০৯১-Planning Fallacy

নববর্ষ বা জন্মদিনে যে প্রতিজ্ঞাগুলো করেন, কত শতাংশ কার্যকারী হয় এবং কত দিন মনে রাখেন? হিসাব করলে নিজে হাসবেন। তবু আপনি আলাদা, একটা দিশা আছে। বহু মানুষের এই বদভ্যাসটাও নেই। যারা পরিকল্পনা করেন, তাদের নিয়েই আলোচনা। কঠোর বাস্তববাদী আগামী লক্ষ্য স্হির করতে বড্ড বেশী আশাবাদী হয়ে যান। অনেক অবাঞ্ছিত দুর্ঘটনা মোকাবিলার পরিসর রাখেন না। তাকে বলে Planning Fallacy। অনেকক্ষেত্রে পরিকল্পনার লক্ষ্য থেকে দূরে সরতে সরতে হতাশায় লক্ষ্যহীন হয়।

হতাশ হবেন না। MBA দ্বারা পরিচালিত সরকারী প্রোজেক্টের হাল আরো খারাপ। ওনারা Program Evaluation Review Technique (PERT) জানেন। খুব ভালো পরিস্হিতি, সাধারণ অবস্হার চার গুণ এবং খুব খারাপ পরিস্হিতি যোগ করে ছয় দিয়ে ভাগ করে কীসব হিসাব করেন। ওনারা দূর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রীর হিস্যা, কালীঘাট, লোকমান্য মার্গের ভাগ ধরেও নির্দিষ্ট সময় ও মূল্যের বহু দূরে ভঙ্গুর প্রকল্পে শেষ করেন। Planning Fallacy PERT, GNATT Chart করেও আশাবাদের বৃত্তের বাইরে যেতে আক্ষম।

আমাকে প্রমোটার বললেন, একটা ড্রাফট মেল করেছি। দেখে সম্মতি দিন, নইলে পুজোর ছুটি পড়ে যাবে। আমি দৌড়ে বাড়ি ফিরলাম। পুজোর মন্ডপ বাঁধতে ওয়াই-ফাইয়ের তার ছিঁড়ে ফেলেছে। ১২ ঘন্টা পরে যখন পরিস্হিতি স্বাভাবিক হল, পুজোর ছুটি পড়ে গেছে। পরিকল্পনায় যত বেশী মানুষ বা সংস্হা জড়িত, সেখানে Planning Fallacy তত বেশী। এমনকি কেরাণী যুবক যখন ভাবে সে যখন ভালবাসে, তাহলে ঘর বাঁধতে অসুবিধা কোথায়? প্রেমিকার ভয় কেরাণী প্রেমিক জীবনকে ভোগ করতে দেবে না।

আমরাই নেতাদের ভোগবাদী জীবনের সমালোচনা করি। নিজেদের ছোট ছোট উদ্যোগগুলিকে সফল করতে উদ্যোগ নিই না, বা কাউকে সহায়তা করি না। ভাবি নবান্ন উন্নয়ন করে দেবে কিংবা সাউথ ব্লক থেকে বিকাশ বিকশিত হবে। চালে কাঁকড়ের মত ভোগবাদী বন্ধুরা পরিকল্পনায় Planning Fallacyতে মুড়ে দেবে। কেন্দ্রে ও রাজ্যে দূর্নীতিগ্রস্ত সরকার, অর্থনীতির হাল নিম্নগামী। এই সময়ে পরিকল্পনা করা কঠিন বোধটা অর্জন করতে হবে ও Planning Fallacy থেকে বিরত থেকে আরো বাস্তববাদী হতে হবে।

০৯২-Deformation Professionnelle

Mark Twain বলেছেন, তোমার হাতে যদি কেবল হাতুড়ি থাকে তাহলে সব সমস্যা পেরেকে। কথাটার গভীর অর্থ আছে। একজন ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে ফতুর হয়ে আত্মহত্যা করল। ব্যবসায়ীরা বলবে, ও বাজারটা বুঝতে পারেনি। ব্যাঙ্কার বলছে, ঋণ দেবার আগে খতিয়ে দেখা উচিৎ ছিল। ডাক্তারের বক্তব্য, মানসিক চিকিৎসায় বাঁচত। জ্যোতিষী শনি রাহুর দৃষ্টিকে দায়ী করল। সমাজতান্ত্রিক নেতা, পুঁজিবাদের ব্যর্থতা বলল। পুরোহিত ওর নরক যাত্রা নিশ্চিত করে দিল। এটাই Deformation Professionnelle।

Deformation Professionnelle মানে, কেউ কারো জ্ঞানের বৃত্তের বাইরে সামগ্রিক ভাবে দেখতে পায় না। অর্থাৎ কোন সমস্যার একটি বিশেষজ্ঞ হয় না। দূর্নীতিকে আপনার অপরাধ মনে হতে পারে, কিন্তু পূজিবাদী ব্যবস্হায় বেড়ে ওঠা কোন লোক যেন তেন প্রকারেণ ধনপ্রাপ্তিতে দোষ দেখে না। আবার ওই লোকটাই ভিখারীকে ১০০টাকা ভিক্ষা দেয়। কন্যাশ্রীর টাকা নিয়ে অসহায় মা নাবালিকার বিয়ে দিয়ে তৃণমূলকে ভোট দেয়, আবার সচ্ছ্বল বামপন্হী শীতাতপ যন্ত্র ছাড়া এক দিন গুজরান করতে পারে না।

ডিগ্রী কেবল একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ করে। শিক্ষা সামগ্রিকতায়। সমাধানের পথও ভিন্ন। আত্মহত্যার কথা শুনে শুঁড়ি বলবে, সেদিন জমিয়ে নেশা করলে দুঃখ দূর হয়ে যেত। বন্ধুরা বলল, বুঝতে পারলে সবাই মিলে ওকে বাঁচার সাহস দিতাম। ডাকাত হেসে বলে, কমসে কম চুরি করে জেলে দু মুঠো অন্ন পেতে পারত। আপনার মোদীর কথা ঠিক মনে হবে, মমতারও। বিরোধীরাও সঠিক যুক্তি দেয়। সবাই Deformation Professionnelleর সমস্যায় ভুগছে। সমস্যাগুলো অন্ধের হস্তী দর্শনের মত আংশিক।

দুঃখের সময়ে কী করতে হয়, সেখানেও Deformation Professionnelle। কেউ বন্ধুর হাত ধরতে চায়, কেউ প্রবল উল্লাসে কার্নিভালে সুরাসিক্ত হয়ে ভেসে যেতে চায়। সমাজে কোন অংশটা বেশী? ডান বাম ভুলে হিসাব করুন, দেখবেন সংখ্যাধিক্যের সরকার চলছে এবং স্বাভাবিক ভাবে Deformation Professionnelleএর শিকার। তাই নবান্নের উন্নয়ন নেই, লালকেল্লার বিকাশ নেই। যে যার মত হাতুড়ি হাতে পেরেক খুঁজে বেড়াচ্ছে। সামগ্রিকতায় বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা না করলে বারংবার এক ভুল হবে।

০৯৩-Zeigarnik Effect

বার্লিনে মনস্তত্বের অধ্যাপক Zeigarnik সহ অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় গেলেন। বিভিন্ন জন বিভিন্ন পদের অর্ডার করল। ওয়েটার কোথাও না নোট করে নির্দিষ্ট ভাবে পরিবেশন করল। সঠিক বিল এল। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে Zeigarnik খেয়াল করল, স্কার্ফটা ফেলে এসেছে। সেই স্মার্ট ওয়েটারকে প্রশ্ন করতে সে মনে করতে পারল না Zeigarnikরা কোথায় বসেছিল। শুরু হল অন্বেষণ। Zeigarnikএর নামে হল Zeigarnik Effect। প্রোজেক্টের শেষ অবধি মানুষ খুঁটিনাটি মাথায় রাখে, অতঃপর ডিলিট।

বামফ্রন্টের ৩৪বছর রাজত্বে ভূমি সংস্কারের ফলে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা ৫২.২% থেকে ২০%এ নেমে গেছে। কৃষির সাফল্যের পর শিল্পে অগ্রগতি হলে আজ শূন্য হয়ে যেত। কাউকে অনুদানের ভিক্ষায় জীবন ধারণ করতে হত না। Zeigarnik Effectএ মানুষ তা ভুলে গেছে। নাবালিকা বিবাহে ঝাড়খন্ডের ঠিক পরেই আজ বাংলা। সীমাহীন কার্নিভালের আলোয় দরিদ্র মানুষও বিনা মদ-মাংসে যুক্তির কথা কানে তুলবে না। দুঃখহরা মদ আবগারীতে সরকারের সবচেয়ে বেশী রাজস্ব দিচ্ছে।

বিখ্যাত কোরিয়ান ছবি Train to Busan মনে আছে? Zombie রোগের প্রাদুর্ভাবে Zeigarnik Effectএ মানুষ সব ভুলে মৃত-জীবিতের মধ্যবর্তী স্তরে ভাসছে। কোন Zombie সুস্হ মানুষকে কামড়ে দিলেই সেও পলকে Zombie হয়ে যাচ্ছে। পরিচিতরা বদলে যাচ্ছে দ্রুত। যে মানুষটা একটু আগে বাঁচার চেষ্টা করছিল, পর মুহূর্তে সেও Zombie। অনুদানের ছোঁয়া লাগলেই সুশীলরা হাওয়াই চটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কার্নিভাল, ভ্রমণ, মদ, উদ্বেল উদ্দেশ্যহীণ জীবনের অক্টোপাস আপনাকে আক্রমণ করছে।

আমরা অনেক তথ্য মস্তিষ্কে অস্হায়ী অবাস্হায় রাখি। এমনকি আনন্দ, দুঃখ, হতাশা, ক্রোধও। দ্রুত অপরপক্ষ সমঝোতায় এলে বা দুঃখপ্রকাশ করলে মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায়, কিন্তু দীর্ঘ স্হায়িত্বের জন্য অপরপক্ষের জেদ কাজ করে। Zeigarnik Effectকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধান করা যায় সহজেই। যদি আপনার আচরণ অন্যকে দুঃখ দিয়ে থাকে, তাহলে আচরণের সপক্ষে যুক্তি না সাজিয়ে Zeigarnik Effectকে ব্যবহার করে মিটিয়ে নিন। আপনি ভালো থাকুন, সবাইকে ভালো থাকতে সহায়তা করুন।