০১৬- Chauffeur Knowledge

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম মেকানিক্সে ১৯১৮সালে নোবেল পুরষ্কার পান। জার্মানীর বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্হা থেকে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য ডাক পাঠায়। তিনি গাড়ি করে যান, বক্তব্য রাখেন, ফিরে আসেন। এক দিন ড্রাইভার তাঁকে বললেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিষয়ে তিনি বক্তব্য রাখতে পারবেন। প্ল্যাঙ্ক সাহেব হাসলেন, ঠিক আছে। আমি ড্রাইভার সেজে বসে থাকব। সত্যি সত্যি, বার্লিনের সভায় বিশেষজ্ঞদের সামনে ড্রাইভার ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সেজে দিব্যি কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝিয়ে দিলেন। এই অবধি ঠিক ছিল।

জনৈক অধ্যাপক একটি প্রশ্ন করে বসলেন। ড্রাইভার মাথা চুলকে বললেন, আমার ধারণা ছিল বার্লিনে সবার এইটুকু জ্ঞান আছে। আপনার সহজ প্রশ্নের উত্তর আমার ড্রাইভার দিয়ে দেবেন। আমি তাঁকে মঞ্চে আহ্বান করছি। একে বলে Chauffeur Knowledge। বুদ্ধদেবকে সিদ্ধার্থ বলেছিলেন, আপনি সর্বজ্ঞানী। কিন্তু প্রজ্ঞা আহরণের সেই মুহূর্তটাও জ্ঞানের বৃত্তে। আমি শুনতে চাই না, আহরণ করতে চাই। সিদ্ধার্থ উপন্যাসটাও লিখেছিলেন জার্মান হেরমান হেস। তিনিও নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।

Chauffeur Knowledge সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের হাতের কাছের উদাহরণ তথাকথিত অধ্যাপক দেবনারায়ণ সরকার। বিভিন্ন টিভির মজলিশে দূর্নীতির সপক্ষে এক যুগ বক্তব্য রাখছেন। প্রণিনাধযোগ্য তথ্য হল তিনি সেক্সপীয়রকে উদ্ধৃতি করে দূর্নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার হাস্যকর প্রয়াস করেন। অর্থাৎ তিনি সেক্সপীয়র মুখস্ত করেছেন, কিন্তু হজম করতে পারেননি। শিক্ষা যদি যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তব সম্মত জ্ঞান না দেয়, তাহলে সে জ্ঞান অসম্পূর্ণ। যাকে বলতে পারেন Chauffeur Knowledge। তিনিও তাই।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তথাকথিত অধ্যাপক দূর্নীতিকে সমর্থন জানাতে টক-শোতে বসেন। তাঁদের অনেকে হারিয়ে গেছেন কালের নিয়মে। কিন্তু দেবনারায়ণ সরকারের Chauffeur Knowledge জনতা ভাঁড়ামো হিসাবে গ্রহণ করেছে বলে, এখনও তিনি আনন্দ পরিবেশন করতে পারেন। যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, তা সর্বসমক্ষে স্বীকার করা বা চুপ করে থাকা শ্রেয়। পুঁটি মাছের ফড়ফড়ানিতে মানুষ প্রকৃতপক্ষে মজা পায়। তিনি জোকার হয়েছেন। বিষয়ের গভীরতা দেখুন, Chauffeur Knowledge এক অসুখ।

০১৭- Illusion of Control

সহ্য ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য একটি কক্ষে একজনকে ঢুকিয়ে তাপমাত্রা বাড়ানো হল। কিছুক্ষণ পরেই সে চিৎকার করতে শুরু করবে। কিন্তু তাকে যদি বলা হয়, সহ্য ক্ষমতার বাইরে গেলে এই লাল বোতামটা টিপলেই দরজা খুলে যাবে, তখন সে আরো অধিক তাপমাত্রা সহ্য করে নেবে। একে বলে Illusion of Control। বন্ধুরা বলে, আমি আছি তো চিন্তা নেই। বাবা-মা বলেন, ভগবান আছে, ভরসা রাখ। নেতারা বলেন, দেশ এগিয়ে চলেছে। জনতা যদি ভাবে কোন বড়বাবু সব কন্ট্রোলে রেখেছেন, তাহলেই বিন্দাস।

২১ তারিখে দ্য গ্রেট ভাইপো বৃষ্টিতে ভিজে বাতেলা ঝাড়লেন, প্রকল্পের বাংলা নাম বদল হবে না। পিসি টাকা দেবে। মোদীকে টাকা দিতে হবে না। জনতা ছাতা মাথায় হাততালি দিল। তারপর রাজ্যের বকেয়া নিয়ে পিসি গেলেন মোদীর সাথে গোপনবাজী করতে। এক অদ্ভূত যাদুবলে বাংলা সড়ক যোজনার সাইনবোর্ড বদলে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনা হয়ে গেল। মানুষের যে ভরসা ছিল দ্য গ্রেট ভাইপোর উপর বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল। ২১শে মঞ্চ সামলে মহাসচিব পার্থ পহেলা বাইশে কয়েদখানার দু-নম্বরী সেলে বন্দী।

খেয়াল করে দেখুন, যেই পার্থর উপর Illusion of Control ভেস্তে গেল জনতা ভগবানপুরে পার্থর কালেক্টরের ছেলে বউকে গাছে বেঁধে উদোম পেটালো। এত দিন মারেনি কেন? উত্তর Illusion of Control। এত দিন শুভ্রা ঘড়ুই স্যান্ডেল ছোঁড়েনি কেন? Illusion of Control। এখন কুণাল পার্থকে গালাগালি করছে কেন? Illusion of Control। Illusion of Control ধরে রাখতে দল কুণালকে চুপ থাকতে বলছে, কারণ পার্থকে প্রথমে খাট দেওয়া হবে, তারপর খাট ভাঙার উপকরণ জেলে পৌঁছাবে।

মানুষ যদি দেখে পার্থ জেলে রসেবশে আছে, তবে দলীয় কালেক্টরদের ভরসা বাড়বে, বাড়বে Illusion of Control। অর্থাৎ মানুষের জীবনে Illusion of Control দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়, আবার সম্ভবকেও ভয় পায়। আজ মোদী ভাবছেন, আমি পিসিকে কন্ট্রোল করছি, হিস্যা খাচ্ছি। আগামীকাল দেশের সম্পদ বিক্রী, বিভিন্ন চুক্তির কাটমানি ED জেরা করে শিক গরম করবে না, তার গ্যারান্টি নেই। তাহলে মমতা-মোদী কেমন করে ক্ষমতায় আছেন? Illusion of Control। আসলে জনগনই Control।

০১৮- Incentive Super Response Tendency

ফ্রান্সে একদা ইঁদুরের উপদ্রপ এত বেড়ে গিয়েছিল যে সরকার মরা ইঁদুর জমা দিলে পুরষ্কার ঘোষণা করে। প্রচুর মৃত ইঁদুর জমা পড়তে শুরু করল। মানুষ দশটা ইঁদুর মারলে বিশটা আগামীকালের জন্য পুষতেও শুরু করে। ফলে ইঁদুরের বংশবৃদ্ধির হার দেশে আরো বাড়ল। চিন সরকার চাষীদের অনুরোধ করে ডায়নোসোরাসের হাড় জমা দিতে, প্রতি হাড়ে ইনাম মিলবে। জমা পড়ল। একটা হাড়কে ভেঙে কয়েক টুকরো করে। জনগন হচ্ছে লখীন্দরের বাসরের কালনাগিনী। ছিদ্র সে খুঁজে বার করে নেবেই।

ব্যাঙ্কে Cross Sellingর উপদ্রপে মানুষ শাখায় যেতেই ভয় পেত। মিউচুয়াল ফান্ড, জীবনবীমা, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবসার তাড়নায় দৈনন্দিন ব্যাঙ্কিং শিকেয় ওঠার যোগাড়। কারণ Incentive থাকলে Incentive Super Response Tendency চলে আসবে। কর্মীদের মধ্যে অস্বাস্হ্যকর প্রতিযোগিতা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পেছেনেও Incentive Super Response Tendency। আপনি দেব-নুসরতকে মহানায়ক বললে, বাকি অভিনেতাদের খামতিও চিহ্নত হয়। আপনি নিজেই অ্যাকাডেমি নিলে প্রকৃত সাধকরা প্রতারিত হন।

Incentive Super Response Tendency আখেরে সংগঠন ও দেশের তুমুল ক্ষতিসাধন করে। অথচ ম্যানেজমেন্ট এটাকেই বেশী কাজ আদায়ের হাতিয়ার মনে করে কিংবা কর্মীদের ভিতর লড়িয়ে দেওয়া। মনে করুন, তৃণমূলে সুপ্রিমোকে স্তুতি করলে পুরষ্কার পাওয়া যায়, কারণ সুপ্রিমো তা উপভোগ করেন ও সত্যি বলে বিশ্বাস করেন। ফলে দলের সব কর্মচারী স্তুতিপাঠকেই প্রাথমিক কর্তব্য বলে মনে করল। Incentive Super Response Tendencyর ফলে যুদ্ধ শুরু হল। বিজিতদের দূর্নীতির ছাড়পত্র মিলল।

সর্বশেষ পরিণতি কী? সুপ্রিমোর লালসায় ঘি ঢালতে ঢালতে সংগঠনটাই চোরদের আখড়া হয়ে গেল। এখন আবার কেবল অনুপ্রেরণা বললে হবে না, ভাইপোর সেনাপতিত্বেও বলতে হবে। Incentive Super Response Tendencyতে ভোগা দূর্নীতিগ্রস্ত দলীয় কর্মচারীদের মত সরকারী কর্মচারীরাও ক্রীতদাসে পরিণত হল। দিল্লীতেও হিন্দুত্বকে পেছনে ফেলে মোদীত্ব শুরু হয়েছে। Incentive Super Response Tendency কোন সংগঠনকে সাহায্য করে না। দরকার Mission এবং Visionর, আদর্শের।