২৬ শে জানুয়ারি এদেশের প্রজাতন্ত্র দিবস। এক অর্থে দেশের সকল নাগরিকের  সাংবিধানিক সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষা দিবস। ১৯৫০ সালের এই দিনটিতে ভারতবর্ষের সংবিধান কার্যকর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২৪ শে জানুয়ারি হাতে লেখা সংবিধানের দুটি কপিতে স্বাক্ষর করেন গণপরিষদের ৩০৮ জন সদস্য। তার আগে  ১৯৪৯ সালের ২৬ শে নভেম্বর গণপরিষদের ২৮৪ জন সদস্য সই করার মধ্য দিয়ে সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এই দিনটিকে তাই সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কমিটি বহু পরিশ্রম করে প্রায় দু বছর ১১ মাস  ১৮ দিন সময় নিয়ে তৈরি করেছিলেন এই সংবিধান যা কার্যকর করার দায়িত্ব ছিল স্বাধীন সরকারের। সংবিধানের শতাধিক ( ১০৫ টি) সংশোধনী গৃহীত হয়েছে। সব মিলিয়ে এটি কার্যকর হয়েছে কতটা তা নিয়ে বিস্তর  বিতর্ক আছে। আরএসএস নিয়ন্ত্রণাধীন বিজেপির সরকার দেশে দ্বিতীয় দফায় তৈরি হওয়ার পর সংবিধানকে অমান্য করার প্রবণতা অনেকটা বেড়েছে। এখন তাই সংবিধান কতটা কার্যকর করা হলো তার চাইতেও সংবিধানকে রক্ষা করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরুর দিন থেকেই আরএসএস ভারতের সংবিধানকে  মান্যতা দেয়নি। মনুসংহিতার আদলে তারা সংবিধান রচনা করতে চায়। তাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর আরএসএসের রাষ্ট্র পরিচালনায় হস্তক্ষেপ যেমন বেড়েছে, সংবিধানকে অমান্য করার প্রবণতাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।

ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধ অর্থাৎ প্রস্তাবনার অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যার রূপ দিয়েছিলেন স্বয়ং জহরলাল নেহেরু। এই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ভারত একটি  সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে উঠবে।  দেশবাসী হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্ব হল ভারতবর্ষকে এমন ভাবে গড়ে তোলা যাতে এ দেশের সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করা যায়। তারা যাতে চিন্তা, মত প্রকাশ, বিশ্বাস ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন। তাদের মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে সমতাবিধান হতে পারে এবং সর্বোপরি তাদের সকলের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব ভাব গড়ে তুলে ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষিত হয়। প্রস্তাবনার এই কথাগুলি দেশবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অথচ এর অধিকাংশই আজও অধরা থেকে গেছে।

সার্বভৌম কথার অর্থ রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্ত বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। এখানে অন্য কারো হস্তক্ষেপ থাকবে না। ধর্মনিরপেক্ষ বলতে বোঝানো হয়েছে রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবে না বা রাষ্ট্র কোন ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। ধর্মের ভিত্তিতে কোন কর আরোপ করবে না। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক স্বাধীনভাবে আপন ধর্ম পালন ও প্রচার করতে পারবেন। অথচ, এদেশে এখন ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের ভাগ করতে চাইছে বিজেপি সরকার যা অসাংবিধানিক। গণতান্ত্রিক অর্থে বলা হয়েছে জাতি ধর্ম-বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা। প্রজাতন্ত্রে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করে নির্বাচিত সরকার গঠিত হবে।   আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়  পরিকল্পিত অর্থনীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে সম্পদ ও অর্থ বণ্টনের ক্ষেত্রে  সমতা সুনিশ্চিত হবে, নাগরিকদের মধ্যে  আয় ও সম্পদের বণ্টনে বৈষম্য থাকবে না । ভারতবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে এই সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতার সুনির্দিষ্ট বন্টন করা হয়েছে। মূলতঃ তিনটি ভাগে এটি বিভক্ত।  জাতীয় প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, মুদ্রা ব্যবস্থার মত কিছু বিষয় আছে যা কেন্দ্রীয় তালিকার অন্তর্গত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, স্থানীয় সরকার অর্থাৎ পঞ্চায়েত পৌরসভা গড়ে তোলা ইত্যাদি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। আবার শিক্ষা পরিবহন অপরাধমূলক আইন ইত্যাদি বিষয়গুলি যুগ্ম তালিকাভুক্ত যেখানে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়কে মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় যেতে হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, যা অখন্ড ভারতবর্ষের প্রধান ভিত্তি, তাকেই প্রতিনিয়ত দুর্বল করছে।

ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে বলা আছে। সাম্যের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, শোষণের বিরুদ্ধে লড়বার অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার এবং সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার– এই ছটি হল আমাদের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার।  দুঃখের হলেও একথা সত্যি, দেশের একটা বড় অংশের মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে  সম্যক ওয়াকিবহাল নন। সরকার এই সুযোগটি কাজে লাগায় শোষণের হাতিয়ার হিসেবে।

অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যদি আমরা মেলাতে শুরু করি তাহলে দেখা যাবে, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা উপরোক্ত অধিকার গুলি থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত। পদে পদে আক্রান্ত হচ্ছে এদেশের সংবিধান। সংবিধানের প্রধান চারটি মৌলিক ভিত্তি– ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা,  সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব আজ বিপন্ন। দেশের আইনসভা অর্থাৎ সংসদ কে খর্ব করে সংখ্যাগরিষ্ঠের একচেটিয়া শাসন কায়েম করার চেষ্টা চলছে। সংসদীয় রীতিনীতি, আলোচনা ইত্যাদি সবটাই খর্ব করা হচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে সাংসদ কেনাবেচা চলছে। হাজার হাজার কোটি টাকার অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে সংবিধানকে তোয়াক্কা না করে, নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতার দখল নিচ্ছে কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি।  মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক  সহ একের পর এক রাজ্যে এই ঘটনা ঘটেছে। কর্পোরেটকুলের পৃষ্ঠপোষকতায় আক্রান্ত হচ্ছে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার।

অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি যা আজ চরম আক্রমণের শিকার। দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন দূর অস্ত, দেশবাসীর মধ্যে বৈষম্য প্রকট চেহারা নিয়েছে। দারিদ্র, বেকারি, দুবেলা দুমুঠো খেতে না পাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাজারদরের তুলনায় আমজনতার আয় কমছে প্রতিদিন। এখন এদেশের সম্পদের সিংহভাগ ভোগ করে মুষ্টিমেয় কিছু বিত্তশালী কর্পোরেট মালিক ও তাদের পরিবার পরিজন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এদের মোট সম্পদ ও বাৎসরিক আয় গুণিতক হারে বেড়ে চলেছে। বস্তুত এরাই ( আদানি- আম্বানি-বিড়লা-গোয়েঙ্কা প্রমুখ) এখন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান পরিচালক বা নিয়ন্ত্রক। তাদের নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করতে আনা হয়েছে ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ পদ্ধতি, যা সামগ্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এক কথায় এটি হল ‘দেবে আর নেবে’ পদ্ধতি। নির্বাচনের আগে কর্পোরেট মালিকরা তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলকে যথেচ্ছ অর্থ যোগাবে এই শর্তে যে নির্বাচনের পর সরকার গঠন হলে পরের পাঁচ বছর নাগরিকদের ও সরকারি সম্পদ একসাথে যথেচ্ছ লুট করবার লাইসেন্স তাদের দিতে হবে। সারা দেশ জুড়ে এখন হচ্ছেও তাই। শর্ত মেনে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সহ ব্যাংক, বীমা, রেল, বিমানবন্দর, খনি ইত্যাদি জলের দরে বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় সরকার এইসব কর্পোরেট মালিকদের। এক্ষেত্রে নৈবেদ্যের থালা যার যেমন সাজানো, তার তেমন সরকারি খাতির। যে কারণে, আদানী গোষ্ঠীর সম্পদ আলোচ্য সময়ে অন্যদের তুলনায় কয়েক’শ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পিছিয়ে নেই আম্বানিরাও। কর্পোরেট গোষ্ঠীর এই লুটের প্রতিযোগিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর অর্থনৈতিক জীবনমান ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। তারা আজ চরম দুর্দশার শিকার। সংবিধানে বর্ণিত সাম্য ও সমানাধিকারের কথা এখন নিতান্তই পরিহাস হয়ে  দাঁড়িয়েছে।

স্বাধীন ভারতে স্বাধীন বিচারবিভাগ তৈরি হয়েছিল  যাতে সাংবিধানিক ধারাকে সরকার  লঙ্ঘন করতে না পারে। সংবিধান জনগণকে যে মৌলিক অধিকার দিয়েছে তা যেন  যথাযথ ভাবে রক্ষিত হয়। সেই বিচার ব্যবস্থায় এখন দখলদারি চলছে। একচেটিয়া দখলদারি সুনিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের  প্রক্রিয়াতেও নাক গলাতে চায়  সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপি ও তার সরকার। তাই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে কলেজিয়াম প্রথার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শাসক দলের প্রতিনিধিকে এই  কলেজিয়ামে ঢোকানোর জন্য এখন তাঁবেদারি করছে সরকার ও শাসক দল। প্রয়োজনে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে বিচারপতিদের। অন্যদিকে আমজনতা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার বলে গুজরাট দাঙ্গার নায়ক মোদি ও তার সাকরেদরা সর্বোচ্চ আদালতের বিচারে এখন নিরপরাধ সাব্যস্ত হয়েছে, অপরদিকে ন্যায় বিচার চাইতে গিয়ে জেলবন্দী হতে হচ্ছে তিস্তা শীতলাবাদকে। এই ঘটনা নিয়ে মুখ খোলার অপরাধে আগেই জেল বন্দী হয়েছেন গুজরাটের একাধিক সর্বোচ্চ পদে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনের আধিকারিকগণ। একই কারনে খুন হতে হয়েছে  মোদি জমানায় গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারিণ পান্ডিয়াকে। গোধরা কান্ডের পরবর্তী সময়ে, গণধর্ষণ ও গণহত্যার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত অপরাধীরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সম্প্রতি বীরের সম্মান লাভ করছে। এই চরম লজ্জাজনক ঘটনা সারা বিশ্বের কাছে ভারতের সুনাম হানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের জন বিরোধী নীতির প্রতিবাদ করার অপরাধে জেলবন্দি করা হয়েছে কবি ভারভারা রাও, ডাক্তার কাফিল খান, জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও ছাত্রনেতা উমর খালিদ  প্রমূখ সমাজকর্মীদের। বিচারের নামে প্রহসনের শিকার হয়ে গারদের অন্তরালে খুন হয়েছেন সমাজকর্মী ফাদার স্ট্যান্ স্বামী। ব্রিটিশ যুগের রাষ্ট্রদ্রোহীতার আইন নতুন করে লাগু হয়েছে এই আমলে। মোদির সুরে সুর মেলাতে না পারলেই দেশদ্রোহী খেতাবে জেলবন্দী হতে হবে এটাই এখন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সি এ এ, এন আর সি সংবিধানসম্মত নয়– কেবল এই সত্য কথাটুকু বলা ও তা নিয়ে আন্দোলন করবার অপরাধে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, আসাম সহ দেশের বহু জায়গায় জেলবন্দী হতে হয়েছে বহু নিরপরাধ নাগরিককে।

সংবিধান বর্ণিত প্রজাতন্ত্রের নাগরিক অধিকারকে সংকুচিত করে সাধারণ নির্বাচনকে পরিহাসে পরিণত করতে, নির্বাচন কমিশনের দখল নিয়েছে শাসক দল। কমিশনের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনভাবে হস্তক্ষেপ করবার অধিকার, যা দেশের গণতন্ত্র রক্ষার  গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার,  এখন গুরুতর প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে।  জনগণের আস্থা হারাচ্ছে নির্বাচন কমিশন যা  অত্যন্ত বিপজ্জনক। উগ্র দক্ষিণপন্থার বিপদ ফ্যাসিস্ট শক্তির চরম অভ্যুত্থানের পথকে প্রশস্ত করছে। এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে দেশের সংবিধান তার মর্যাদা হারাবে।

সংবিধানে উল্লিখিত মত প্রকাশের অধিকার বর্তমান সরকার কেড়ে  নিয়েছে। সম্প্রতি মোদি জমানায় গুজরাটে সংগঠিত দাঙ্গা তথা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ওপর তৈরি বিবিসির সাংবাদিকদের  তদন্তমূলক ডকুমেন্টারি দেখানো যাবে না এই মর্মে ফতোয়া জারি করা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তো মোদি অপরাধী নন বলা হয়েছে, তবু কেন এত ভয় তাঁর? কেন  এই ডকুমেন্টারি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে সর্বত্র? আসলে গুজরাটের ঐ নক্কারজনক ঘটনায় সত্যকে কিভাবে আড়াল করা হয়েছে  তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে নরেন্দ্র মোদী ও তার সরকার মরিয়া হয়ে এই আচরণ করছে। জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা এই ডকুমেন্টারি দেখতে চায় সবাই মিলে– সেখানেও আপত্তি শুধু তাই নয়, রামসেবক হনুমানদের তান্ডব। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। তবু,ক্যাম্পাসের আলো নিভিয়ে নেট বন্ধ করেও রোখা যায়নি এ শুভ চেতনার যৌবনকে। ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে বহু মানুষ আবার নতুন করে এদেশের সেই কলঙ্কজনক ইতিহাস– যা তথ্যপ্রমাণ সহ বর্ণিত হয়েছে  বিবিসির এই  দুই পর্বের ডকুমেন্টারিতে, দেখছেন শুধু তাই নয় অন্যদেরও দেখার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন। নতুবা এই শয়তানদের চেনা ও তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উৎখাত করার তাগিদ তৈরি হবে না।। দেশজুড়ে এক নজরদারি মূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হয়েছে যা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। এর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী।

দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এখন বিপন্ন। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিনিয়ত ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণের নেশায় মরিয়া হয়ে রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়গুলিতেও নাক  গলাচ্ছে। প্ল্যানিং কমিশন তুলে দিয়ে নীতি আয়োগ গঠনের মধ্য দিয়ে রাজ্যগুলির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। শিক্ষা যুগ্ম তালিকাভুক্ত, অথচ রাজ্যগুলির সাথে  কোনরকম আলোচনা ছাড়াই কেন্দ্রীয় সরকার নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করে তা কার্যকর করা শুরু করেছে।  প্রধান লক্ষ্য হলো হিন্দুত্বের প্রচার ও এদেশের শিক্ষার বাজারকে দেশি ও বিদেশী কর্পোরেট মালিকদের কাছে উন্মুক্ত করা। কৃষি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা ভাবে একের পর এক কৃষি আইন লাগু করার চেষ্টা করেছে। পরে অবশ্য নাছোড়বান্দা ঐতিহাসিক আন্দোলনের চাপে পড়ে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। একইভাবে শ্রম আইনের একের পর এক শ্রমিক বিরোধী সংস্কার হয়েছে, রাজ্যগুলির কোন মতামত ছাড়াই, যা আদৌ সংবিধানসম্মত নয়।

বিজেপি হল একটি হিন্দু আধিপত্যকামী দল যা পরিচালিত হয় ফ্যাসিস্ট সংগঠন আরএসএসের দ্বারা। এরা হিন্দুত্বের প্রচারে ও হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে দেশের আদিবাসী তফসিলি ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ আজ সামাজিক ন্যায় থেকে বঞ্চিত। বিজেপির এই কাজ দেশের সংবিধানে উল্লিখিত বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র ও সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এদের লক্ষ্য হল সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের স্তরে  নামিয়ে আনা। তাদের স্বাধীন ধর্মাচরণে বাধা দিয়ে, সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া। উত্তরপ্রদেশ সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে তাই হচ্ছে এখন। মধ্যযুগীয় বর্বরতায় হিন্দু মন্দিরে পিটিয়ে মারা হচ্ছে দলিত যুবককে। একথা মাথায় রাখতে হবে, আদতে এই হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা হল একচেটিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে কোন মানুষেরই অধিকার সুরক্ষিত  থাকবে না।  শুধু রাম মন্দির নয়, মথুরা চাই, কাশী চাই– ইত্যাদি দাবি উঠছে সঙ্ঘ পরিবারের মিছিলে। টার্গেট করা হয়েছে তাজমহল, কুতুব মিনার কেও। অথচ,  ভুখা পেটে খাবার চাই, সব গরিবের রেশন চাই, কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম চাই, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ও বাঁচার নিরাপত্তা চাই, বেকার যুবকের কাজ চাই, কলকারখানা শিল্প চাই, সরকারি ব্যবস্থায় শিক্ষা চাই-স্বাস্থ্য চাই– এই মৌলিক দাবি গুলোর কথা তারা বলে না, যা বলতে হয় আমাদের। যা নিয়ে লড়তে হয় আমাদেরই, হবেও আগামী দিনে। আর, সংবিধানকে রক্ষা করার মধ্য দিয়েই এই লড়াইকে জোরদার করবার জন্য, সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী। নিছক প্রসাধনিক প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন নয়, চাই সংবিধানের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের সব নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত করা।