ইতালিতে ফ্যাসিবাদের বিকাশলাভ ভারতে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। আগেই বলেছি কমিউনিস্টরা প্রথম থেকেই ছিল ফ্যাসিস্টদের প্রধান আক্রমণের লক্ষ্য। ভারতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আর এস এস ও উগ্র হিন্দুত্ববাদের নামে ভারতীয় ফ্যাসিস্টদের সাথে কমিউনিস্টদের কাজ তাই প্রথম থেকেই ভিন্নপথে প্রবাহিত হয়েছে। এটা ছিল এক স্বাভাবিক বিচ্ছেদ। ফ্যাসিবাদের তত্ত্বের সাথে সাম্যবাদের তত্ত্বের মধ্যেই এই বিচ্ছেদের বীজ রয়েছিল। 


গত শতকে কমিউনিস্টরা যখন জমিদারি উচ্ছেদের মতো দাবি নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন, তখন হিন্দুত্বের দোহাই দিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মনোযোগ দেন হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করতে। ১৯২৭ সালে “কৃষক সংগঠন” নামক এক প্রবন্ধে মুজফ্ফর আহমদ লেখেন, “গণবাণীতে আমরা জমিদার প্রথার উচ্ছেদের বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের পাঠকগণ নিশ্চয়ই ভুলে যাননি যে জমিদার বলতে যে-কোনো প্রকারের বড় ভূমধ্যধিকারীকেই মনে করছি। কেবলমাত্র বড় জমিদারের উচ্ছেদ আমরা চাইনে। বড় তালুকদার, বড় জোতদার, বড় গাঁতিদার, বড় জাগীরদার, বড় সর্দার, এক কথায় সকল প্রকারের ভূম্যভিজাত সম্প্রদায়ের উচ্ছেদ সাধনই আমাদের লক্ষ্য।” এই প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন, “সংগঠিত কৃষক যখন ভূমির মালিক হতে চাইবে, যখন সে সুদখোর মহাজনের বিরুদ্ধে মাথা তুলবে, তখন বর্তমান প্রণালীর গবর্নমেন্টের সহিতও তাদের সংঘর্ষ বাধবে। কেননা, যারা বে-রোজগারের ধন খেয়ে জীবনধারন করে থাকে বৃটিশ শোষণতান্ত্রিক গবর্নমেণ্ট তাদেরই সমর্থক।

কাজেই, কৃষকের শ্রেণী-সংগ্রাম একদিক থেকে যেমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম হবে, অন্যদিক থেকে রাষ্ট্রনীতিক মুক্তিরও সংগ্রাম তেমনি তা হবে।” মুজফ্ফর আহমদের লেখা থেকে এটা পরিষ্কার যে, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতে কমিউনিস্টরাও লড়াই সংগ্রামের পথকে শ্রেণী সংগ্রামের সাম্যবাদী নীতির উপরে ভিত্তি করেই রচনা করেছিলেন। এই পদ্ধতিতে উৎপাদন পদ্ধতির উপায়গুলির মালিকানা স্বত্বের আমুল পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আর হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা উৎপাদনের উপায়গুলির মালিকানা স্বত্বের যদি আমুল পরিবর্তন হয় তবে তার সাথে সাথে পরিবর্তন হয় মানুষের চিন্তা চেতনার। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শোষণ যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি ঘটে। আর এর সাথে সাথেই মুক্তি ঘটে ধর্মের আফিমের। মুক্তি ঘটে আধ্যাত্মিক পীড়নের হাত থেকে। এর ফলে পুঁজিবাদের যেমন পরাজয় সুনিশ্চিত করা যায় তেমনই সুনিশ্চিত করা যায় পুঁজিবাদের সবথেকে হিংসাত্মক রূপ ফ্যাসিবাদের পরাজয়কেও। এই সহজ কথাটা বুঝতে ভারতীয় ফ্যাসিস্টরা মোটেই দেরি করেনি। তাই ১৯২৭ সালের ২৮শে এপ্রিল গণবাণীতে মুজফ্ফর আহমদের লেখা অন্য একটি প্রবন্ধ (অর্থনৈতিক অসন্তোষ) প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়েন উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা। এই প্রবন্ধে মুজফ্ফর আহমদ ব্যাখ্যা করে বলেন, হিন্দু মুসলিমের মধ্যে বিরোধের মূল কারণ আসলে অর্থনৈতিক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নির্মম অত্যাচার যার ফলে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। জমিদার জোতদাররাও এই কাজে ব্রিটিশদের সাথেই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। ফলে এর পিছনে ধর্মের বিভাজন কোনো বিষয় নয়, এর পিছনে মূল কারণ আসলে অর্থনৈতিক।


 এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই “আসল কথাটা কি?” নামক প্রবন্ধে মুজফ্ফর আহমদের লেখার বিরোধিতা করে হিন্দুত্ববাদীদের তাত্ত্বিক নেতা বটুক ভৈরব লেখেন, “….একটা নতুন থিওরি খাড়া না করলে আর মুখ রক্ষা হয় না। কাজেই আমাদের সাম্যবাদী সহযোগী গণবাণী একটা নূতন থিওরি নিয়ে আসরে নেমেছেন। তিনি বলছেন-,’বাংলা দেশের নানা স্থানে যে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ বেধে উঠেছে এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অর্থনৈতিক অসন্তোষের ওপরে’।…” প্রথম দিন থেকেই এইভাবে কমিউনিস্টদের সাথে ভারতীয় ফ্যাসিস্টদের বিচ্ছেদ বা ব্যবধান তাত্ত্বিক জগতে গড়ে ওঠে যা ক্রমশ ক্রমশ আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তা চরম আকার ধারণ করে। বিশেষত হিটলারের বাহিনী ‘অপারেশন বারবারোসা’র মাধ্যমে সোভিয়েত আক্রমণ করার পর কমিউনিস্টদের ও আর এস এসের নেতাদের বক্তব্য থেকে এই বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথকে ফ্যাসিস্টরা কিভাবেই বা সমর্থন করতে পারতো? তাই এই বিভাজন ও বিতর্ক ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত। 


পন্ডিত নেহরু কিন্তু প্রথম থেকেই হিন্দুত্ববাদী এই উগ্রপন্থীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই তিনি ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে এবং ফ্যাসিস্টদের সমস্ত পরিকল্পনাকে বানচাল করতে সদা সতর্ক ছিলেন। তাই হয়তো RSS ও বিজেপির নেতার আজও পন্ডিত নেহরুর সমালোচনায় মুখর হন। কেননা কংগ্রেসের মধ্যে পন্ডিত নেহরু সত্যি সত্যিই আর এস এসের ফ্যাসিস্ট কায়দা কানুনগুলি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা তিনি করতে পারেননি। ভারতের স্বাধীনতার সাথে সাথেই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট নাথুরামের হাতে খুন হন মহাত্মা গান্ধী। নাথুরামের হাতে মহাত্মা গান্ধী খুনের পর প্রথমবার আর এস এস নিষিদ্ধ ঘোষণা হওয়ার সময় কংগ্রেসের মধ্যে একটি গোপন প্রতিবেদনে প্রচারিত হয়। এই প্রতিবেদনে আর এস এসের সাথে ফ্যাসিস্টদের সাদৃশ্যগুলি তুলে ধরা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল-
🔴 আর এস এসের সূচনা নাগপুরের একধরনের হিন্দু বয়েজ স্কাউট আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। ধীরে ধীরে তা সাম্প্রদায়িক জঙ্গী ও হিংস্র প্রবণতা সম্পন্ন হয়ে ওঠে।
🔴 আর এস এস পুরোদস্তুর মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ প্রভাবিত সংগঠন ছিল। তাই মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অ-ব্রাহ্মণদের প্রতি কোন সহানুভূতি নেই।
🔴 এমনকি অন্য প্রদেশগুলিতেও প্রধান সংগঠক ও পুরো সময়ের কর্মীরা নিশ্চিত ভাবেই ছিলেন মহারাষ্ট্রীয়।
🔴 আর এস এসের মাধ্যমে মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণরা ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর ভারতে ‘পেশওয়া রাজ’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। আর এস এসের পতাকা হলো পেশওয়াদের ‘ভগওয়া ধ্বজা’। পেশওয়ারা ব্রিটিশদের কাছে সবার পরে হার মেনেছে। তাই, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানেরপর মহারাষ্ট্রীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা আসা উচিত।
🔴 আর এস এস ফ্যাসিবাদকে লালন-পালনের উদ্দেশ্যে গুপ্ত, হিংসাত্মক পদ্ধতি চর্চা করে। সত্যনিষ্ঠতা এবং সাংবিধানিক পথকে এরা পরোয়া করে না। 
🔴 এই সংগঠনের কোন সংবিধান নেই। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত নয়। সাধারণ মানুষকে শুধু এইটুকুই জানানো হয় যে, আর এস এসের একমাত্র লক্ষ্য হলো শরীরচর্চা। আসল উদ্দেশ্যটা এমনকি এর সক্রিয় কর্মীদের থেকেও আড়াল করে রাখা হয়। একমাত্র ‘অভ্যন্তরীণ বৃত্তে’র মুষ্টিমেয় মানুষের গোচরে থাকে সংগঠনের প্রকৃত পরিকল্পনা। 
🔴 আর এস এসের কোন নথি বা কার্যবিবরণী নেই। সদস্য তালিকাও রাখা হয় না। এছাড়া আয়-ব্যয়েরও কোন হিসাব নেই। অর্থাৎ সংগঠনের দিক থেকে আর এস এসের কার্যকলাপের মধ্যে গোপনীয়তা রয়েছে। তাই একে…..


[National Archives of India (NAI), Sardar Patel Correspondenec, Microfilm, reel no 3, A Note on the RSS, undated]
আশ্চর্যজনক ভাবে প্রতিবেদনটি এখানেই থেমে যায়। কিন্তু এই প্রতিবেদন থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আর এস এসের কার্যকলাপ এবং তাদের ফ্যাসিস্ট চরিত্র সম্পর্কে কারও মনেই কোনো সংশয় ছিল না এবং তাদের একটি উগ্রপন্থী সংগঠন বলেই চিহ্নিত করা হতো। এখন এটা বোঝা দরকার যে আর এস এস এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বীজ কিভাবে রোপন হয়েছিল। 


আর এস এসের সাথে ইতালির ফ্যাসিবাদের সম্পর্কটি বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে ১৯২০ সাল ও তার পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটটি। এই আগ্রহের ভিত্তিভূমিও সেই মহারাষ্ট্র। ১৯৩১ সালে বি এস মুঞ্জের ইতালিতে যান। মুঞ্জের-এর ইতালি ভ্রমণ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয় উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের মনে। মুঞ্জেরের ইতালি ভ্রমণের আগে থেকেই মুসোলিনি ও ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আর এস এসপন্থীরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাই এরা কখনও ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতায় গিয়েছেন আবার কখনও ফ্যাসিস্ট একনায়কদের প্রতি দুর্বলতা দেখিয়েছেন। শরীর চর্চার মুখোশের আড়ালে আসলে তারা সশস্ত্র হতে চেয়েছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সমস্ত বিরোধী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে এবং অতি অবশ্যই কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার অভিপ্রায় তাদের কোনো দিনই ছিল না।হিন্দুত্ববাদীদের অন্যতম নেতা সাভারকর তো বারবার তার অনুগামীদের এই কথা মনে করিয়ে দিতেন যে, “ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা নিজেদের শক্তিক্ষয় করতে পারি না।” 


মুসোলিনি ও ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ প্রভাবিত আর এস এস নেতাদের উৎসাহ শুধু মাত্র সামরিক কৌতূহল ছিল বললে, উৎসাহের মাত্রা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। আবার এই উৎসাহ যে কিছু সংখ্যক মানুষকেই পেয়ে বসেছিল একথাও ঠিক নয়। আসলে এ ছিল উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের ইতালির স্বৈরাচারী একনায়ক মুসোলিনি ও তার মতামত সম্পর্কে এক গভীর মনোযোগের ফলশ্রুতি। তারা মনে করতো, এটাই হলো রক্ষণশীল বিপ্লবের নমুনা। আগামী পর্বে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। 
চলবে….
_____________________________________
গ্রন্থ সূত্র: প্রবন্ধ সংকলন: মুজফ্ফর আহমদ। (১৯৭০)
মহাফেজখানার দলিল : মারিয়া কাসোলারি