১৯১৭ সালে রাশিয়ার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জার শাসনের অবসান ঘটল ও বিশ্বে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলল বলশেভিকরা। এই রাষ্ট্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হল -যা ছিল তাদের বিপ্লবী লক্ষ্য।

১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে জারশাসিত রাশিয়া ছিল শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী পশ্চাৎ পদ, ফলে আধুনিক শিল্প ও শিল্প শ্রমিক ছিল নগন্য।

রাশিয়াতে এই পর্বে যারা প্রকাশ্য শ্রমে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন কৃষিকাজে যুক্ত। নারী শিল্প শ্রমিক ছিল কম। শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনে মহিলাদের যোগদান অনেক পরে হয়। তবে শ্রমজীবী নারীদের সংগঠন ও আন্দোলনের অনেকটা আগেই রাশিয়ার অভিজাত নারীদের মানবতাবাদী নানা সংগঠনের জন্ম হয়েছিল।

রাশিয়ায় মহিলা জনসংখ্যার একটা বড় অংশই ছিল গ্রামীণ নারী, যারা মূলত কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন। কৃষক
রমণীরা ছিলেন নিরক্ষর। বিপ্লবের পূর্বে শ্রেণী বিভক্ত রাশিয়ান সমাজে এই কৃষক রমণীদের কোনও ভোটাধিকার ছিলনা এমন কি নারীদের শিক্ষা, ন্যায় ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনও অধিকার ছিলনা ।

ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে এক বিশাল সংখ্যার কৃষক রমণীরা গ্রাম থেকে স্থানান্তরিত হয়ে শহরে গৃহ ভিত্তিক শ্রম ও কারখানার কাজে যুক্ত হন। এই প্রথম কর্মরত শ্রমজীবী মহিলারা গ্রামীণ পিতৃতান্ত্রিক প্রথার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আস্বাদ উপভোগ করেন।

১৮৬০-৭০ এই সময়কালে উল্লেখযোগ্য অংশের মহিলারা ক্রমবর্ধমান বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হন। এদের মধ্যে বেশ কিছু মহিলা অভিজাত ও আমলাতান্ত্রিক পরিবার থেকে আসা, যারা মহিলাদের নিয়ে পাঠচক্র শুরু করেন যাদের লক্ষ্য ছিল সামাজিক ন্যায় ও রাজনৈতিক পরিবর্তন। নারীদের ভোটাধিকার, ন্যায় ও শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে মহিলাদের মধ্যে বিপ্লবী মানসিকতার বিকাশ ঘটে। কিন্তু তৎকালীন জার শাসকেরা শত শত নারী ও পুরুষ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে। এই সময়ে নানা অহিংস ও সশস্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। ঊনিশ শতকে বেশ কিছু বিপ্লবী নারীর পরিচয় আমরা পাই। ভারা জাসুলিন,মারিয়া স্পিরিডোনোভা, ভেরা ফিল্টার ইত্যাদি।


এই সময়কালে রাশিয়ায় সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সংগঠনের উত্থান, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবী মহিলাদের আকৃষ্ট করেছিল। মহিলাদের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,,শহরাঞ্চলের শ্রমিক দের মধ্যে সোশ্যালডেমোক্রেটিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে ভূমিকা নিয়েছিল, যারা অনেকেই পরবর্তী সময়ে বলশেভিক পার্টির নেত্রী হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন নাদেজদা ক্রুপস্কায়া । যিনি মহিলা এবং শিক্ষার ইস্যুতে অক্লান্ত সৈনিক ছিলেন। ১৮৯৮ সালে মহামতি লেনিনের সাথে ওনার বিবাহ হয়। ইনি ছিলেন বলশেভিক পার্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী। রাশিয়ার বুকে মহিলাদের গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা। ১৯০৫ সালে নারীর অধিকারের প্রশ্নে equal rights union গড়ে ওঠে, যার নেতৃত্বে ছিলেন আনা সিলিকিউভা ও আরিয়াদানা টাইরকোভা। ১৯টি শহরের প্রায় ৭০জন মহিলা প্রতিনিধি মস্কোতে অনুষ্ঠিত প্রথম সাংগঠনিক কংগ্রেসে যোগদান করেন। সেখানে তাঁরা দাবী করেন প্রজাতন্ত্রী সংবিধান এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের ভোটাধিকার। ১৯০৫ সালের অক্টোবর মাসে পুলিশের গুলিতে নিহত এক বলশেভিকের মৃতদেহ নিয়ে মিছিলের সময় জার পুলিশের গুলিতে একজন নারী নিহত হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জার শাসকদের অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে মহিলারা তীব্র বিক্ষোভ গড়ে তোলেন।এইভাবেই প্রাথমিক দিকে রাশিয়ার বুকে নারীবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে নারীদের অধিকারের বিষয়কে সামনে রেখে। এই সময়ে রাশিয়া সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মহিলাদের ভোটাধিকার নিয়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে। কিন্তু এই আন্দোলন মূলত সীমাবদ্ধ ছিল অভিজাত পরিবারের মহিলাদের মধ্যে।

প্রখ্যাত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক নেত্রীদ্বয় ক্লারা জেটকিন ও রোজা লুক্সেমবার্গ অনুভব করেছিলেন শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নারীদের বিশেষত শ্রমজীবী নারীদের নিজস্ব অধিকারের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯০৭ সালে ষ্টুটগার্ডে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী নারীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন বলেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সমগ্র নারীসমাজের অধিকারের প্রশ্নটি শুধুমাত্র শ্রমজীবী নারীদের বিষয় নয় সমগ্র নারীসমাজের বিষয়।

কনকোরডিয়া সামোলিভা, আলেকজান্দ্রা কলোনতাই সহ অসংখ্য বলশেভিক নারীরা ১৯০৭ সালে রাশিয়ার বুকে “working women’s mutual assistance center”;গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী নারীদের সমাজতন্ত্রী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে এবং সমাজতন্ত্রী ভাবনা ও আদর্শের বিকাশ ঘটতে থাকে।

শ্রমজীবী নারীদের, সংগঠিত শ্রমিক সংগঠনে যুক্ত করতে উৎসাহিত করে তোলে। নারী সংগ্রামী ধারাতে প্রবাহিত করার জন্য তাদের সাথে সাংগঠনিক ও মতাদর্শগত পথের অংশীদার করেছিল। তাদের বোঝানো হয় যে সংগঠিত সমাজতন্ত্রী আন্দোলন কখনোই মহিলাদের বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করতে পারেনা।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস- ১৯১০ সালে রাশিয়ার বুকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগের বছরে অর্থাৎ ১৯১৩ সালে এই দিবসটি পালিত হয়।

লেনিন সক্রিয় ভাবে রাশিয়ার বুকে শ্রমজীবী মহিলাদের প্রচার আন্দোলন ও তাদের সংগঠিত করার ব্যাপারেবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। তাঁর উৎসাহে ১৯১৪ সালে “Robotnista;( The working women) পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার সার্কুলেশন ছিল এই পত্রিকাটির। ইননেসা আরমান্দ ও নাদেজদা ক্রুপস্কায়া ছিলেন এডিটোরিয়াল বোর্ডে।


Nadezhda Krupskaya

এই সময়কালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে মহিলাদের মধ্যে শ্রেণী বিভাজন স্পষ্ট হয়। বুর্জোয়া নারীবাদীআন্দোলন এই যুদ্ধ কে সমর্থন জানায় অপরদিকে শ্রমজীবী নারীরা বলশেভিক বোনেদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সম্পূর্ণরূপে এই যুদ্ধের বিরোধিতা করেন।

১৯১৭ সালে রাশিয়ার নারীরা রুটি ও শান্তির দাবীতে ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার অর্থাৎ রাশিয়ার ক্যালেন্ডার অনুসারে দিনটি ছিল ২৩শে ফেব্রুয়ারি। যদিও ইউরোপে প্রচলিত গ্রিগেরিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে দিনটি ছিল ৮

ই মার্চ। ১৯১৭ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি মহিলাদের ধর্মঘট ও বিশাল বিশাল জমায়েতের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হল রাশিয়ার বুকে। বলশেভিক পার্টির মুখপত্র প্রাভদায় মহিলাদের এই

আন্দোলনের কথা লেখা হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯১৭ সাল নারী দিবস পালনের চার দিন পর ঐতিহাসিক ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সংঘটিত হয়। অনমনীয় ও সাহসিক লড়াই এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার জার সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জারের অপসারণের পর নতুন সরকারের দ্বারা নারীর ভোটাধিকার অনুমোদিত হয়। রাশিয়ায় আরেক ধারা নারী আন্দোলনের বিষয় সামনে আসে যা মূলত প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া নারীদের দ্বারা সংঘঠিত

হয়েছিল। এরা জারের শীতকালীন প্রাসাদকে বলশেভিক দের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই ভূমিকা নেয়।

এর পরবর্তী ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে রাশিয়ার বিপ্লবী কর্মকান্ডে মহিলাদের গৌরবজ্জ্বল ভূমিকার কথা। বিপ্লব চলাকালীন ও পরবর্তীকালে অসংখ্য মহিলারা লাল ফৌজে অংশ নেন। বিপ্লবের প্রথম দিন থেকেই মহিলারা এই বিপ্লবী কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশ গ্রহণ করেন। অবশেষে দুনিয়া কাঁপানো দশটা দিন যা সারা বিশ্বে আজও আলোড়িত করে সব সমাজতন্ত্রীদের ও বিপ্লবীদের। এই দশ দিনের লড়াইয়ে মহিলাদের ভূমিকা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। রাশিয়ান বিপ্লবে মহিলাদের ভূমিকা নিয়ে লেনিন, ক্লারা জেটকিনের সাথে আলোচনায় বলেন ;Women workers acted splendidly during the revolution. Without them we should not have been victorious.

                Clara Zetkin

রাশিয়ান বিপ্লবের পর নতুন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক দেশ নারীদের প্রশ্নে নানা আইন বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রণয়ন করে, এর মধ্যে প্রথমেই বিবাহ ও পরিবার সংক্রান্ত আইনে মহিলাদের সম অধিকারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন।

বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নারীমুক্তি বাস্তবায়নে প্রকৃতপক্ষে শোষন ভিত্তিক সমাজের পরিবর্ত ছাড়া সম্ভব নয় কারণ হিসেবে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস নারীমুক্তি প্রসঙ্গে খুব স্পষ্ট ভাবেই উল্লেখ করেন সমাজ বিপ্লবের ধারণার সাথে নারীমুক্তির অচ্ছেদ্যতা প্রমাণিত হয় কারণ শোষণ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাই নারীদের জীবনে দুর্দশার মূল কারণ। সুতরাং শোষণ ভিত্তিক সমাজের পরিবর্তন ছাড়া নারীমুক্তি সম্ভব নয়। এই কাজ বাস্তবে রূপ পেল লেনিনের নেতৃত্বে । যে বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নারীপুরুষের বৈষম্যের অবসান ঘটালো। তাই বিশ্বের দরবারে নারীর সম্মান, মর্যাদা,অধিকার সর্বোপরি নারীমুক্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য আজও বহমান।

কবির ভাষায় বলতে গেলে বলাই যায়- বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, অর্ধেক তার করিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। সারা বিশ্বে আলোড়িত নভেম্বর বিপ্লব যার মধ্য দিয়ে শ্রেণীহীন, বৈষম্যহীন এক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠল এবং প্রকৃতপক্ষে নারীসমাজ সর্বপ্রথম নারীমুক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করল। তাই বিশ্বের যেখানেই নারীর অধিকারের লড়াই সংঘটিত হয় সেখানেই মহান নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা সমান ভাবে বিদ্যমান।