০৩১-Induction

এক চাষী হাঁসদের খেতে দেয়। প্রথম প্রথম হাঁসগুলো দূরত্ব রাখত। চাষী সরে গেলে খেত। রোজ খেতে দিতে দিতে হাঁসেরা কাছে আসতে শুরু করল। এমন ভাবে কয়েক মাস বাদে নির্দিষ্ট সময়ে হাঁসগুলো নিজেরাই চাষীর কাছে চলে আসত। একে বলে Inductive thinking। অনুষ্ঠান পার্বণে বন্ধুদের নিমন্ত্রন্ন করে হাঁস ধরে চাষী জবাই করল। হাঁসরা এই অভব্যতার জন্য প্রস্তুত ছিল না। Inductive thinkingএর শিকার বেশী হয় নাবালিকারা। Inductive thinking আমাদের জীবনে বহুবার অগোচরে আঘাত করে।

সরকার আমাদের ভাল করে, এটাও Inductive thinking। পাঠ্যপুস্তকে এইভাবেই সরকারের প্রতিচ্ছবি আঁকা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবসায়ীর ছবিতে Inductive thinkingএ বাধ্য করে। জন্মদিন রবীন্দ্রনাথের, ছবি মুখ্যমন্ত্রীর। কিংবা ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস ঘর ঘর পতাকা দিয়ে মোদী দিবস হয়ে গেছে। আমরা ভাবি না, পূজো অনুদানের অর্থে রাজ্য সরকারের সাড়ে ছ হাজার শূণ্য পদ পূরণ সম্ভব ছিল। নেত্রী আদিবাসী দেখলে নেচে ওঠেন, অথচ মিডডে মিল থেকে ডিম সরে গেছে।

Inductive thinking প্রেমের ব্যাপারে বহুল প্রচলিত। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে ৮ মিনিট লাগে। অর্থাৎ আমরা সব সময়ে ৮ মিনিট আগের সূর্যকে দেখি। কারো প্রেম হয়তে ৮ আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে। প্রেমিক তখনও চোখে প্রেম দেখছে, কিন্তু প্রেমিকা ৮ বছর আগে অন্যত্র মন দিয়ে বসে আছে। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন তাই বলেছিলেন, বিশ্বে নিত্য বলতে দুটি জিনিস, এক মৃত্যু ও দুই ট্যাক্স। বাস্তবকে মন সর্বদা মেনে নিতে পারে না। ফলে আশায় মরে চাষা, Inductive thinkingএ দিবস কাটে।

আমরা বিভিন্ন সম্পর্কে Inductive thinkingএ ভুগি। রাজনৈতিক দল এমনভাবে Inductive thinking দিয়ে সমর্থকদের গ্রাস করে যে দূর্নীতির চোরাবালিতে সমূহ অপমানকে উপেক্ষা করতে দ্বিধা করে না। আজও যারা টেলি-সংগ্রামে দূর্নীতির সপক্ষে কথা বলছে, তাদের মানুষ ঘৃণা করছে, সেটুকু Inductive thinkingএর ফলে বিশ্বাস করতে পারছে না। নেত্রী যতই রোজ হাঁসকে ডেকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের ৫০০ টাকা অনুদান দিক, চাষীর হাঁসের মত অবস্হা হবে, নয়ত চাষী হাঁস বা নেত্রী ভোট পুষবেন কেন?

০৩২-Loss Aversion

বেড়াতে যেতে ভাল লাগে, প্রমোশনে আনন্দ পান, শত্রুর বিপর্যয় খুশী করে- কিন্তু এসব জীবনের কটা দিন? সবটাই দূরারোগ্য ব্যাধির ভীতি, সন্তানের ভবিষ্যৎ, যুদ্ধাশঙ্কা, আয়ের স্বল্পতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বন্ধু ক্ষয়, সম্মানহানী, চুরি-ডাকাতি, ঠকে যাওয়া থেকে মৃত্যুর মত হাজার শঙ্কা। ক্ষতির প্রতি বিতৃষ্ণা তথা Loss Aversionএর জন্য মানুষ ১০০টাকা লাভে যত আনন্দ না পায়, তারচেয়ে ১০০টাকা ক্ষতি হলে দুঃখে বিগলিত হয় অনেক বেশী। পৃথিবীর প্রতিটি জীব ভীতির পরিমন্ডলে বাঁচাটা ভবিতব্য মেনে নেয়।

Loss Aversionএর ফলে যেহেতু মানুষ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে চায়, তার জন্য অনুব্রত মন্ডল, পার্থ চ্যাটার্জী থেকে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ধমকে চমকে রাজত্ব কায়েম করেন। প্রাচীণ বা মধ্য যুগে একটি ভুল মানে মৃত্যু। পশুর আক্রমণ বা অন্য গোষ্ঠী কিংবা নিজ গোষ্ঠী থেকে বিতারণে মৃত্যু ছাড়া পথ ছিল না। যারা তার ভিতর বেঁচে ছিল, আমরা তাদের বংশধর। আমাদের জিনে সেই বাঁচার তাগিদ যেমন আছে, ঠিক তেমনই মৃত্যুভয়ও। তাহলে এত ঈশ্বরের চাষ করে কী হল? ওটাও অশিক্ষা গাছের মৃত্যুভয় ফল।

আপনি চোখের সামনে দেখছেন, পঞ্চায়েত প্রধানের সাত মহলা প্রাসাদ হল, তবু Loss Aversionএর ফলে ক্ষতির আশঙ্কায় আপনি জোড়াফুলে ছাপ দিয়ে আসছেন বা আসতে বাধ্য হচ্ছেন। আপনি বিশ্বাস করেন, শাসক দলের সব নেতা চোর, কিন্তু ওরা যখন বলছে, চোপ, সবাইকে চোর বলা যাবে না, তখন চুপ করে যাচ্ছেন। আপনি জেনেছেন, রামমন্দির বানিয়ে ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যের পতন রোধ করা যাবে না, কিন্তু যোগীর অত্যাচারের ভয়ে তটস্হ। ঈশ্বরের ক্ষমতা নেই আপনাকে বাঁচাবার।

পৃথিবীর সব শাসক Loss Aversionএর ফায়দা তুলেছে চোখ রাঙিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী কার্নিভালে মহা আনন্দ করবেন, তারজন্য আপনার করের টাকায় খয়রাতি করতে হবে। আপনার ডিএ হবে না, সন্তানের কর্ম-সংস্হান হবে না, রাস্তাঘাটের মেরামতি নেই। নয়ত, একটা ভুলের জন্য বেমালুম লাশ হয়ে যাবেন অথবা গাঁজা কেসে জেলের কুঠুরিতে। দিল্লী থেকে আরবান নক্সালাইট বলে জেলের ভিতরে খুন করবে নিঃশব্দে। Loss Aversion থাকবে, তার মধ্য থেকেও ঐতিহাসিক প্রতিবাদ ভেসে ওঠে নয়া বিপ্লবে।

০৩৩-Social Loafing

বহুশ্রুত গল্প। রাজা পুষ্করিনী খনন করে সব রাজ্যবাসীকে এক ঘটি দুধ ঢালতে বলেছিলেন। তাহলে দুধপুকুর হবে। প্রজারা কী করেছিল? সবাই জল ঢেলে ভেবেছিল, বাকিরা তো দুধ ঢালবে। চালাকিটা ধরা পড়বে না। সেই রাজ্যের প্রজারা Social Loafing জানত না। আজও মানুষ জানে না। শাসকদল দূর্নীতি করছে। হোঁৎকাবাবু রুষ্ট, কিন্তু বিপক্ষে ভোট দিলে যদি কেষ্ট গাঁজা কেসে ঢুকিয়ে দেয়? নিশ্চই কোঁৎকারা সাহস করে বিপক্ষে ভোট দেবে। হোঁৎকা কেষ্টকে ভোট দিয়ে এসে দেখে সব ভোট কেষ্টর।

এক ফরাসী প্রযুক্তিবিদ ১৯১৩সালে পরীক্ষা করে দেখেন, একজন ব্যক্তিকে দড়ি টানতে দিলে সে তার ৯৩% শক্তি উজার করে টানে। ৩জনকে টানতে বললে প্রত্যেকে গড়ে ৮৫% বলপ্রয়োগ করে, ৮জনের গ্রুপ হলে ৪৯%। এবার ভেবে দেখুন দেশটা কত বড়, ফলে দেশের রশিতে টান পড়লে আচ্ছে দিনে কোন দিন পৌঁছাবে না। আমরা জাপানীদের আগ্রগতি ও দেশের উন্নয়নে অংশীদারিত্বের আকাঙ্খা দেখে চমকে উঠি। এটা ওদের স্বদেশপ্রেম। আমরা দেশপ্রেম দেখাতে ঘর ঘর পতাকা উড়িয়ে বিজ্ঞাপন দিই।

Social Loafingএর সমস্যা থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে বহু অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের মত নেওয়া যায়, তেমন ব্যক্তি আমাদের দেশে আছে। কিন্তু রাষ্ট্র বলুন বা রাজ্য, যাদের হাতে শাসন, তাদের সেই শিক্ষা আছে? প্রধানমন্ত্রী বলেন উষ্ণায়ন হয়নি, আমাদের সহ্য ক্ষমতা বয়সের সাথে কমছে। থালি বাজিয়ে করোনা দূর হয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার, ব্যারিষ্টার, ডক্টরেট, কবি, শিল্পী, গায়িকা, গীতিকার, সুরকার, খেলোয়াড়। আমাদের শিক্ষিত লোকের প্রয়োজন ছিল, এত বড় খেলোয়াড়ের দরকার নেই।

হোঁৎকা চিরকাল ভাববে, কোঁৎকার ছেলে প্রতিবাদ করে গাঁজা কেসে জেলে যাক, সুফল হোঁৎকা খাবে। Social Loafingএর ফলে কোঁৎকাও তাই ভাবে। একাকী মানুষ আর দলবদ্ধ মানুষ এক নয়। ছিঁচকে চোর দেখলে যে হোঁৎকা খাটের তলায় লুকিয়ে যায়, কোঁৎকার সাথে থাকলে ডাকাতকে পেছন থেকে ঘুষি মেরে দেয়। চোর শাসকের চেয়ে বড় গণশত্রু এই হোঁৎকা আর কোঁৎকা। সমাজের ভিড়ে মানুষের মুখোশ পরে ধান্দাবাজীতে ঘোরে। এদের কোন দিন উন্নয়ন হয় না, উন্নয়নের পথে বিশাল বড় অন্তরায়।