ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক যুগ সন্ধিক্ষণের সময় কাল হিসেবে গত শতকের বিশের দশকেই বলতে হয়। এই সময় থেকেই একদিকে যেমন বামপন্থী চিন্তা চেতনার বিকাশলাভ করতে থাকে উল্টো দিকে বিকাশলাভ করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী চিন্তা চেতনারও। এই দুই বিপরীত মেরুর চিন্তা চেতনার মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিল কংগ্রেস। ইতালিতে ফ্যাসিবাদের বিকাশলাভ প্রথমদিন থেকেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী আর এস এসের নেতাদের ফ্যাসিবাদের প্রতি তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে বিন্দু ছিল।

ইতালির ফ্যাসিস্টদের সশস্ত্রীকরণ ও রূপান্তর বিষয়টিই ভারতীয় ফ্যাসিস্টদের সব থেকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। নৈরাজ্য থেকে শৃঙ্খলায় উত্তরণ। হিন্দুত্ববাদী কেশরী পত্রিকায় বহু দীর্ঘ আলোচনা চলতে থাকে ইতালির রেসোরর্জিমেন্টো ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে। অবশ্য স্বাধীনতার প্রতি আকাঙ্খা থেকে সেসময় রেসোরর্জিমেন্টোর (Risorgimento) প্রভাব ভারতের জাতীয়তাবাদীর চরম ও নরমপন্থী উভয় গোষ্ঠীর উপরেই একটা বড় ছাপ ফেলেছিল। কিন্তু কেনও পুনর্গঠনের চিন্তা সেসময়ের ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল সেটাও এক অনুসন্ধান বিষয়। সুযোগ পেলে এই প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করবো।

আর এস এসের সূচনা পর্বে তাত্ত্বিক ভাবে যাঁরা এর মতাদর্শগত দিকটা গড়ে তুলছিলেন তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে নাম আসে বি এস মুঞ্জেরের (বালকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে)। তিনিই ছিলেন আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারের মন্ত্রগুরু। মুঞ্জের একসময় বাল গঙ্গাধর তিলকের সমর্থক ছিলেন। ১৯০৭ সালে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে ‘মধ্যপন্থী’ ও ‘চরমপন্থী’ বিভাজনের সময় মুঞ্জের তিলকের মতের সমর্থনে প্রচার করেন। এভাবেই তিনি তিলকের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে তিলকের জন্য অর্থও সংগ্রহ করেন। তিলকের নির্দেশেই শিবাজী উৎসবকে জনপ্রিয় করার জন্য সারা ভারত জুড়ে প্রচারে নামেন। কিন্তু ১৯২০ সালে তিলকের মৃত্যুর পরেই কংগ্রেসের সাথে তার দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। মূলত অহিংস ও ধর্মনিরপক্ষেতার ইস্যুকে বিরোধিতা করেই তিনি কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হন। এই সময় থেকেই ইতালির ফ্যাসিবাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি মূলত মুসোলিনির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যেই ইউরোপে যান। সেখানে ফ্যাসিস্ট সামরিক শিক্ষা কেন্দ্র ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি তিনি ঘুরে দেখেন। তিনি মুসোলিনির সাথেও কথা বলেন। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে মুঞ্জেরই প্রথম মানুষ যিনি মুসোলিনির সাথে দেখা করেছিলেন এবং নিজেদের মধ্যে মতামত বিনিময় করেছিলেন। এসব কিছু তিনি তার ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করেন।

১৯৩১ সালের ১৫-২৫ মার্চ তিনি রোমে ছিলেন। ১৯শে মার্চ তিনি সেখানকার তিনি Military College, Central Military School of Physical Education ঘুরে দেখেন। এই সময়েই তিনি ইতালিতে ফ্যাসিস্ট আদর্শে দীক্ষিত করবার প্রধান যে দুটি শিক্ষা শিবির ছিল সেগুলোও তিনি অনেক সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেন। এই দুটি শিক্ষা শিবিরের নাম হলো, বালিল্লা (Ballia) এবং Avangurdisti। এই দুটিই হলো যুবকদের জন্য প্রধান ফ্যাসিস্ট শিক্ষা কেন্দ্র। এই দুটি শিক্ষা কেন্দ্রের সাথে আর এস এসের কাঠামোগত অনেক মিল দেখতে পাওয়া যায়। ছয় থেকে আঠারো বছর বয়সীদের এই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। শরীরচর্চা ও আধাসামরিক প্রশিক্ষণ ছিল বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক সদস্যকে সাপ্তাহিক সভায় অবশ্যই অংশগ্রহণ করতে হতো। স্বেচ্ছাসেবকদের ড্রিল ও কুচকাওয়াজ শেখানো হতো।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, আর এস এসের সদস্য সমর্থকেরা তাদের প্রচার পুস্তিকা ও অন্যান্য মাধ্যমে তাদের সংগঠন হেডগেওয়ারের চিন্তা ও অধ্যাবসায়ের ফল বলে যে দাবি করেন তা সর্বৈব মিথ্যা। মূলত মুঞ্জের ইতালির ফ্যাসিস্ট শিক্ষা কেন্দ্রগুলি থেকে যে শিক্ষা নিয়ে ছিলেন তারই হুবহু কপি-পেস্ট সংগঠন হলো আর এস এস। হেডগেওয়ার ইতালির ফ্যাসিবাদের থেকেই শিক্ষা নিয়েছিলেন। ফ্যাসিস্ট সংগঠনের ছাপ হেডগেওয়ারের গুরু মুঞ্জেরের মধ্যে কতখানি ছাপ ফেলেছিল আসুন তা মুঞ্জেরের ডাইরি থেকে আমরা দেখি-

     “Ballila প্রতিষ্ঠান গুলি এবং সামগ্রিক সাংগঠনিক ধারণা আমাকে সবচেয়ে চমৎকৃত করেছে। মুসোলিনি পুরো ব্যাপারটা ভেবেছেন ইতালির সামরিক শক্তির পুনর্জাগরণের (Risorgimento) কথা মাথায় রেখে। ভারতীয়দের মতো ইতালিয়রাও সাধারণ ভাবে স্বাচ্ছন্দ্য প্রিয় এবং যুদ্ধ বিমুখ। শান্তির চর্চা করতে গিয়ে, ভারতীয়দের মত, ইতালিয়রাও যুদ্ধবিদ্যাকে অবহেলা করেছে। মুসোলিনি তাঁর দেশের এইসব দুর্বলতা লক্ষ্য করে Ballila সংগঠনের কথা ভেবেছেন।…ইতালির সামরিকীকরণে এরচেয়ে ভালো কিছু হওয়া সম্ভব নয়।…ফ্যাসিস্টদের ধারণা জনগণের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার ভাবনাকে স্পষ্ট প্রকাশ করে।…ভারত এবং বিশেষ করে হিন্দু ভারতের এইরকম সংগঠন প্রয়োজন, হিন্দুদের সামরিক পুনর্জন্মের জন্য। এতে হিন্দু যোদ্ধা এবং অযোদ্ধা গোষ্ঠীর যে কৃত্রিম বিভাজন ব্রিটিশরা করেছে, তা দূর হয়ে যাবে। আমাদের প্রতিষ্ঠান নাগপুরের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (RSS) অনেকটা এইরকম, যদিও এটা স্বাধীনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। আমি আমার জীবনে অবশিষ্ট দিনগুলো ডাঃ হেডগেওয়ারের এই প্রতিষ্ঠানকে আরও বড় করতে ও মহারাষ্ট্র তথা অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাব।”

ড্রিল ও কুচকাওয়াজ সম্পর্কে মেঞ্জে লেখেন, “আমি ছেলে-মেয়েদের নৌ ও স্থলবাহিনীর পোষাকে সুসজ্জিত অবস্থায় শরীরচর্চার কিছু সাধারণ ব্যায়াম ও ড্রিল করতে দেখে মুগ্ধ হয়েছি।”

এথেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে ইতালির ফ্যাসিস্ট শিক্ষা কেন্দ্রগুলি আর এস এসের মূলগত কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই সমস্ত শিক্ষা কেন্দ্রগুলি পরিদর্শনের পর মুঞ্জে মুসলিনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হয়। পরবর্তী পর্বে আমি সে কথোপকথনের কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করবো। কিন্তু এই সমস্ত ফ্যাসিস্ট শিক্ষা কেন্দ্রগুলি থেকে মুঞ্জের যে শিক্ষা নিয়েছিলেন তা হলো-  ক্ষমতায় যাওয়ার সবচেয়ে নিশ্চিত উপায় হল ধর্মীয় ‘শত্রু’র প্রতি ঘৃণা তৈরি করা। ভারতীয় মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং হিন্দুদের “রক্ষা” করার জন্য যুবকদের সংগঠিত করার মাধ্যমে একটি মুষ্টি-পাম্পিং “হিন্দুত্ব” সহজেই তৈরি করা যেতে পারে। তাই আরএসএস-এর আদর্শের মূল ভিত্তি হল মুসলিম বিরোধী হওয়া। এই শিক্ষা থেকেই ফ্যাসিস্টদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৩৪ সালে হেডগেওয়ারের সাথে একটি বৈঠকে, বিএস মুঞ্জে যে প্রকল্পনার রূপরেখা নিয়ে ছিলেন সে সম্পর্কে ডাইরিতে লেখেন : “আমি হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে একটি পরিকল্পনা নিয়েছি যা সমগ্র ভারতে হিন্দুধর্মের মানককরণের ব্যবস্থা করে… কিন্তু এই আদর্শটি কার্যকর করা যাবে না যদি না আমাদের মুসোলিনির মতো একজন স্বৈরশাসক না থাকে। বা হিটলার…কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে যতক্ষণ না এরকম কিছু স্বৈরশাসক না আসে। আমাদের একটি বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত এবং প্রচার চালিয়ে যাওয়া উচিত”। এই প্রকল্পটিই ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যার মাধ্যমে বর্তমানে আর এস এস গোটা দেশে বর্তমানে প্রায় ৫৭,০০০ শাখা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।  সুতরাং এসব থেকে এটা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে আর এস এসের চিন্তাধারা একক হেডগেওয়ারের মস্তিষ্কপ্রসূততো নয়ই উল্টে তা সম্পূর্ণ ভাবেই মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। অতএব তাদের মতবাদ মোটেই বিশুদ্ধ কোনো মতবাদ নয় বরং ফ্যাসিস্ট মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত।

                                                                                                                                                চলবে…

গ্রন্থ সূত্র: মহাফেজখানার দলিল,

সুভাষ চন্দ্র বসু ও অক্ষশক্তি: সুধী প্রধান