০৬৪-Forer Effect

ফেসবুকে যাঁরা আমার লেখা পড়েন, প্রত্যেককে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। সবাই আপনার সারল্যের সুযোগ নেন। মানুষের পাশে দাঁড়াতে ভালবাসেন, কিন্তু প্রতিদানে অনেকের কপটতা আপনাকে বিষ্মিত করে। আপনি আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করতে খুব ভালবাসেন। ভ্রমণে উৎসাহী, প্রকৃতি আপনাকে ভীষণ টানে। ছোটবেলায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় আপনার প্রতিভার সম্পূর্ণ স্ফূরণ হয়নি। নিজেকে জাহির করতে চান না। বিরপীত লিঙ্গের মানুষ আপনার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে কোনদিন অর্থের কষ্ট হবে না।

মেসেঞ্জারে বা ফোনে আমাকে জানাবেন, চেনার ব্যাপারে ১০এ কত দেবেন? Bertram Forer নামক এক মনস্তাত্বিক পরীক্ষা করে গড়ে ৮এর বেশী পেয়েছেন। আমি আপনাকে যা বললাম, আপনার আত্ম-মূল্যায়ণ। সেখানে কোন নেতিবাচক কথা নেই, সান্ত্বনা আছে। আপনি সবার সাথে ভাল ব্যবহার করেন কিন্তু কেউ ক্ষতি করলে কখনও কড়া জবাব দেন। কখনও কড়া জবাব দেন, সর্বদা পারেন তেমন নয়। অনেক ধর্ম-ব্যবসায়ী, জ্যোতিষী, হস্তরেখাবিদ, কাকাতুয়া পার্টি এই সহজ উপায়ে মানুষ ঠকিয়ে থাকে।

ফুটপাথে বসা এক হস্তরেখাবিদ যা পারেন, মমতা-মোদীর তা বাঁ হাতের খেলা। মমতা জানেন, সাধারণ মেরুদন্ডহীন যুব সমাজ এক দশক ক্লাবের চুল্লুভাতায় নেশা করে কারখানা, শিল্প, চাকরি এসব ভুলে গেছে। আপনারা যা নিয়ে হাসছেন, সেই মাগনা কচুরিপানা, কাশফুল, ড্রাগনফল, একটা চেয়ার টেবিল নিয়ে চায়ের সাথে বিস্কুট, মাকে দিয়ে ঘুগনী এসব টোটকা তাদের জন্য। যারা সত্যি লেখাপড়া শিখেছে তারা ভিন রাজ্য বা ভিন দেশে চলে যাবে। ভোট দেবার জন্য পড়ে থাকবে এই আহম্মকদের চপ-স্বপ্ন।

মোদী হুঙ্কারে প্রশ্ন ছোঁড়েন, দেশকে লিয়ে বলিদান দেঙ্গে কেয়া নেহিঁ? গাঁজার ছিলিম নামিয়ে হোঁৎকা চিৎকার করে, হাঁ। দেশ বলতে বোঝে বোন্দেমাত্রম, ভোটে বোম চার্জ, ফাঁকা পেলে পেঁচিকে বলাৎকার। মেরুদন্ড ভেঙে খোদার খাসী করে দিয়েছে। ওর মায়ের ক্যান্সারের ওষুধে জিএসটি আকাশ ছোঁয়া, মা খতরে মে নেহি, হিন্দু খতরে মে হ্যাঁয়। নবান্ন অভিযানে গেরুয়া নেতারা সর্বত্র বসে পড়েছে, চামচারা ঝাঁপিয়েছে। ওরা এত রোগা যে এক্স-রে করার দরকার নেই, নেতারা হার্ট, ফুসফুস সব দেখতে পাচ্ছে।  

০৬৫-Volunteer’s Folly

ঋষ্যশৃঙ্গবাবু সকালে লেখার টেবিলে বসেন। এখন প্রবল রৌদ্রতাপ, ঘরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র। খান কতক পূজো সংখ্যায় হাত দিয়েছেন। দিনে আয় গড়ে হাজার চারেক। গরীবের দুর্বহ যন্ত্রণার ভাষা দেন। তাঁর এক বাল্যবন্ধুর ফোন। আগামী রবিবার অনাথশালার নতুন ঘরটা সেলিব্রিটিরা নিজেরা চিত্রায়িত করবেন। চলে আয়। একজন রঙের মিস্ত্রীকে ৫০০টাকা দিলে সেই কাজ করা যায়, তারজন্য দৈনিক রোজগারে ঘাটতি! ঋষ্যশৃঙ্গবাবু না গিয়ে সেদিনের রোজগার দান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি গেলেন।

একে বলে Volunteer’s Folly। যখন তিনি শুনলেন জনসমাগম হবে, তাঁর পরিচিতি বাড়বে এবং বহু মান্যগণ্য লোকের সাথে পরিচয় হবার সুযোগ আছ, ঋষ্যশৃঙ্গবাবু গেলেন। কোন এক দশরথবাবুর স্ত্রীর সাথে আলাপচারিতাও হতে পারে। তাঁর Volunteer’s Folly বোঝাল, এমন সুযোগ ছাড়তে নেই হে। আজকের অনেক প্রতিষ্ঠিত সুশীল এইভাবে এক পা দু পা করে পথে নেমেছেন। মিডিয়া কভারেজে তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বেড়েছে। বিয়ে বাড়ি থেকে প্রতিবাদ সভা সবেতেই Volunteer’s Folly আছে।

নামিবিয়া থেকে আটটা চিতা আমাদের দেশে এসেছে। তাদের বনে ছাড়ার জন্য বনদপ্তরের আধিকারিক আছেন, কর্মীরা আছেন। তাহলে বিচিত্র বিমানে আনতে হল কেন, কেন প্রধানমন্ত্রীকে সেখানে ক্যামেরা হাতে উপস্হিত হতে হল? এটাও Volunteer’s Folly। মানুষ প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ সম্পর্কে অবহিত হবে। জ্বালানির দাম কমল কিনা, বেকার সংখ্যা হ্রাস হল কিনা, আয়করে ছাড় বাড়ল কিনা, এসব সম্পর্কে অবহিত করার নেই বলে চিতা। কিংবা সমুদ্র সৈকতে প্লাস্টিকের বোতল ফেলে স্বচ্ছ্ব ভারতের পোজ।

বাংলায় দুর্গোৎসব দীর্ঘজীবি । ভাবুন তো ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা ভাসানে কার্নিভালের নামে নাচতে গেছেন। ব্যক্তত্বটাই হেরিটেজ। মুখ্যমন্ত্রীর বহু কাজ থাকে। সিদ্ধার্থশঙ্কর নিজে খেলতেন বলে ইডেনে যেতেন, বুদ্ধদেববাবু নন্দনে। Volunteer’s Folly মমতাকে বসতে দেয় না। তা ইডেনে শাহরুখের সাথে ড্যান্স হোক, বইমেলা, চলচ্চিত্র উৎসব থেকে গান স্যালুট। যেখানে যা কুড়িয়ে পাওয়া যায়। আমরা ঋষ্যশৃঙ্গবাবুদের অনাথশালা রঙ করতে দেখি, ঢঙ করতে নয়।

০৬৬-Affect Heuristic

বিবর্তনের আদি যুগে ক্ষিপ্রতা জীবন যুদ্ধের অস্ত্র ছিল। যারা ক্ষিপ্র ছিল, তারা বেঁচেছে, অর্থাৎ আমরা বেঁচে যাওয়া মানুষের বংশধর। আজও মস্তিষ্কের গঠনে সেই অনুভূতি কেন্দ্রীক ক্ষিপ্রতা বিদ্যমান। কোন বিষয়ে যুক্তি গ্রাহ্য দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে চটজলদি সিদ্ধান্তকে বলা হয় Heuristic। পাগলা ষাঁড়ে তাড়া করলে বিশ্বকোষে প্রতিকার খোঁজে না কেউ আবার সহজ বিষয়েও কেবল আবেগের দাস হয়ে যায় মানুষ। Affect Heuristic সব মানুষের ভিতর কম বেশী আছে। যুক্তি একটি কঠোর অনুশীলনের বিষয়।

Affect Heuristic কী বুঝতে হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে মাইক ধরিয়ে দিন। আড়াই হাজার কেজির বাচ্চা থেকে, গান্ধীকে রবীন্দ্রনাথের লেবুজল হয়ে মাকে বলে ঘুগনি বানিয়ে পথে বসিয়ে দেবেন। মমতা Affect Heuristic শোনার মত ক্রীতদাসের দল পুষেছেন। ক্রীতদাসরা জানে বোকা মানুষ যত হাসবে সেই ফাঁকে বাংলার কয়লা, বালি, মাটি, পাথর, গরু সব পাচার করে দেব। ফলের কথা চিন্তা না করে সুযোগ সদ্ব্যবহারে আবেগের বশে চুরি করে যাচ্ছে। এখন আদালতে কান্নার শুরু, আমি মরে যাব।

Affect Heuristic না থাকলে অনেক কাজ হত না। মাতাল যেমন অনেক দুরূহ ও দুর্বোধ্য কাজ করে ফেলতে পারে তেমন মস্তিষ্কের Affect Heuristic তাই করে। যে লোকটা রোজ বাজারে ঘোরে কয়েক টাকা কমে মাছের জন্য, সে লোকটা অর্থনীতির মারপ্যাঁচ বোঝে না, কিন্তু বৃহস্পতিবারের ফুল বা জুম্মা বারের নামাজ বোঝে। ফলতঃ নরেন মোদীর অর্থনীতির সাফল্য দিয়ে কী হবে, তিনি ধর্ম খাইয়ে দেন। মমতাও বুঝিয়ে দেন কাশ ফুল তোলো আর ঘরে ক্যাশ জমাও। আবেগ সোজা জিনিস সহজে বোঝে।

Affect Heuristic একটা বাচ্চাও অজান্তে বোঝে। খারাপ রেজাল্ট হলে অপেক্ষা করে কখন বাবার মুড ভাল থাকে, তখন রেজাল্ট দেখায়। কারণ সে জানে, প্রতিক্রিয়া বা সিদ্ধান্তের অনেকটাই আবেগ নির্ভর, যুক্তি নির্ভর নয়। যদি বাবা মানুষটা যুক্তি নির্ভর হতেন, তাহলে মুডের তোয়াক্কা না করে নম্বরগুলোকে নম্বরের মতই পড়তেন। বামপন্হীর আবেগে যুক্তির শক্ত বনিয়াদ থাকবে। নইলে বাম, রামের হাওয়ায় দুলে যাবে। Affect Heuristic জানতে এবং যতটা সম্ভব দীর্ঘ মেয়াদী শ্রমসাধ্য সিদ্ধান্তে আসতে হবে।