ভারতে ফ্যাসিবাদের জন্ম হয় গত শতকের কুড়ির দশকে। ইউরোপেও সমসাময়িক সময়কালের মধ্যেই ফ্যাসিবাদ বিকাশলাভ করতে থাকে। তাই এই দশকটিকে (১৯২১-১৯৩০) ফ্যাসিবাদের উত্থানের দশক হিসেবে চিহ্নিত করাই যায়। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এই মতবাদ কিন্তু কুড়ির দশকে ভ্রুণ অবস্থাতেই ছিল। তিরিশের দশকে এসে এর পূর্ণতা পায়। এই সময় থেকেই ফ্যাসিস্টরা খোলাখুলি ভাবে তাদের আপন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করতে থাকে। নিজেদের সংগঠনকেও সেই অনুযায়ী সাজানোর জন্য ঢালাও কর্মসূচির কথা উচ্চারিত হতে শোনা যায় ফ্যাসিস্ট নেতা-নেতৃত্বদের মুখে। আন্তর্জাতিক এই নয়া পরিস্থিতিতে ভারতে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। 


দীর্ঘদিনের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ভারতের আমজনতা ছটফট করছিলেন। যেকোনো মূল্যেই তারা স্বাধীনতা চাইছিলেন। এমনকি স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান দিতেও প্রস্তুত ছিলেন তারা। অধীর আগ্রহ নিয়ে তাই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে। এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় ফিলাফৎ আন্দোলনের ধারা যা ক্রমশ ক্রমশ হিন্দু-মুসলিমের বিভেদকে বর্জন করে সমগ্র ভারতীয়দের একত্রিত করতে সাফল্য দেখাচ্ছিল। কংগ্রেস ও খিলাফৎ আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার কোনঠাসা হয়ে যাচ্ছিল। নেতৃত্বের প্রশ্নেও হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে আগামী দিনের যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাককাল থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৯১১ সালে সাপ্তাহিক কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা “দ্য কমরেড”-এ লেখেন, “if the Muslims or Hindus attempt to achieve success in opposition to or even without the co-operation of one another, they will not only fail but fail ignominiously.” ১৯১৬’র চম্পারন সত্যাগ্রহ চলাকালীন মজহরুল হক গান্ধীজীকে আলি ভাইদের মুক্তির জন্য সচেষ্ট হতে অনুরোধ করেন। গান্ধীজীও তাঁর কথায় সহমত পোষণ করেন এবং পরবর্তী সময়ে (১৯১৭ সালের লীগের সভাতেও) আলিভাইদের মুক্তির জন্য সওয়াল করেন।১৯১৮ সালের শেষের দিকে একটি চিঠিতে গান্ধীজী মহম্মদ আলিকে লেখেন, “আপনার মুক্তিতে আমার আগ্রহ স্বার্থঘটিত। আমাদের উদ্দেশ্য এক এবং তা অর্জন করতে আপনার সাহায্য পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করতে চাই। মুসলিম প্রশ্নের যথাযথ সমাধানেই স্বরাজলাভ সম্ভব।” অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে কুড়ি দশকের আগে থেকেই কি সাধারণ মানুষের মধ্যে কি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের মধ্যেই নিজেদের মধ্যেকার সমস্ত বিভেদকে দূর করে স্বাধীনতার প্রশ্নের এক হওয়ার জন্য ব্যাকুল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, এবং তারা চাইছিলেও তাই। হিন্দু-মুসলিমের এই যৌধ কর্মসূচি সাধারণ মানুষের মনেও ব্যাপক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। দেশের শ্রমজীবী মানুষেরাও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ নিতে থাকেন। আন্দোলনের চেহারা চরিত্র দেখে ব্রিটিশরাও শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। 
এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক রঙ্গ মঞ্চে ঘটে এক অভিনব ঘটনা। রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পৃথিবীর বুকে প্রথম সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়। তৈরি হয় সোভিয়েত। সোভিয়েত ঘঠনের সাথে সাথে পৃথিবীর সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়, আগ্রহ তৈরি হয় এই বিপ্লবের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে। উল্টো দিকে সোভিয়েত গঠনের প্রথম দিন থেকেই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি সোভিয়েতের বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। 
ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে জন্মলাভ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের স্বাধীনতাকেই পাখির চোখ করেছিল কমিউনিস্টরা। কমিউনিস্টরাই প্রথম পূর্ণ স্বরাজের দাবি করেন। এই কাজকে গুরুত্ব দিয়ে তারা শ্রমিক-কৃষকের মজবুত জোট তৈরি করার লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেন। 


এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কংগ্রেস-খিলাফৎ যৌথ মঞ্চে যে সমস্ত হিন্দু মুসলিম নেতৃত্বরা ছিলেন তারা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের এবং ব্যাপক জনগণের প্রকৃত মনের কথা, তাদের দুঃখ যন্ত্রণার কথা বলার থেকেও নিজেদের নেতৃত্বকে জাহির করার বিষয়েই বেশি আগ্রহী ছিলেন। ফলে আন্দোলনের ধ্বনিতে আকাশে মেঘ জমলেও তা স্বাধীনতার বৃষ্টি আকারে তৃষিত ভারতবাসীর বুকে এসে বর্ষিত হলো না। তাই, অযাচিত ভাবে আন্দোলনের পথ থেকে গান্ধীজী সরে আসবার প্রায় সাথে সাথেই হিন্দু-মুসলিম উভয়ই যেটুকু ঐক্যের পথ হেঁটে এলেন তাও বিলুপ্ত হলো। ধীরে ধীরে ভারতের মুসলিম নেতৃত্বরাও খিলাফৎ-এর অমোঘ বাণী থেকে সরে আসতে থাকলেন, এবং তাদের মধ্যে মুসলিম লীগের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেতে লাগলো। গান্ধীজীর ভুল মুসলিম নীতির ফলে এই বিভাজন তো প্রশমিত হলোই না উল্টে বৃদ্ধি পেতে লাগলো। সব বিষয়ে মুসলিম নেতৃত্বের সাথে আপোসের নীতি তাদের (লীগের নেতাদের) ক্রমশ বলবান করে তুললো। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বৃদ্ধি পেতে লাগলো হিন্দুত্ববাদীদের। জাতীয়তাবাদের বুলি কপচিয়ে তারা মুসোলিনির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ফ্যাসিস্ট কায়দায় সংগঠন গড়ে তুলতে লাগলো। ফলে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই একে অপরের সহযোগিতার হাত ছেড়ে দিয়ে প্রতিযোগিতার রাস্তা বেছে নিতে থাকলেন। 


ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়ে ওঠার আরও একটি কারণ কিন্তু সহিংস বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যেও লুকিয়ে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই এর বিকাশলাভ হয়েছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সেই অঙ্কুরের মধ্যেই যেই অঙ্কুর থেকে বিপ্লবী আন্দোলনে অনুরণন ছড়িয়ে পড়েছিল। মজফ্ফরপুরে ক্ষুদিরাম বোমা ফেলার ঠিক আগের দিন ‘বেন্দমাতরম্’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে অরবিন্দ ঘোষ লেখেন, “আসন্ন বিদ্রোহ ঈশ্বরের মনবাসনা-God’s will-ঈশ্বর চান আত্মত্যাগ। সে দাবি মিটিয়ে দিতে হবে।” রাজনারায়ণ বসুর পরে সে সময়ের অন্যতম নেতা ছিলেন বাল গঙাধর তিলক। তিনি বলেছিলেন, “হিন্দু ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম, কারণ এই ধর্মে ঈশ্বর প্রয়োজন হলেই দেখা দেন। কিন্তু মহম্মদের পর আর কোন ঈশ্বর নেই, খ্রীষ্ট একবারই আসেন।” বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, “সমগ্র পৃথিবীর পাহাড় এবং সমতলভূমি খুঁজে বেড়ালেও ভারতীয় সাধকদের মতো মহাপুরুষ আর কোথাও পাওয়া যাবে না।” সে সময়ের অন্যতম প্রগতিশীল একটি পত্রিকা ‘সোমপ্রকাশ’-এ লেখা হয়, “হিন্দু ধর্মের তুল্য উদার ধর্ম আর নাই। যিনি যেভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করতে চান সেভাবেই করিতে পারেন। এমন উদার ব্যবস্থা কি আর কোন ধর্মে আছে?” অর্থাৎ বিপ্লবী নেতৃত্বরা জাতি-ধর্মের উর্ধে উঠে সমগ্র মানবজাতির যে বার্তা পরাধীন ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া উচিত ছিল, সেই মহান বার্তা কিন্তু তারা দিতে পারেননি। ‘ভবানী মন্দির’ বইতে অরবিন্দ ঘোষতো হাজির করেন এক অনন্ত শক্তির ধারণা। তিনি লেখেন, “Indian regeneration (can) only be effected by rebirth of Shakti.” সেসময়ের নেতারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের চেষ্টা আসলে ঈশ্বরের মনবাসনা পূরণের প্রয়াস। সুতরাং এই আন্দোলনের চরিত্রও শুধু মাত্র রাজনৈতিক নয়, আধ্যাত্মিকও বটে। এর পিছনে ব্রিটিশ মিশনারিগুলিরও একটা বড় ভূমিকা ছিল। তারা ভারত সম্পর্কে শুধুই বিদ্বেষ মূলক প্রচার সংগঠিত করতো। ফলে ভারতীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার জন্য একটি অবলম্বনের দরকার ছিল। হিন্দু ধর্মই হয়ে উঠলো সেই অবলম্বন। তাই তারা ঢালাও ভাবে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে থাকেন। এবং নবাগতদের জন্য তারা যে সমস্ত পুস্তকগুলি অবশ্য পাঠ্য বলে হাজির করেন তার মধ্যে সেসকল বই-ই ছিল যেসকল বইয়ের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, যোগেন্দ্রনাথের ম্যাজিনী ও গ্যারিবল্ডির জীবনী, বিবেকানন্দের রচনাবলী আর ছিল গীতা ও চন্ডী। হাতেগোনা কয়েকটি কথা বাদ দিলে বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দের লেখায় কি কুসংস্কার ও বর্ণাশ্রম বিরোধিতার কোনও প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা কি আমরা দেখতে পাই? আমি এই প্রশ্নটি পাঠকদের বিচারের উপরেই ছেড়ে দিতে চাই। 
চলবে…____________________________________________

গ্রন্থ সূত্র: মহাফেজখানার দলিল 
স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫-১৯৪৭): অমলেশ ত্রিপাঠী 
সুভাষচন্দ্র-ভারত ও অক্ষশক্তি: সুধী প্রধান