স্ত্রীশুদ্রদ্বিজবন্ধূনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা।

কর্মশ্রেয়সি মূঢ়ানাং শ্রেয় এবং ভবেদিহ।

ইতি ভারতিমাখ্যাং কৃপয়া মুনিনা কৃতম।।

(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৪/২৫)

অর্থাৎ, স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষদের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করবার ক্ষমতা নেই, তাই তাদের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে মহর্ষি ব্যাসদেব মহাভারত নামক ইতিহাস রচনা করলেন, যাতে তারা তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে।

নয়া সংসদ ভবন উদ্বোধন নিয়ে বিতর্কের মাঝেই একটা জটিল প্রশ্ন উঠে এসেছে। আইনে সভার দ্বার উদঘাটনের দিনে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি থাকবেন না কেন? বিরোধিরা মনে করছেন যে, মনুবাদী আর এস এস-এর অঙ্গুলি হেলনেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারা অভিযোগ করছেন, যেহেতু তিনি একজন মহিলা এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের তাই তিনি ব্রাত্য।

বিরোধীদের এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে বিজেপি প্রচার চালালেও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আর্য সংস্কৃতির মনুবাদী, আধিপত্যবাদী যে ধারা সেই ধারাকেই আর এস এস-এর মেনে চলে। কিন্তু আর্যদের মনেও ছিল এক আশঙ্কা। আধিপত্যবাদী আর্য সভ্যতা প্রবক্তাদেরা প্রথম দিন থেকেই যে আশঙ্কা তাড়া করে বেড়িয়েছে, কেননা শিল্প-প্রযুক্তি, সংস্কৃতিসহ সমস্ত অর্থনৈতিক ভিত্তিগুলিতে বিদেশি আক্রমণকারী আর্যরা ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রবক্তা অনার্যদের থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে। দুর্ধর্ষ, বর্বর ও যাযাবর প্রকৃতির আর্যরা তবুও সক্ষম হয়েছিলেন উন্নত অনার্যদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে। তাই, তাদের দরকার হয়েছিল নিজেদের আধিপত্যকে বজায় রাখার জন্য একটি আধিপত্যবাদী মতবাদের। বর্বর আর্যরা ভাববাদকেই এই কাজে ব্যবহার করেছিল। ধীরে ধীরে তারা মানুষের মনে এটা গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছিলো যে, এই পথই একমাত্র ঈশ্বর লাভের পথ। অর্থনৈতিক বিভাজনকে সামাজিক বিভাজনের স্তর হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু এটা রাতারাতি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এর জন্য অনেক দীর্ঘ পথ চলতে হয়েছিল, আর পথের কাঁটাগুলিকে একটা একটা করে উপরে ফেলতে হয়েছিল। এরপর এসেছে ফাইনাল সলিউশন, গীতা ও মনু সংহিতা।

বিদেশী আক্রমণকারী আর্যদের নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। ঐতিহাসিক খননকার্য ও আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভর নতুন নতুন আবিষ্কারের সাথে সাথে এই কৌতূহলের উপরেও নানান প্রলেপ পড়েছে। এই সমস্ত আবিষ্কারের ফলে আমরা জানতে পেরেছি, আর্য বলতে কোনও জাতি বা মানবগোষ্ঠীকে বোঝায় না, বোঝায় এক ভাষাগোষ্ঠীকে। সেই বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে বৈদিক ভাষা বা সংস্কৃতও আছে। আর্য ভাষাগোষ্ঠীর লোকদেরও আর্য বলে। কোনও এক ভাষাভাষী গােষ্ঠীকে আর্য বলা হয়তো ঠিক নয় তবু এই রীতিই দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। সংস্কৃতই একমাত্র আর্যভাষা নয়। সংস্কৃতের সঙ্গে ল্যাটিন, গ্রিক, জার্মান, ইংরেজি, প্রাচীন পারসিক প্রভৃতি ভাষার পদগত ও ধ্বনিগত অদ্ভুত মিল আছে। এই ভাষাগুলোর প্রতিটিই আর্যভাষা। ফিলিপ্পো সসসেত্তি নামে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরবাসী জনৈক বণিক ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্যোপলক্ষে ভারতে আগমন করেন। গােয়ায় অবস্থানকালে তিনি স্থানীয় এক বিদ্বজ্জনের নিকট সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়ন করেন। তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে জোসেফ স্কালিজার নামে এক বিদ্যোৎসাহী (১৫৪০-১৬০৯ খ্রিস্টাব্দ) এ বিষয়ে আরও অগ্রসর হন এবং গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, স্নাভনিক, প্রাচীন পারসিক ও সংস্কৃত ভাষাসমূহের মধ্যে গভীর যোগসূত্র লক্ষ করেন। এর প্রায় দু’শাে বছর পর ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়ম জোন্স কলকাতায় এশিয়াটিক সােসাইটির এক অধিবেশনে সংস্কৃতের সঙ্গে ল্যাটিন, গ্রিক কেলটিক, গথিক, প্রাচীন পারসিক প্রভৃতি এশিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি ভাষার গভীর যোগসূত্রের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি মন্তব্য করেন, এই ভাষাগুলো একটি আদি বা মূল আর্যভাষা হতে উৎপন্ন হয়েছে। পরবর্তী গবেষকরাও বিভিন্ন ভাষায় পদের ব্যবহার, গঠন, বিন্যাস ও ধ্বনি পরীক্ষা করে এই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। মূল আর্যভাষাটি বহুদিন পূর্বেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। পণ্ডিতেরা এই মূল ভাষাটিকে আদি আর্য, আদি ইন্দো-ইউ, আদি ইন্দো-জার্মান ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন। এই মূল আর্য ভাষায় যারা কথা বলতেন, তারাই আদি আর্য, এরাই বৈদিক ও ইউরোপীয় আর্যদের পূর্ব-পুরুষ।

আর্যদের নিয়ে আরও একটি কৌতূহলের বিষয় হলো, আর্যরা কোথা থেকে এসেছিল? একদল ঐতিহাসিক বলেন যে তারা বাইরে থেকে ভারতে এসেছিল। আরেক দল ঐতিহাসিকদের মতে তারা ভারতেরই আদি অধিবাসী। এই মতের কথা আমরা প্রথম শুনতে পাই প্রত্নতাত্ত্বিক বি. বি. লালের কাছে। তিনি তার বইতে  (B. B. Lal. The Earliest Civilization of South Asia (New Delhi, 1997): ও  “Some Thoughts on the Home of the Indo-European Languages and Culture” in D. N. Tripathi ed. A Discourse on Indo-European Languages and Cultures (New Delhi, 2005).) বইতে আর্যদের ভারতবর্ষের অধিবাসীর সপক্ষে যেসব যুক্তি উত্থাপন করেছেন সেগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক-

১. ঋগ্বেদ সংহিতায় এমন কোনও ইঙ্গিত নেই যা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে আর্যরা বহিরাঞ্চল হতে ভারতবর্ষে আগমন করেন।

২. ঋগ্বেদকে যত অর্বাচীন মনে করা হয়, ঋগ্বেদ তা নয়। এই সংহিতা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে সংকলিত হয়।

৩. ঋবৈদিক আর্যরা অর্ধ-যাযাবরও নন, গ্রামীণ গােষ্ঠীও নন; তারা কৃষির বিকাশ সাধন করেছেন, সুরক্ষিত পুর নির্মাণ করেছেন, সামুদ্রিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করেছেন, অশ্বের ব্যবহারে নৈপুণ্য অর্জন করেছেন।

৪. ঋবৈদিক আর্যরা যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন, কালিবঙ্গান ও লােথালে যজ্ঞবেদি আবিষ্কৃত হয়েছে।

৫. ঋগবৈদিক ও হরপ্পা সভ্যতার মধ্যে যে বৈসাদৃশ্যের কথা বলা হয়, তা অতিরঞ্জিত। ঋবৈদিক আর্যরাই হরপ্পা সভ্যতা সৃষ্টি করেন, হরপ্পীয় সিলমােহরে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।

৬. ঋগ্বেদে যাদের পুর বলা হয়েছে তা আসলে পাচিল-ঘেরা হরপ্পীয় শহর বা দুর্গ।

বি. বি. লাল ঋগ্বেদের সাক্ষ্য এবং হরপ্পা ও মেহেরগড়ে প্রাপ্ত প্রত্নাবশেষের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে আনুমানিক ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে আনুমানিক ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সংস্কৃতির বিবর্তনের একটি চিত্র অঙ্কন করেছেন।

ভারতবর্ষই আর্যদের আদি বাসভূমি এবং হরপ্পীয়রাই ঋবৈদিক আর্য, বি. বি. লালের এই অভিমত অনেকের নিকট যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়নি। তাদের যুক্তি হলো –

প্রথমত, ঋগ্বেদে যে পুর কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে, তার অর্থ অস্থায়ী বেষ্টনীযুক্ত বসতি, তার অর্থ দুগ বা শহর নয়।

দ্বিতীয়ত, মেহেরগড়ে বসতির ইতিহাস শুরু হয়েছে আনুমানিক ৭৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে। আনুমানিক ২৫০০-৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থানটি বসতিহীন অবস্থায় পড়েছিল। আবার ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে এখানে নতুন করে বসতি স্থাপিত হয়। আর্যরা এই নতুন বসতির প্রতিষ্ঠাতা হলে স্থানটি কেন হাজার বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল? সেক্ষেত্রে আর্যদের তাে নবাগত বলেই বােধ হয়। এখানে উল্লেখ করা যায়, পুর কথাটি বেষ্টনী, দুর্গ, শহর, প্রতিরক্ষা-ঢিপি ইত্যাদি বিবিধ অর্থ প্রকাশ করে। ঋগ্বেদে পুর পদটি অস্থায়ী বেষ্টনী-পরিবৃত বসতি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, অন্য কোনও অর্থে নয়, এরূপ ব্যাখ্যা একপেশে বলে মনে হয়।

সুতরাং, এটা পরিষ্কার ভাবেই বলা যায় যে, আর্যদের ভারতীয়ত্বের তত্ত্ব সম্পুর্ন ভিত্তিহীন। যার সাথে ইতিহাসের কোন সম্পর্ক নেই। সাথে সাথে এটাও পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সমাজের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের শ্রমের উপর আধিপত্য বজায় রাখার জন্যই তারা তখনও সচেষ্ট ছিলেন; এবং এখন তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরাও একই রকম ভাবে সচেষ্ট রয়েছেন। সময় বদলেছে কিন্তু বঞ্চনার হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এতটুকুও বদলায়নি। শুদ্র ও নারীরা আর্যদের ভারত আক্রমণের পর থেকে যেভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, আর এস এস ও বিজেপির জমানায় তারা আবারও একই বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন যা কখনোই কাম্য নয়। সংসদ ভবন উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে সেই আধিপত্যবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেলাম আমরা। খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ ও ব্যাপক জনগণের শত্রু এই ফ্যাসিস্ত শক্তিকে যেভাবেই হোক রুখতেই হবে, এখনই…না হলে আরও অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে যাবে আমাদের দেশ।