মমতা বন্দোপাধ্যায় দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের মন্ত্রী হওয়ার সময় কাল থেকে প্রকাশ্যে বিজেপির সঙ্গে একটা দূরত্ব রাখার অভিনয় করতে শুরু করেছেন। কখনো কখনো বিজেপি বিরোধী কাগুজে বিবৃতি ও দিয়েছেন। কিন্তু একটিবারের জন্য বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএস সম্পর্কে অতীতের মতোই কখনো একটা শব্দ তিনি উচ্চারণ করেন নি।


 দ্বিতীয় ইউপিএ  সরকারে অবস্থান করে গোটা কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ,পাশাপাশি আর এস এস -বিজেপির সাহায্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করবার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনিক বা সামাজিক উদ্যোগের আড়ালে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেন। কেন্দ্রে তখনও ইউপিএ  সরকার একটা নড়বড়ে অবস্থানের মধ্যে হলেও বর্তমান রয়েছে ।মুজফফরনগর দাঙ্গা চলছে। আরএসএস – বিজেপি বিভাজনের রাজনীতিকে তীব্র থেকে তীব্রতর করবার দিকে এগোচ্ছে ।তাদের লক্ষ্য ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন।            

 এই সমস্ত পর্যায়ে এসে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  বিজেপি বিরোধী কথাগুলি লোকসভা ভোটের আগে কিছু নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেও ২০১১ তে ক্ষমতায় এসে সামাজিক বিভাজন মূলক এমন কিছু সিদ্ধান্ত তিনি তখন যথারীতি নিয়ে ফেলেছেন যার জেরে  পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের সামাজিকতার আড়ালে যে সাম্প্রদায়িকতার  রাজনীতি, যে রাজনীতির জেরে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ভোট রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়, সেই পর্বটি বেশ ভালোভাবেই সমাধা হয়ে গেছে।                    

এই পর্যায়ে থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ,পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের সাংগঠনিক শক্তি আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।মমতা মুখে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরানোর কথা বললেও মোদির রাজনীতির মূল মস্তিষ্ক আরএসএস যেভাবে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মাটিকে সাম্প্রদায়িকতার আবাদ ভূমি তে পরিণত করছে, সেই সম্পর্কে কিন্তু মমতা বা তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা বা তাঁর প্রশাসন একটি শব্দ উচ্চারণ করছেন না।             

বামফ্রন্ট  সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন যে আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে তাদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি প্রায় করতেই পারেনি ,সেই আরএসএস মমতা ক্ষমতায় আসবার প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই আশ্চর্যজনকভাবে শক্তি বৃদ্ধি করে। পরবর্তীকালে ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের অবহিত পরেই আরএসএসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ,বাজপেয়ী জামানায় তাঁর মন্ত্রিসভায় মমতার সহকর্মী, কুমারী উমা ভারতী প্রকাশ্যেই বলেছিলেন ; প্রায় একশটি আসনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসকে জিততে আর এস এস সাহায্য করেছে।                      

 দীর্ঘকালের কংগ্রেস বিধায়ক , দীর্ঘদিনের বাম শাসনকালেও যিনি খড়্গপুর কেন্দ্র থেকে পরাজিত হননি, কংগ্রেসের সেই প্রবীন  নেতা জ্ঞান সিং  সোহোনপাল কে পরাজিত করে, সেই আসনে বিজেপির দিলীপ ঘোষের জেতা তৃণমূল এবং আরএসএস- বিজেপির যৌথ কর্মসূচিরই একটা অঙ্গ। এই যে প্রক্রিয়া ,তা কিন্তু ধারাবাহিকভাবে চলছে। আমরা দেখছি, মমতা একদিকে মুখে বিজেপি সম্বন্ধে নরম গরম কথা বলছেন, আবার যে মোদিকে একদিন তিনি কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরানোর কথা বলেছিলেন, বিধানসভার ভেতরে সেই মোদিকে তিনি  ঢালাও সার্টিফিকেট দিচ্ছেন।  একদা যেভাবে বাজপেয়ী কে সার্টিফিকেট দিয়ে নিন্দা করতেন আডবানীর , পরবর্তীকালে সেই আদবানী  তাঁর ভালোর তালিকায় ভুক্ত হয়েছিলেন ।এইবার মমতার পরিবর্তিত তালিকায় ভালো হয়ে গিয়েছেন মোদি আর খারাপ হয়ে গিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।  

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় ১২ বছরের শাসনকালে তিনি বিজেপি সম্বন্ধে নরম গরম কথা কখনো সখনো বললেও আরএসএস সম্পর্কে একটা শব্দ কিন্তু তিনি উচ্চারণ করেননি। মমতার এই শাসনকালে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত একাধিকবার পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসেছেন। মমতা তার এই দীর্ঘ শাসনকালে বাম ,কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলিকে কেবল রাজনৈতিক সভা নয় ,শোক সভা পর্যন্ত করতে বহু ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অনুমতি দেন না। আর সেই মমতার প্রশাসন কিন্তু মোহন ভাগবত যখন পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন , তখন তাকে কার্যত জামাই আদর করেছে ।  এখানে বিষয়টি শেষ নয়। মোহন ভাগবত কলকাতায় এসেছেন বা পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোনো জায়গায় এসেছেন,  প্রশাসনকে মমতা সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন ; আরএসএস প্রধানকে ভেট পাঠাতে এবং প্রশাসন সেটা একেবারে ভক্তি গদগদ  চিত্তে তা  করেছে।   

এই রকম একটা অবস্থায় গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আরএসএসের যে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি ,তা কেবল পশ্চিমবঙ্গে নিরিখেই আমাদের ভাবলে চলবে না ।গোটা পূর্ব ভারতকে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি তাদের লক্ষ্যবস্তু করে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের এই সাংগঠনিক প্রচার এবং প্রসার  চালাচ্ছে। আর সেই  কাজ করতে আরএসএসকে সব রকম ভাবে সাহায্য করছেন মমতা নিজে।     আরএসএসের এই সাংগঠনিক বিস্তার কেবলমাত্র ভারতের নিরিখে সীমাবদ্ধ নয়।প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে উৎখাত করবার লক্ষ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ,পাকিস্তান, ইসলামীয় মৌলবাদ এবং ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি  একযোগে কর্মরত রয়েছে ।নানাভাবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিবেশকে বিনষ্ট করে, সেখানকার সংখ্যাগুরু ইসলামী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে  মদত জুগিয়ে বাংলাদেশে একটা  অরাজকতা সৃষ্টির যে ষড়যন্ত্র চলছে ,সেই ষড়যন্ত্রের অন্যতম অংশীদার হলেন মমতা।             

মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনেক মধুর বাক্য উচ্চারণ করলেও বাংলাদেশ হিন্দু সম্প্রদায় কে সংখ্যালঘু মানসিকতা দিয়ে তাতিয়ে ,তাদের  সংখ্যাগুরু  মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা, তাদের ভারতের সম্পত্তি স্থানান্তর করা,  নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পাল্টা হিসেবে সেখানকার প্রশাসনের উপরে আস্থা না রেখে, নিজেদেরও সাম্প্রদায়িক অবস্থান কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রহণ করা– এই সমস্ত পরিকল্পনা র  ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের সাংগঠনিক বৃদ্ধির একটা বিশেষ ভূমিকা আছে ।আর সেই ভূমিকা আরএসএস যাতে খুব ভালোভাবে পালন করতে পারে, সেই জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত সক্রিয়।   বাংলাদেশে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মনস্তত্ত্বকে ব্যবহার করে আরএসএস বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের নানা ধরনের কাহিনী ,অপকাহিনীর প্রচার ঘটিয়ে, ভারতে, বিশেষ করে ,পশ্চিমবঙ্গ ত্রিপুরায় মুসলমান বিরোধী একটা ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি করতে চায়। আর সেই পরিবেশকেই তারা গোটা ভারত জুড়ে সংক্রমিত করতে চায়। বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদের নির্বাচনের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের এই সাংগঠনিক বৃদ্ধি এবং সে সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীরবতা ও কার্যত তার প্রশাসনিক সমর্থন হালকা করে দেখার কোন জায়গা নেই।


সম্প্রতি সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় আরএসএস প্রাথমিক বর্গ নামে দুটি কর্মশালার আয়োজন করেছে।সেই কর্মশালা গুলিতে মতাদর্শগত প্রচারের পাশাপাশি সশস্ত্র, সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ দেবার কাজ ও তারা করবার পরিকল্পনা নিয়েছিল। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুরাগী অনুসারীদের’ নিযুদ্ধ’  নামক এক পরিকল্পনার ভিতর দিয়ে ক্যারাটে ,লাঠিখেলা, শরীর চর্চা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের ছিল ।সেই প্রশিক্ষণ শিবির তারা যথারীতি চালিয়ে যাচ্ছিল নদীয়া জেলার তাহেরপুর এবং নাকাশিপাড়া নামক দুটি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ।               

এই প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর আরএসএস স্বয়ংসেবকদের বাছাই করে করে তাদের আরো মারাত্মক সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয় আর এস এস। চলতি অক্টোবর মাসে  নদীয়া জেলার সীমান্তবর্তী নাকাশীপাড়া সাহাপুর হাই স্কুলে এবং তাহেরপুরের নেতাজি হাই স্কুলে আরএসএস এরকম দুটি প্রশিক্ষণ শিবির চালু করে ।এই প্রশিক্ষণ শিবির গুলি সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন কখনো কোনরকম বাধা তো দূরের কথা ,নেতিবাচক অবস্থান নেয়নি। তাহেরপুরে এই প্রশিক্ষণ শিবির কথা জানাজানি হওয়ার পর ,বিশেষ করে তাহেরপুরে বামপন্থী শক্তির একটা জোরদার ভিত্তি থাকবার দরুন, বামপন্থীদের মতাদর্শ গত অবস্থান রাজনৈতিক প্রচার ইত্যাদির ফলে আরএসএস বাধ্য হয় সেখানকার নেতাজি হাইস্কুলে তাদের এই প্রশিক্ষণ টি বন্ধ করে দিতে ।কিন্তু শিক্ষা দুর্নীতির দায়ে  গ্রেপ্তার হওয়া তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের নির্বাচন কেন্দ্র নাকাশিপাড়াতে আরএসএসের এই ভয়ংকর প্রশিক্ষণ শিবিরটি এখনো চলছে।                তাহেরপুরে আরএসএস শিবির বন্ধ করেছে কি করেনি এ সম্পর্কে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও খুব স্পষ্ট ভাবে কিছু জানতে পারা যাচ্ছে না। কারণ, আরএসএস কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে তারা শিবির বন্ধ করেনি সংশ্লিষ্ট স্কুল থেকে অন্য একটি স্কুলে তারা শিবির স্থানান্তরিত করেছে। গোটা বিষয়টি সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন আজ পর্যন্ত একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি।    

তাহেরপুরের স্কুলটিতে ৭  থেকে ১৪ ই অক্টোবর আরএসএসের এই আবাসিক শিবিরটি হওয়ার কথা ছিল।যথারীতি সেটি শুরু ও হয়েছিল।এই শিবির  ঘিরে বামপন্থী মহলের প্রতিবাদের  পর শিক্ষা দপ্তর একটু নড়েচড়ে বসে। তারা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চান বিষয়টি। সেই সাথে প্রধান শিক্ষককে সরকারি নির্দেশিকা মেনে চলার নির্দেশ শিক্ষা দপ্তর থেকে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে ।    

বামপন্থীদের আন্দোলনের ফলে শিক্ষা দপ্তরের হেল দোলের জেরে ওই স্কুলে আরএসএসের আবাসিক শিবির টি বন্ধ হলেও প্রশ্ন উঠছে হচ্ছে যে,  কেন প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওই ধরনের শিবিরের অনুমতি দিয়েছিলেন?  নদীয়া জেলার নাকাশিপাড়ার সাহাপুর হাইস্কুলে আর.এস এর যে প্রশিক্ষণ শিবিরটি চলছে, সেটি এই প্রবন্ধ লেখার সময়কাল পর্যন্ত বন্ধ করা হয়নি। আরএসএস-এর পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে যে , নাকাশিপাড়ায় যদি আরএসএসের প্রশিক্ষণ শিবির চলতে পারে, সরকার পোষিত  তাহলে তাহেরপুরের স্কুলে কেন চলবে না?  সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক চাপান উতোর  চললেও এই যে আরএসএসের সশস্ত প্রশিক্ষণ শিবিরের অনুমতি প্রদান ,সেই গোটা ঘটনা টির ভিতর রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের , কেন্দ্রের শাসক বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএসের প্রতি সমর্থন, সহানুভূতি সূচক যে মানসিকতা র  বাস্তবায়ন ই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।                       

একের পর এক পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-এর শাখা সংগঠন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নানান ছদ্ম নামে, নামে বেনামে, আরএসএসের শাখা সংগঠন গোটা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলকে প্রায় ছেয়ে ফেলেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় আবরণে আবৃত হয়ে শাখা সংগঠন পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে হিন্দু মুসলমানের বিভাজন সৃষ্টিতে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ সম্পর্কে কিন্তু রাজ্য সরকার বা রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস বা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, যিনি কথায় কথায় নিজেকে বিজেপি বিরোধী আইকন হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন, বিজেপি বিরোধী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন ,তিনি একটি শব্দ আজ পর্যন্ত উচ্চারণ করছেন না।