍্যায়ের মতো সাধক সাধিকা আর মুম্বাইতে ক্ষণজন্মা মহম্মদ রফি,লতা মঙ্গেশকর,আশা ভোঁসলে ও পণ্ডিত জেশু দাস কীভাবে স্বরস্থানে আঙুলে আদরের স্পর্শ করতেন। আচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, আচার্য চিন্ময় লাহিড়ী,আচার্য এ টি কানন যেমন করতেন বলে শুনেছি কর্তাদের মুখে।

উদাহরণ চান বন্ধুরা? হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের কণ্ঠে “এমন আমি ঘর বেঁধেছি” গানটি ছবিতে যেভাবে শুরু হয় সেখানে সন্ধ‍্যা রায়ের ঠোঁটে সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়ের গানটির প্রথম অংশ যেভাবে ব্যবহার করা হয়,তাতে মনে হয় সিচুয়েশনটা তৈরিই হত না ওটুকু বাদ দিলে। তুলনায় দুর্বলতর পরিকল্পনার সৃষ্টি ‘মুক্তিস্নান’ ছবিতে “যে তোমায় এত জানায় কেন সে জানায় না”-র শেষার্ধে সরগম শোনার সময় বাহুল্য মনে হয় না শুধুমাত্র সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়ের গায়কির জন‍্য। পুরো ‘সরগম’-ই চড়া পর্দায়। কী অনায়াস কী সাবলীল! আসলে রেওয়াজ কথা বলে।

নিজের সুরে “ঝরা পাতা ঝড়কে ডাকে” গানটিতে সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়ের প্রতিভার চিহ্ন “আমায় কেন একটি বারও ডাকলে না”-র চলনে যেমন পাওয়া যায়,তেমনি পাওয়া যায় সলিল চৌধুরীর সৃষ্টিতে তাঁর কণ্ঠে “উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা”-তে,যার সঞ্চারীর অংশতেও বোধহয় পরবর্তীকালে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে “আসছে শতাব্দীতে আসব ফিরে”-র আভাস।

আসলে গোড়ার কথাটাতেই ফিরতে হয়। যে সংগীত পরিচালকরা বাংলা গানে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন অনেকেই সে সময় সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়ের কণ্ঠকে পছন্দ করেছেন।দক্ষতার পাশাপাশি নমনীয়তার কারণেই। ‘মঞ্জরী অপেরা’ ছবিতে “আজ হোলি খেলব শ‍্যাম” গানে “কুমকুম মারিব তোমার রাঙা চরণে” অংশটি স্বরলিপির ব‍্যাকরণ মেনেই তার সপ্তক স্পর্শ করে। কিন্তু সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের লাস‍্যময় হাসির সঙ্গে সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায়ের অভিব‍্যক্তি মিশে যাওয়ার পিছনে তাঁর নাটকীয়তার বোধ কাজ করেছিল সন্দেহ নেই। যার পরিচয় কয়েক বছর আগেই পেয়েছিল বাংলা ছবির দর্শক ‘মায়ামৃগ’ ছবিতে “ও বক্ বক্ বকম্ বকম্ পায়রা”গানটিতেই। সম্ভবত এই কারণেই “মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা”,”ওগো সিঁদুর রাঙা মেঘ”,”সজনি লো সজনি”,”ঠুন ঠুন ঠুন কাঁকনে যে কী সুর”-এর মতো মৌলিক গান তাঁর জন‍্যই তৈরি হয়েছিল।

আটাত্তর বছর ধরে প্রায় চারটি প্রজন্মকে গান শুনিয়ে বিদুষী সন্ধ‍্যা মুখোপাধ‍্যায় থামলেন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসে লেখা থাকবে আচার্য বড়ে গুলাম আলি খানের সিগনেচার সং “কা কঁরু সজনি”-র বঙ্গীয় রূপ তাঁর কণ্ঠেই ধরা রয়েছে গুরুপুত্র আচার্য মুনাব্বর আলি খানের তত্ত্বাবধানে। 

কালের নিয়মে শূন‍্যস্থান শূন্য থাকে না এক মুহূর্তের জন‍্যও। কিন্তু শিল্পের কষ্টিপাথর বড়ো নির্মম। আফতাব-এ-মৌসিকি মহাগুরু আচার্য ফৈয়াজ খান বলতেন,”আমি আসরে গাইবার সময় পিছনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা পান বিক্রেতা পর্যন্ত আমার পরীক্ষা নেয়।” সেই অমোঘ গুরুবাক‍্য মনে রেখেই হয়তো ভাবীকালের কোনও সংগীত শিল্পীকে এই প্রশ্ন কোনও শ্রোতা করবেন,আড় ঠেকায় ঠুংরির চালে “আমার মনে নেই মন কি হবে আমার” গানটি শিখে অনেক কৃতী শিক্ষার্থীই গাইতে পারবেন,কিন্তু “এই নিয়ে বাঁচি”-র পরের লাইনে “কত সুখে আছি”-র হাহাকার তো শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ‍্যায়ের অনুভবের সম্পদ, তা অনুনকরণীয় নয় কি?