পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ‍্যমে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে অক্সিজেন পেতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষুধার সূচকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের চেয়েও পিছিয়ে থাকা দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর  “বিশ্বগুরুর ভাবমূর্তি” তাঁর বশংবদ মিডিয়াও সামাল দিতে পারছে না। প্রায়শই সোশ‍্যাল মিডিয়ায় স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদের ক‍্যামেরা আর বুমের সামনে নিতান্ত সাধারণ চেহারার যে মানুষগুলো মোদি সরকারের বিরুদ্ধে  তাঁদের ক্ষোভ উদ্গীরণ করছেন তা ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে “আচ্ছে দিন আয়েঙ্গে” র প্রচারের পুরোপুরি বিপরীত ছবি। কারণ বিভিন্ন টেলিভিশন চ‍্যানেলে সে সময় অমন সাধারণ চেহারার গ্রাম‍্য ভারতীয়দের মুখেই বসানো হত “আচ্ছে দিন লায়েঙ্গে মোদিজিকো ইসবার জিতায়েঙ্গে”র  মতো সংলাপ। ফলে নয়াদিল্লীর দ্বারকায় রামলীলা সোসাইটির ময়দানে প্রধানমন্ত্রী  নরেন্দ্র মোদি  বিজয়াদশমীর ভাষণে রাম রামমন্দিরের কথা বলার পাশাপাশি অস্ত্রভাণ্ডার  ,সীমান্তসুরক্ষার কথা বলে নিজেদের মতো করে  দেশপ্রেম অথবা উগ্রজাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন । গীতা এবং তেজস ও আই এন এস বিক্রান্তকে একই বন্ধনীতে রেখে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন দেশবাসী ভুখা থাকলেও  দেশ আসলে ‘শক্তিশালী”।

    অসুস্থ ও বাসভবনে বিশ্রামরত পশ্চিমবঙ্গের  মুখ‍্যমন্ত্রীর দুর্গাপূজার ভার্চুয়াল উদ্বোধনের সময়  দেওয়া বক্তব্যের অংশবিশেষ খতিয়ে দেখে এবং একশো দিনের বকেয়া টাকা আদায়ের জন‍্য ডায়মণ্ডহারবারের সাংসদের নেতৃত্বে প্রথমে নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে  এবং  রাজ‍্যপালের সঙ্গে নিখুঁত বোঝাপড়ায় নাটকীয় আন্দোলনের  ছবি সংবাদ মাধ‍্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরে তৃণমূল কংগ্রেসের  নখদন্তহীন অবস্থা বুঝে শারদোৎসবে কলকাতায় ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের কলকাতা পুরসভার ৫০ নং ওয়ার্ডের  কাউন্সিলরের মাধ‍্যমে মধ‍্য কলকাতার ঐতিহ্যবাহী পুজো সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের মণ্ডপ অযোধ‍্যার রাম মন্দিরের আদলে তৈরি করে চমকের মাধ‍্যমে জনমানসে কিছুটা উন্মাদনা তৈরি করার চেষ্টা করেছে। প্রত‍্যক্ষদর্শীরা মন্তব্য করেছেন,” মণ্ডপ এবং তাকে ঘিরে সংগঠিত গেরুয়া পতাকার ছড়াছড়ি  জয়শ্রীরাম শ্লোগান  কর্মকাণ্ড উন্মাদনা দেখে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই যে, এটা কলকাতার ৮৮ বছরের পুরোন পুজো। “

যখন এই পুজোর উদ্বোধন করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, তখনও নরেন্দ্র মোদি অযোধ‍্যার রাম মন্দিরের আনুষ্ঠানিক দ্বারোদঘাটনের দিন ঘোষণা করেন নি ।  কিন্তু তাতে কি? একেবারে রাজনৈতিক প্রচারের কায়দায় সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার ওরফে সাবেক নেবুতলা পার্কের পুজো উদ্বোধনে ভাষণে রামমন্দিরকে নিয়ে ধর্মীয় আবেগকে উসকে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের ডাক দিয়ে গেলেন। অভিজ্ঞ সাংবাদিকর বলছেন, অযোধ‍্যার রামমন্দির ছাড়া ২০১৯ থেকে ২০২৩  পর্যন্ত সময়কালে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের সরকারের বলার মতো কোন সাফল‍্য নেই। তাই কলকাতায় বোধনে এবং বিজয়া দশমীতে দিল্লিতে দুজনের বক্তব্যেই “রাম ভরোসা!”

ভারতীয় জনতা পার্টির আদর্শগত অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের বর্তমান সরসঙ্ঘ চালক মোহন ভাগবত কিন্তু শত্রু চিনতে ভুল করেন নি। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি আদর্শগতভাবে  আক্রমণ করে গেছেন বামপন্থীদের,বিশেষত মার্কসবাদীদের। দশেরার দিন  নাগপুরে সংঘের বার্ষিক অনুষ্ঠানে মোহন ভাগবত স্পষ্টই সাংস্কৃতিক মার্কসবাদীদের দেশের পক্ষে বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করে বলেছেন “সংবাদ মাধ‍্যম এবং বিশিষ্ট জনদের একাংশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশের সংহতিকে বিপন্ন করছে ;সমাজে বিভেদ বাড়াচ্ছে। ” অর্থাৎ ভোটের অঙ্কে যতই দুর্বল দেখাক প্রকতপক্ষে বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি সংঘ পরিবারের কাছে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার। সিপিআই (এম ) সহ বামদল এবং বনভূমি ও আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে থাকা সংগঠনগুলোকে একই বন্ধনীতে রেখেছে আর এস এস। নরেন্দ্র মোদি কিছুদিন আগে এঁদেরই বলেছিলেন “আরবান নকশাল”। ভারতের বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে রোজগারের সুযোগ হারানো  বিপন্ন জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে যেভাবে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে মুখ খুলছে তাতে দেশে বৃহৎ বাম গণতান্ত্রিক ঐক‍্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। সে কারণেই সংঘ পরিবার ভাবছে এখানে শুধুমাত্র ভোটের অঙ্ক নয় প্রাণ বাঁচাতে জনগণ  ভাত জোটানো নিশ্চিত করার অঙ্কই কষবেন। সেক্ষেত্রে আপাতত গৌতম আদানির পছন্দমত খবর করা মিডিয়াকে বোকা বানিয়ে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে অপ্রত‍্যাশিতভাবেই রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অন‍্যখাতে  বইতে পারে।