সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের নামে বজ্জাতি শুরু হয়েছে আমাদের রাজ্যে। আমাদের রাজ্যে শান্তি, সংহতি ও সৌহার্দ্য বিঘ্নিত হতে হতে চরমসীমায় পৌঁছে গেল রিষড়া ,শিবপুর ও ডালখোলায়। এমন সীমায় পৌঁছালো, সরকারের উপর আস্থা হারিয়ে রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতকে কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর নির্দেশ দিতে হল রাজ্য সরকারকে। এটা রাজ্যের পক্ষে লজ্জার নাকি অপদার্থতার —  সে বিষয়ে রাজ্যের শাসক দল তথা সরকারের মাথাদের কোন উপলব্ধিই নেই। সাত দিনের ব্যবধানে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীকে কেন্দ্র করে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাস্তায় নেমেছে বামপন্থীরা। ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য সহ রাজ্যের শান্তি, সংহতি ও সৌহার্দ্যকে রক্ষা করার অঙ্গীকার নিয়ে বামপন্থী দলসমূহ হুগলিও হাওড়াতে শান্তি ও সম্প্রীতি মিছিল সংগঠিত করল। উদ্বেগের বিষয় হল যে , যে পুলিশ দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে ভয় পায় — তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকে, সেই পুলিশই ১০।৪।২৩ তারিখে হাওড়ায় বামপন্থীদের আয়োজিত শান্তিপূর্ণ মিছিলকে আটকাতে গিয়ে অতি সক্রিয়তা দেখালো এবং বামপন্থীদের শীর্ষস্থানীয় বয়স্ক নেতৃত্বকে আক্রমণ করতেও দ্বিধাবোধ করল না। আক্রান্ত হতে হল বিমান বসুর মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় বরিষ্ঠ নেতৃত্বকেও।

রিষড়া ,শিবপুর এবং ডালখোলাতে যে হাঙ্গামা হলো ,ধর্মীয় মিছিলের নামে যে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের তান্ডব চললো, তার পিছনে কাদের উস্কানি ছিল বা কাদের (বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বিজেপি-র মতো দল ) ঘোষিত এজেন্ডার বহিঃপ্রকাশ ঘটল– তার যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ না করে তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে রাজ্যের পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে রইল– দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করলো। কিন্তু প্রাথমিক পদক্ষেপ কিছু নিলেই তা অঙ্কুরেই শেষ করে দেওয়া যেত –এবং আমার বিশ্বাস রাজ্যের পুলিশের সে দক্ষতা যথেষ্ট রয়েছে — কিন্তু কাদের অঙ্গুলীহেলনে তারা স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল, সেই প্রশ্ন কিন্তু রাজ্যের আপামর সাধারণ মানুষের মনে আজ উদ্বেলিত হচ্ছে । এটা কাদের ব্যর্থতা –রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের নাকি শাসক দলের তথা তৃণমূল কংগ্রেসের বড় বড় মাথাদের ? সমগ্র পরিস্থিতির রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য এ কেমন ষড়যন্ত্র? তারাই বিভাজনের রাজনীতিকে ব্যবহার করে ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে–এই বিশ্বাস ক্রমশ পুষ্ট হচ্ছে রাজ্য বাসীর মনে।

প্রসঙ্গত অশোক মিত্র সম্পাদিত “আরেকরকম “পাক্ষিকের  ১ মে ২০১৭ সংখ্যার “সমসাময়িক” বিভাগে প্রকাশিত হয়েছিল রামনবমী বিষয়ক তাঁর লেখা,”আগ্রাসী রাম, সেবক হনুমান”।  এই লেখার কিছু অংশ উল্লেখ করছি, সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতায় আমাদের সচেতন করবে। তিনি লিখেছেন, “রামনবমীর খোলা তলোয়ার নেত্রীর হাতে এক দ্বি-ধারী তলোয়ার এনে দিয়েছে; একদিকে এই নগ্ন, উল্লসিত, বে-আইনি, এবং সর্বোপরি মানব- সভ্যতা বিরোধী ভীতি- প্রদর্শনকে প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না করা ,যাতে মুসলমানরা আরো সন্ত্রস্ত হয়ে উত্তরোত্তর তাঁর শরণে ,বা বলা ভালো তার বশবর্তী থাকেন । আর অন্যদিকে ইতিমধ্যে, মুসলমানদের বিষয়ে গৃহীত তাঁরই অপরিণামদর্শী নীতির কারণে উগ্র হিন্দুত্বের প্রভাবাধীন হয়ে পড়া  লোকেদের কাছে বার্তা দেওয়া, আমি তোমাদের-ই লোক। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, নেত্রী ভোট সংগ্রহে যত পারদর্শী-ই হোন না কেন ,তিনি শিক্ষা নিতে জানেন না। হিন্দুদের একাংশের মন পেতে অখিলেশ যাদব মুজঃফরনগরে মুসলমান জনসাধারণকে হন্তারকদের  সামনে অসহায়ভাবে পড়ে থাকতে দেখেও সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় রইলেন। তার ভাবটা ছিল, মুসলমানরা আর আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে? ওদের ভোটতো  পাবই, বি-জে-পি-র মুসলমান নিধনের এই সুযোগে হিন্দুদের কিছু ভোট যদি বাগিয়ে নেওয়া যায়, মন্দ কি ! তাঁর এই রাজনৈতিক অসততা এবং প্রশাসনিক দায়িত্বহীনতার  পরিণতি দেখেও বঙ্গ সম্রাজ্ঞী এক-ই পথ ধরেছেন।

মুশকিল হল, পরিণতির মূল্যতো রাজনীতিকদের চোকাতে হয় না ,সেটা দিতে হয় সাধারণ মানুষকে, যে মানুষ, দিনের একটা বিশেষ অবস্থায় হিন্দু বা মুসলমান, কিন্তু বাকি দিন জুড়ে খেটে খাওয়া ঘর্মস্রাবী জনতা। অনৈতিক রাজনীতির যে ছিদ্রপথটাকে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতা দখলের রাজপথ বানিয়ে ফেললো, কোনো রাখঢাক নেই , সেই একই পদ্ধতি প্রকরণের  ভেতর দিয়ে তারা বাংলার মানুষ এবং রাজনীতিকে পর্যুদস্ত করতে চায়। ধর্মীয় উন্মাদনার সাহায্যে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আরোহণের ইতিহাস তাদের পক্ষে। এ খেলায়, এবং এই খেলাতেই, তারা ওস্তাদ। কলকাতার রাজপথে রামনবমীর খোলা তলোয়ার নিয়ে তারা সেই  ইতিহাসের – ই পুনরাবৃত্তি করতে চায়। ক্ষমতার নেশায় চুর মুখ্যমন্ত্রী-র মস্তিষ্কে এই সহজ কথাটি সহজে প্রবেশ করবে, এটা দূরাশা।  কিন্তু তা বলে, অসভ্যতার নিদর্শন- প্রদর্শন গুলোকে বিনা বাধায় রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াতে দেওয়া চলে না।” “আজকে যখন পশ্চিমবাংলায় এ সব ঘটনা ঘটছে তখন বামপন্থীরা  মানুষকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব নিয়ে রাস্তায় নেমেছে।

বর্তমান সময়ে ধর্মীয় সমাবেশ ও অনুষ্ঠানের ধরন ও কৌশল এবং আধুনিকতা তীব্রমাত্রায় পাল্টেছে। ধর্মীয় মিছিল তথা সমাবেশে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের আমদানি উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েছে ও বাড়ছে। আমরা ছোটবেলায় রামনবমী, ভীম পুজো সহ নানান গ্রামীণ ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠান দেখেছি, দেখেছি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা- প্রাণচাঞ্চল্য এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ। সেই সকল অনুষ্ঠানে কোন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ,অস্ত্রের ঝলকানি তথা পিস্তল নাচানো আর ডি জে বক্সের চটুল গানের দাপাদাপিও ছিল না, যেটা আজ বড় বেশি করে চোখে পড়ছে এবং আমাদের শুভ বুদ্ধিকে ক্রমাগত আহত করে তুলছে। তবে তখন এত হনুমান পুজোর আয়োজন ছিল না। এটা আমদানি হয়েছে ধর্মীয় রেষারেষি থেকে। আসলে একপক্ষের ক্ষমতা দখলের নেশা আর ক্ষমতাসীনদের তা ধরে রাখার বাসনায় ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা তথা দ্রব্যমূল্যের অগ্নিমূল্য, বেকারীর উদ্বেগজনক বৃদ্ধি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ইত্যাদিকে মানুষের মন থেকে ভুলিয়ে দেবার অপচেষ্টা করে চলেছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পৃথিবীতে দেশ দখলের লড়াইয়ে যত যুদ্ধ হয়েছে, তাদের যত মানুষজনের মৃত্যু হয়েছে, তার থেকে বেশি বেশি প্রাণ বলি গেছে ধর্মযুদ্ধে। আর এই যুদ্ধে প্রাণ গেছে গরিব বস্তিবাসী, খেটে খাওয়ার শ্রমজীবী মানুষজনের। কখনো আক্রান্ত হতে হয়নি কোন ধনিক শ্রেণীর কিংবা উপরতলার মানুষদের। তাঁদের গায়ে কোন আঁচর লাগে না — তা তারা হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বা যেকোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হোক না কেন !

ধর্ম তো পরম সহিষ্ণুতা শেখায়, অন্ধ বিশ্বাস থেকেই মানুষ তার কল্যাণে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করে থাকেন। ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসব সবার। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমরা সাধারণ মানুষেরা বুঝি, যে যার ধর্ম তথা ধর্মীয় আচার -অনুষ্ঠান পালন করবেন, কিন্তু অন্য কোন ধর্মের উপর কেউ কোন আঘাত করবেন না। শান্তিপূর্ণভাবে তা পালিত হবে। কারণ, কোন ধর্মেই হিংসার কথা, অন্য ধর্মের উপর আঘাতের কথা বলা নেই। এ প্রসঙ্গে পৃথিবীবিখ্যাত  কয়েকজন দার্শনিক, কবি, বিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট মনীষীগণের অমূল্য বক্তব্য আমাদের পাথেয় হওয়া উচিত। যেমন, লেলিন বলিয়াছেন-, “ধর্মীয় কুসংস্কারের গভীরতম উৎস হল দারিদ্র ও অজ্ঞতা, এগুলিকে আমাদের পরাস্ত করতে হবে।” আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিনি তার সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে তিনি লিখছেন, “ধর্মের বিকারেই গ্রীস মরিয়াছে, ধর্মের বিকারেই রোম লুপ্ত হইয়াছে এবং আমাদের দুর্গতির কারণ ধর্মের মধ্যে ছাড়া আর কোথাও নাই। “উনি আরো লিখছেন, “ধর্ম কারার প্রাচীরে বজ্র হানো। এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো। বিজ্ঞান সাধনায় রত আইনস্টাইন বলেছেন,” একটি পরমাণুর চেয়ে একটি কুসংস্কার ভাঙ্গা আরো কঠিন। “সেনেকা  বলছেন, “সাধারণ মানুষের কাছে ধর্ম সত্য বলে বিবেচিত, জ্ঞানীর কাছে মিথ্যা আর শাসকগোষ্ঠীর  কাছে ফায়দা লুটবার হাতিয়ার।” ঠিকই আজকের দিনে উপরোক্ত কথাগুলো মিলে যাচ্ছে।

বিস্ময় জাগে, শিবপুরে রামনবমীর মিছিলে যে যুবক পিস্তল হাতে ঘুরছিল, সম্প্রতি সেই যুবক বিহারের মুঙ্গের থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে। সেই যুবকের আসল পরিচয় কী!সে অস্ত্র নিয়ে মিছিলে কি করছিল কিংবা মিছিলের আয়োজকরা তার অনুমোদন করলেন কেন ? মিছিলে প্রকাশ্যে সেটা দেখা সত্তেও পুলিশ তা বাজেয়াপ্ত ও তাকে গ্রেফতার করলেন না কেন। কেনই বা তাকে বিহার থেকে পরে গ্রেফতার করতে হলো ? রাজ্যবাসী তা জানতে চায়।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দির উদ্বোধন, কিংবা ক্যামেরার সামনে বিভিন্ন পোজ দিয়ে রাষ্ট্রনায়কদের মন্দিরে পূজো দেওয়া, মসজিদে নমাজ পড়া কিংবা গুরুদ্বারে ঝাঁটা হাতে কর সেবা করার মত ধর্মীয় অনুষ্ঠান অবিলম্বে বন্ধ করে স্ব-স্ব ধর্মীয় আচার পালনে সাধারণ মানুষদের অবাধ স্বাধীন এবং ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য উদ্গীরণ থেকে নেতাদের সংযত রাখা হোক– এই দাবিতে বামপন্থীদের লড়াই আন্দোলন আরও তীব্র করতে হবে। কারণ বামপন্থীরাই পারে ধর্মীয় বিভাজন রুখে দিয়ে অন্ধ কুসংস্কারমুক্ত হয়ে সর্বাঙ্গীন সুন্দর এবং যথার্থ মুক্তমনা সমাজ গড়ে তুলতে। তাই ধর্ম — ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের উপর যতই রাষ্ট্রীয় আক্রমণ নেমে আসুক পিছিয়ে পড়লে বা থেমে থাকলে চলবে না। এগিয়ে আমাদেরই যেতে হবে। ঠিক যেমন ভাবে পুলিশের যাবতীয় বাধাকে উপেক্ষা করে শিবপুরের মিছিল শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করেছে। মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই-ই পারে সাম্প্রদায়িকতার বিষ দাঁত ভেঙে দিতে।