ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের উপর ফ্যাসিবাদের জনক মুসোলিনির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে হলে এই ধারণাটা থেকে সর্বপ্রথমে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে যে, মুসলিনির প্রতি এই অনুরাগ শুধুমাত্র সাময়িক ছিল। আবার সাথে সাথে এটাও পরিষ্কার ভাবে বলা দরকার যে এই আগ্রহ নিছকই ভাবসর্বস্ব ছিল না। এই আগ্রহ আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মারাঠা ব্রাহ্মণদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এই আগ্রহ তৈরি হয়েছিল ইতালির ফ্যাসিস্ট শক্তি মুসোলিনির প্রতি হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের গভীর মনোযোগের চূড়ান্ত ফলশ্রুতি হিসেবে। মারাঠী ব্রাহ্মণরা ফ্যাসিবাদকে রক্ষণশীল বিপ্লবের অংশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। 


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্থির ইতালির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সামলেও যেভাবে মুসোলিনি ইতালিকে বিশ্বের দরবারে এক শক্তিশালী দেশ হিসেবে পরিচিত করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, এর দ্বারাই আর এস এস নেতাদের আগ্রহ তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। তাদের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সেকথার প্রচার তারা লাগাতার ভাবে করতে থাকেন। ধীরে ধীরে এই প্রচারের সাথে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও  হিন্দুত্ববাদী লাইনগুলি যুক্ত হতে থাকে। এমনই এক হিন্দুত্ববাদী পত্রিকা ছিল ‘কেশরী’। মারাঠী ভাষায় এটা প্রকাশিত হতো। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে ফ্যাসিবাদ ও মুসোলিনির প্রশংসা করে নিয়মিত ভাবে একাধিক প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় কেশরী পত্রিকায়। পিছিয়ে পড়া ইতালিকে কিভাবে বিশ্বের দরবারে সামনের সারিতে এনে হাজির করেছেন মুসোলিনি, সে সম্পর্কে কেশরীতে থাকতো গভীর বিশ্লেষণ, এবং মুসোলিনির সম্পর্কে থাকতো ভূয়সী প্রশংসা। মুসোলিনির বাকচাতুর্য্যের দ্বারা হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা অনুপ্রাণিত হয়েছিল এবং সেই কথাই তারা প্রচার করে চলেছিল সাথে সাথে নিজেরাও মুসোলিনির দার্শনিক চিন্তা দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে ফ্যাসিবাদকে আঁকড়ে ধরে উগ্র জাতীয়তাবাদের নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল নিজেদের দার্শনিক চিন্তাকে। বিশেষত ফ্যাসিবাদ যখন সামাজিক দ্বন্দ্বকে উপেক্ষা করে সেই জায়গায় ‘নৈরাজ্য থেকে শৃঙ্খলার পরিবেশে উত্তরনের’ তত্ত্ব হাজির করে তখন ‘কেশরী’ পত্রিকায় এই তত্ত্বকেই ‘আদর্শবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে ছাপা হয় একাধিক নিবন্ধ। ১৯২৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি কেশরী পত্রিকায় মুসোলিনির রাজনৈতিক সংস্কার সমূহ, বিশেষ করে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদের সদস্য নির্বাচিত করার পদ্ধতির বদলে মনোনীত করার পদ্ধতিকে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়। বিরাট উৎসাহের সাথে নির্বাচিত সংসদের বদলে ইতালির ‘গ্র্যান্ড কাউন্সিল অফ ফ্যাসিজম’কে স্বাগত জানান আর এস এসের নেতারা। এভাবে গনতন্ত্রের বদলে প্রথম দিন থেকেই ভারতের ফ্যাসিস্ট আর এস এস মুসোলিনির দার্শনিক চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। মুসোলিনির কথার দ্বারা, তার ফ্যাসিবাদের প্রতি আর এস এসের নেতারা এতটাই প্রভাবিত হয়ে ওঠে যে, ১৯২৮ সালের ১৭ই জুনের সেই নিবন্ধে মুসোলিনির একটি বক্তৃতা হুবহু কপি করে কেশরী পত্রিকায় লেখা হয়, “গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় একনায়কতন্ত্র জাতির পক্ষে অনেক বেশি উপযোগী ও সংহতি-সহায়ক”। এভাবেই মারাঠী ব্রাহ্মণ প্রভাবিত আর এস এসের নেতারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের নীতিকে খোলাখুলি ভাবে ফ্যাসিবাদের সাথে সংগতি বজায় রেখে গড়ে তোলে। 


‘ইতালি এবং নতুন প্রজন্ম’ নামে ১৯২৯ সালের ১৩ই আগস্ট কেশরী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এক দীর্ঘ প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে আগ্রহের সাথে বলা হয়, নতুন প্রজন্মের হাতে কিভাবে ইতালি এগিয়ে চলেছে তার হালহকিকত। ফ্যাসিস্ট ধাঁচে ইতালির পুনর্গঠন নিয়েও আলোচনা হয়। ইতালির যুব সমাজের নিয়মানুবর্তিতার মূল কারণ যে ধর্মীয় আবেগ তা জোরালো ভাবে বলা হয়। এবং এই আবেগের সাথে সাথে পরিবারের প্রতি অনুরাগ, চিরাচরিত মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা, বিবাহবিচ্ছেদের বিরোধিতা, নারীদের একা থাকার ব্যপারে তীব্র আপত্তির কথাও জানানো হয়। এর সাথেই মনুবাদী চিন্তা চেতনার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নারীদের ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণে বাঁধার এবং তাদের অন্তঃপুরে থেকেই ঘরসংসার চালানোর ফ্যাসিবাদী আইনকে মিলিয়ে মিশিয়ে আদর্শ হিন্দু জাতীয়তাবাদী লাইন প্রস্তুত করার কথা মুক্ত ভাবে ঘোষণা করা হয়। 


এখন এই প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক যে পরাধীন ভারতে বসে মারাঠী ব্রাহ্মণেরা ফ্যাসিস্ট ইতালি সম্পর্কে এতো তথ্য কি ভাবে সংগ্রহ করেছিলেন? ১৯২৮ সাল থেকে এক ইতালিয়’র সম্পাদনায় একটি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশিত হতো যাঁর নাম ছিল- “THE RECENT LAWS FOR THE DEFENCE OF THE STATE”. এই পত্রিকার অনুলিপি জাতীয় মহাফেজখানার বৈদেশিক ও রাজনৈতিক বিভাগে সংরিক্ষত রয়েছে (647G, 1927)। আর এস এস গঠনের প্রথম দিন থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর উপর জোড় দেওয়া হয়েছিল। যাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল- ‘বিপ্লবের দেহরক্ষী’ বলে। [ নিজেকে চৌকিদার বলে মোদীজীর দাবির ভিত্তিভূমিও এটাই ]। এখানে ফ্যাসিস্ট জামানার বিভিন্ন দমনমূলক ব্যবস্থাগুলি, বিরোধী দলগুলোকে সব নিষিদ্ধ ঘোষণা, সমস্ত মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ, ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের বিরোধীদের সরকারি পদ থেকে অপসারণ এবং অবশেষে মৃত্যুদন্ড -এই সবকিছু নিয়ে ঢালাও প্রচার করা হতো। 


১৯২৭ সালে কেশরীর লন্ডনের সংবাদদাতা মুসোলিনির গুণমুগ্ধ ডি ভি তামাঙকার “MUSSOLINI AND FASCISM”  নামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন, সেখানে ফ্যাসিস্টদের সংগঠন, সামাজিক অবস্থা, ভাবাদর্শ ও ইতালির সাম্প্রতিক অতীত নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়। একটা পুরো অধ্যায় তিনি লেখেন ফ্যাসিস্ট সমাজ এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলি, বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থা ও যুব সমাজের চরিত্র গঠন নিয়ে। তামাঙকারের এই প্রবন্ধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এই প্রবন্ধটির মাধ্যমেই জিওভান্নি জেনটাইলের (ফ্যাসিবাদী দার্শনিক ও মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী) আদর্শবাদ ও তার প্রবর্তিত শিক্ষা নীতির কথাকে তুলে ধরে এর ভিত্তিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী লাইনের শিক্ষা নীতির কথা বলা হয়, যার বেশিরভাগ অংশের প্রতিফলন বর্তমানে বিজেপির শিক্ষানীতি হিসেবে আমারা দেখতে পাচ্ছি। যদি অবকাশ পাই তবে এই শিক্ষানীতির বিষয়ে পরবর্তী পর্বে কিছু বলবার চেষ্টা করবো। তবে এই কথাটা বলা খুব দরকার যে, ১৯২০ সাল থেকে গোটা দশক ধরে যেভাবে ইতালি ও তার ফ্যাসিস্ট জামানা বিশেষত মুসোলিনিকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কাজে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছিল তা ছিল জিওভান্নি জেনটাইলের অনুসৃত শিক্ষানীতি ও আদর্শবাদেরই হুবহু কপি। এবং তাদের সব থেকে বেশি আকর্ষণ করেছিল, সশস্ত্রবাহিনীর গঠন এবং রূপান্তর অর্থাৎ নৈরাজ্য থেকে শৃঙ্খলায় উত্তরণের তত্ত্বটি। গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী মতামতকে গনতন্ত্রের সদর্থক পরিবর্ত রূপে বর্ণনা করা। এভাবেই মুসোলিনির ইতালি থেকে হিংসার রাজনীতিকে ভারতে আমদানি করেছিল আর এস এসের নেতারা। যা এখন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বিশেষত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ভারতীয় ফ্যাসিস্ট আর এস এসের নেতারা যখন গুজরাট দাঙ্গার মধ্যে দিয়ে ফাইনাল সলিউশেনে পৌঁছায়, তারপর থেকেই তাদের রূপ আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। ফ্যাসিবাদের উত্থানের ফল স্বরূপ ইতালির জনগণকে জীবন দিয়ে তার মাশুল দিতে হয়েছে, আমাদেরও ফ্যাসিস্টদের মোকাবিলায় হয়তো আরও মাশুল দিতে হবে, কিন্তু ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এই কাজকে অগ্রাহ্য করা মানে হলো আগুনের লেলিহান শিখার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শিশু সন্তানের হাতটা ছেড়ে দেওয়া। এই কাজ আমরা করতে পারি না। তাই, ফাইট ফাইট এবং ফাইট… চলবে…..
——————————————————————–গ্রন্থ সূত্র: 1) ফ্যাসিবাদের অতীত ও বর্তমান: সুকমল সেন
2) ফ্যাসিবাদের উত্থান: একটি পুনর্পাঠ  — মানব মুখার্জি 
3) মহাফেজখানার দলিল