১৯৩১ সালে বি এস মুঞ্জে ইতালিতে যান। সেসময় তিনি ইতালির ফ্যাসিস্ট তৈরি করার কারখানাগুলি পরিদর্শন করেন। নামে শিক্ষা কেন্দ্র হলেও আসলে সেগুলি ছিল একপ্রকার কারখানাই, ফ্যাসিস্ট তৈরির কারখানা। এরপর তিনি মুসোলিনি সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকারটি তিনি নিজের ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করেন। ১৯৩১ সালের ১৯শে মার্চ মুঞ্জে ও মুসোলিনীর সাক্ষাৎ হয়েছিল। মুঞ্জে নিজের ডাইরিতে লেখেন- যে মুহূর্তে ঘরের দরজায় আমি পৌঁছলাম, তিনি (মুসোলিনি) চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। করমর্দন করে আমি নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি আমার সম্বন্ধে সবকিছুই জানতেন এবং মনে হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তিনি বেশ খোঁজখবর রাখেন। গান্ধীর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। তিনি চেয়ার টেনে আমার সামনে বসলেন এবং প্রায় আধঘণ্টা আমাদের ভেতর কথাবার্তা চলল।

তিনি গান্ধী ও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চাইলেন এবং প্রশ্ন করলেন “গোলটেবিল বৈঠক ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে শান্তি আনতে পারবে কি?” আমি বললাম, যদি ব্রিটিশরা, তাদের সাম্রাজ্যের অন্যান্য ডোমিনিয়নগুলোর সমান মর্যাদা আমাদের দিতে ইচ্ছুক হয়, তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতর শান্তিতে ও অনুগত হয়ে থাকতে আমাদের কোন আপত্তি নেই; অন্যথা নতুন করে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম শুরু হবে। ভারত যদি তার প্রতি বন্ধুমনোভাবাপন্ন ও শান্তিকামী হয়, তবেই ব্রিটেনের লাভ এবং সে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে থাকতে পারবে। আর সেটা সম্ভব ভারত ডোমিনিয়ন মর্যাদা পেলেই। মনে হল সিনর মুসোলিনীর আমার কথাটা মনে ধরেছে। এরপর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি কিনা ? আমি জানালাম, আমার আগ্রহ ছেলেদের সামরিক প্রশিক্ষণে আর তাই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং জার্মানির সামরিক স্কুলগুলো দেখার পর ইতালিতে এসেছি এই একই উদ্দেশ্যে। আমি কৃতজ্ঞ যে, বিদেশ ও যুদ্ধবিভাগ এগুলো দেখানোর চমৎকার বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমি আজই সকালে আর বিকেলে Balilla এবং অন্যান্য ফ্যাসিস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দেখে চমৎকৃত হয়েছি। দেশের বিকাশ ও প্রগতির জন্য ইতালির এগুলোর প্রয়োজন রয়েছে। খবরের কাগজে এইসব প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সিনর আপনাকে নিয়েও অনেক বিরূপ মন্তব্য পড়েছি। কিন্তু, আমি এদের মধ্যে কোন আপত্তিকর বিষয় দেখিনি।


সিনর মুসোলিনি:  এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্বন্ধে আপনার অভিমত কি? 
মুঞ্জে:  হে মহামহিম, আমি যথেষ্ট মুগ্ধ হয়েছি। প্রতিটি উন্নতিকামী জাতির এগুলে দরকার। সামরিক পুনরুত্থানের জন্য, বিশেষ করে ভারতের এর প্রয়োজন আছে।দেড়শ বছরে ব্রিটিশ আধিপত্যে থাকাকালীন, ভারতীয়দের সামরিক পেশা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, ভারত এখন নিজেকে রক্ষার দায়িত্ব পালনে প্রস্তুতি নিতে চায়। আমি সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আমি নিজের একটা সংগঠনও তৈরি করেছি। সুযোগ এলে, ভারত ও ইংল্যান্ড—দু জায়গাতেই প্রকাশ্য মঞ্চে আমি জোর গলায় আপনার Balilla এবং ফ্যাসিস্ত সংগঠনগুলোর প্রশংসা করব। আমি এদের শুভেচ্ছা জানাই এবং সাফল্য কামনা করি।
সিনর মুসোলিনি (যাকে বেশি খুশি খুশি লাগছিল) বললেন ‘ধন্যবাদ, কিন্তু আপনার কাজটা যথেষ্ট কঠিন। যাই হোক, আমিও আপনার সাফল্য কামনা করি। কথা শেষ করে আমরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম ” মুঞ্জের ইতালি ভ্রমণের বর্ণনায় ফ্যাসিবাদের ইতিহাস, ফ্যাসিস্ত ‘বিপ্লব’ এবং আরও সংশ্লিষ্ট তথ্য লিপিবদ্ধ ছিল।


মুঞ্জে আর এস এস-র অনুষঙ্গের বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা জানি যে, তিনি হেডগেওয়ারের প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন। উভয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব এবং মুঞ্জের আর এস এস-ও শক্তিশালী ও সর্বভারতীয় সংগঠনে পরিণত করার ঘোষিত লক্ষ্য তার সাথে আর এস এস জোরালো যোগসূত্রকে প্রমাণ করে। এটা বলা ভুল হবে না যে, উগ্র হিন্দুবাদের সম্পূর্ণ চক্রটাই মুঞ্জের ইতালিয় অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। 


ভারতে ফিরে আসার পরেই মুখে তার রোজনামচায় উল্লেখিত সামরিক বিদ্যালয় স্থাপন এবং মহারাষ্ট্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের পান্তরে আত্মনিয়োগ করেন। পুণেতে পৌঁছেই তিনি The Mahratta পত্রিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের সামরিক পুনর্গঠনে, মুঞ্জে জোর দেন সৈন্যবাহিনীর ‘ভারতীয়করণের প্রয়োজনীয়তার ওপর। তিনি আশাপ্রকাশ করেন যে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের তার একজন ভারতীয়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে। মুঞ্জে শেষ পর্যন্ত ইতালি ও জার্মানি প্রসঙ্গ টেনে বলেন ।
“আমাদের নেতাদের জার্মানির যুব আন্দোলন এবং Balilla ও ইতালির অন্যান্য ফ্যাসিস্ত সংগঠনগুলোকে অনুকরণ করা উচিত। এগুলো ভারতে প্রয়োগ করার পক্ষে পুরোপুরি উপযোগী বলে আমার মনে হয়।”


খুব দ্রুত ফ্যাসিবাদ প্রকাশ্য আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে এবং হেডগেওয়ার নিজে ফ্যাসিস্ট ধাঁচে হিন্দু সমাজের সামরিকীকরণের সপক্ষে অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। ১৯৩৪-র ৩১ জানুয়ারি কভেদ শাস্ত্রী আযোজিত ফ্যাসিবাদ ও মুসোলিনী সংক্রান্ত একটি সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। মুঞ্জে সমাপ্তি ভাষণ দেন। এর কিছুদিন পরে, ৩১ মার্চে, মুখে, হেডগেওয়ার এবং লালু গোখলে হিন্দুদের জার্মান ও ইতালিয় পথে সামরিক সংগঠন গড়ে তোলা নিয়ে
লালু – আপনি (মুঞ্জে হিন্দু সভার প্রধান এবং হিন্দুদের সংগঠনের প্রচারক। হিন্দুদের পক্ষে কী কখনো সংগঠিত হওয়া সম্ভব ?
মুঞ্জে- আমি হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রের ভিত্তিতে একটি কার্যক্রমের কথা ভেবেছি। ধর্মশাস্ত্ৰ অনুযায়ী সারা ভারতে হিন্দুধর্মের একটা সাধারণ মানদণ্ড তৈরি করা সম্ভব… কিন্তু আসল কথা হলো এই আদর্শকে বাস্তবায়িত করা ততক্ষণ সম্ভব নয়, যতক্ষণ না আমাদের স্বরাজ অর্জিত হচ্ছে এবং সেখানে পুরনো দিনের শিবাজী আর অধুনা হিটলার বা মুসোলিনির মতো একজন হিন্দু একনায়ক আসছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যতদিন এরকম একজন একনায়কের আবির্ভাব না ঘটছে, ততদিন আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব। আমাদের বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করে এর জন্য প্রচার চালাতে হবে (Moonje Papers NMMI Moonje Papers, microfilm, Diary mm2. 1932-36) |


মুঞ্জে এবং আর এস এস-র মধ্যে নিবিড় নৈকট্য এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটির ফ্যাসিস্ট স্বরূপ ব্রিটিশ সূত্রের দ্বারাও সমর্থিত হয়েছে। ১৯৩৩-এ প্রকাশিত একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে (Note : on the Rashtriya Swayam Sewak Sangha) জানা যাচ্ছে যে, ১৯২৭-এ মধ্যপ্রদেশ ও মারানী ভাষাভাষী অঞ্চলে মুখে আর এস এস কে ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উল্লেখিত নবি আর এস এস-র কার্যকলাপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনার সূত্রে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে
‘এটা বলা বোধহয় বাড়াবাড়ি হবে না যে, আর এস এস ভারতে ভবিষ্যতে ঠিক সেই ভূমিকা নিতে চায়, যেমনটা ইতালিতে ‘ফ্যাসিস্ত এবং জার্মানিতে নাৎসিরা নিয়েছে।


(NAL Home Pol. Department 88/33 1933)
সব মিলিয়ে এটা পরিষ্কার যে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা একজন ক্ষমতাশীল নেতার ভাবমূর্তিতে আকৃষ্ট হয়েছিল। তাছাড়া, তারা তাদের সংগঠনকে একটি জোরদার কেন্দ্রাভিমুখী চরিত্র দিতেও আগ্রহী ছিল।
ইতালির ফ্যাসিবাদী শক্তির সাথে মুঞ্জের যোগাযোগ ভাবাদর্শ তথা সাংগঠনিক স্তরে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। মুখে হিন্দু সম্প্রদায়ের সামরিকীকরণের কাজে তাঁকে সাহায্য করতে পারেন, এমন লোকজনদের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। ১৯৩৪-এ তিনি তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান Bhonsla Military School তৈরির উদ্যোগ শুরু করেন। এই লক্ষ্যে একই বছরে মুখে কেন্দ্রীয় হিন্দু সামরিক শিক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন। সমিতির লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের সামরিক পুনর্জাগরণ ঘটানো এবং হিন্দু তরুনদের মাতৃভূমি রক্ষার দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করে তোলা। “সনাতন ধর্মে” তাদের দীক্ষিত করা। “আত্মরক্ষা ও স্বদেশ রক্ষায় বিজ্ঞান ও কলায় তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া (Moonje Papers পূর্বোল্লেখিত)
মুঞ্জের কার্যক্রম তাই সম্পূর্ণভাবেই হিন্দু সমাজের প্রতি নিবেদিত, সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সমাজের প্রতি নয়। তাঁর পরিকল্পিত ‘হুল’ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করতে পারে এমন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে পাঠানো একটি দলিলে মুখে ফ্যানিন্ত ইতালি ও নানি জার্মানির প্রসঙ্গ টেনেছেন খোলামেলাভাবেই। এতে লেখা হয়েছিল।


“এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য আমাদের ছেলেদের গণহত্যার খেলায় যোগ্য করে তোলা। শাদের সাথে যুদ্ধজয়ে নিজেদের রক্তপাত যত কম আর বিপক্ষের লোকক্ষ বেশি হয়, ততই ভালো। (Moonje Papers পূর্বোল্লেখিত)
মুখে ‘শত্রুপক্ষ’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত দেননি। ‘শত্রু’ বাইরের অর্থাৎ ব্রিটিশ কিনা অথবা তা ঐতিহাসিক ভেতরের দুশমন-মুসলিমরা। আলোচ্য দলিলে হিংসা ও অ-হিংসার মধ্যে সম্পর্ককে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। ভারতের ইতিহাস এবং হিন্দুদের শাস্ত্র থেকে অজস্র উদাহরণ তুলে সংগঠিত হিংসাকে (জঙ্গীবাদের চেহারায় যথার্থতা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। অপরদিকে অ-হিংসাকে সংসার বিমুখীনতা ও কাপুরুষোচিত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। মুজের মতামত মুসোলিনির ধারণার সাথে প্রায় পুরোপরি মিলে যায়:- 
….একই ধরনের চিন্তা সিনর মুসোলিনিও ব্যক্ত করেছেন, তবে আরও জরালো ও সরাসরি ভাষায়, যখন তিনি বলেন: “ইউরোপের সাথে আমাদের শাস্তি ও সহযোগিতা আকাঙ্ক্ষা নির্ভর করে আছে লক্ষ লক্ষ ইস্পাতের বেয়নেটের ওপর।”
চলবে….
——————————————————————
গ্রন্থ সূত্র: মহাফেজখানার দলিল 
আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ