মুসোলিনির সাথে বি এস মুঞ্জের সাক্ষাৎকারটি নিছকই সৌজন্যপূর্ণ ছিল না, বরং এটা ছিল অনেক দিনের পরিকল্পনার ফসল। যেই সুযোগটা কোন ভাবেই হারাতে চায়নি উগ্র হিন্দুত্ববাদী মারাঠা ব্রাহ্মণেরা। যাদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন বি এস মুঞ্জে। আর এই সাক্ষাৎকারের পর থেকে জোরদার ভাবে চলতে থাকে প্রস্তুতি। ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রস্তুতি। 
এই প্রসঙ্গেই মুসোলিনির Doctrine of Fascism থেকে উদ্ধৃতি করা যায়-
“আমি চিরস্থায়ী শাস্তিতে বিশ্বাস করি না। এটা মানুষের মৌলিক গুণাবলীর পরিপন্থী কারণ, একমাত্র সংঘাতের মধ্যে দিয়েই এই গুণগুলোর বহিপ্রকাশ ঘটে।
একমাত্র যুদ্ধই মানুষের সমস্ত শক্তিকে তার চরমতম উত্তেজনার স্তরে নিয়ে যেতে পারে। যাদের সাহস আছে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার তাদের মহত্ব সুনিশ্চিত স্বীকৃতি পায়। ফ্যাসিবাদ চিরস্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা কিংবা উপযোগিতা কোনোটাতেই বিশ্বাস রাখে না। এতে শান্তিবাদের (pacifism) স্থান নেই, কারণ শান্তিবাদের উৎস সংঘাত পরিত্যাগ এবং আত্মত্যাগের বদলে কাপুরুষ মানসিকতা।
মুঞ্জে অবশ্য সাথে সাথে একথাও বলেছিলেন যে, এইসব ভাবনাচিন্তার লক্ষ্য গৃহযুদ্ধের বাতাবরণকে যথার্থতা দেওয়া নয়। শান্তি উঠে আসবে সামরিক দিক থেকে সংগঠিত একটি জাতির আত্মরক্ষার প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে। এ প্রসঙ্গে ইতালি ও জার্মানি থেকে আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে :
ইতালির রাজা বলেছেন, “ইতালি সুদীর্ঘ সময়ের জন্য শান্তি চায়, কিন্তু শান্তির সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হলো ইতালিয় সৈন্যবাহিনীর সক্ষমতা। সরকার সামরিকবাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে সর্বতোভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। এই দক্ষতা নির্ভর করছে ক্যাডার, অস্ত্রশস্ত্র ও সেনানায়কদের একতার উপর। ইতালির তরুণদের স্বাস্থ্য আরো ভালো করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সৈনিক হিসেবে তাদের দক্ষতার মান আরও বাড়াতে হবে। জার্মানি প্রসঙ্গে মুঞ্জে একটি পুস্তিকা থেকে উদ্ধৃতি দেন (Military Science’ লেখক ব্রুনমূহিক টেকনিক্যাল হাই স্কুলের অধ্যাপক Ewald Banse)
“পুস্তিকাটির প্রারম্ভিক বক্তব্য হলো যুদ্ধ অনিবার্য ও নিশ্চিত। তাই এটা যতদূর সম্ভব জানা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন নিজেকে সাধ্যমত তৈরি রাখা… জাতির মনকে বাল্যকাল থেকেই যুদ্ধের ধারণার সাথে সম্যক পরিচিত হতে হবে, কারণ, লিখছেন, মৃত্যুপথযাত্রী যোদ্ধা অনেক নিশ্চিন্তে মরণকে বরণ করতে পারে, যদি সে জানে যে তার রক্ত ঝরছে তার জাতির ঈশ্বরের জন্য।” 
উদ্ধৃতির শেষ লাইনটির অন্তনির্হিত ভাবের সাথে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সারমর্মের আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে।
মুঞ্জে যখন হিন্দু সমাজকে জঙ্গীকরণের ফলিত উপায়গুলো নির্দেশ করেছিলেন, তখন তিনি আবার ইতালি এবং তার সামরিক ও আধা সামরিক সংগঠনগুলোর কাছে ফিরে যান। ইতালির অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি ‘She Wolf’s children, Baltila Aranguardisti-র গঠনের বিস্তৃত বিবরণ দেন। তিনি জানান, এই সংস্থাগুলো ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সের ছেলেদের আধাসামরিক প্রশিক্ষণ দেয়, এবং তারপর তারা তরুণ ফ্যাসিস্তে পরিণত হয়। ইতালি তাই এখন ৬,০০০,০০০ প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল যুবক নিয়ে যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রস্তুত।
Balillaদের নৈতিক চরিত্র গঠন এবং সৈনিক হওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো শেখানো হয়।
এর ফলস্বরূপ-সাধারণ নাগরিক আর সৈনিকদের মধ্যে কোনো তফাৎ ভবিষ্যতে থাকবে না। আজ আমরা জানি, ব্যাপক সংখ্যক সমর-বিদ্যায় প্রশিক্ষিত নাগরিক থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালিকে হার মানতে হয়েছিল। মুঞ্জে অবগত ছিলেন না যে এই প্রশিক্ষণের স্তর ছিল নিচু, ছিল সমন্বয়ের অভাব আর ফ্যাসিস্ত আদর্শ ইতালিয়দের মনের গভীরে প্রবেশ করেনি।
ফ্যাসিস্ত ধারণা, অন্তত মহারাষ্ট্রে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে ব্যাপক ছড়িয়ে পড়েছিল। সদ্য উল্লেখিত পাণ্ডুলিপিটি প্রচার পুস্তিকা আকারে মুদ্রিত হয় (অনুলিপি রয়েছে NAI, Jayakar Papers, microfilm fn6 m2 )। এই পুস্তিকা শুধু মুঞ্জে যাদের নিজের পরিকল্পনায় সামিল করতে চেয়েছিলেন তাদের মধ্যে নয়, আরও বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ফ্যাসিবাদ তখন বেশ কিছুটা জনপ্রিয় হয়েছিল, কিন্তু তার পরিমাণ আজ আন্দাজ করা কঠিন। 
মুঞ্জের ইতালি যাত্রার পর ভারতে প্রধান হিন্দু সংগঠনগুলোর প্রবক্তাদের সাথে ফ্যাসিস্ত সরকারের কোন সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। তবে, ১৯৩০-র দশকের শেষদিকে ভারতে ইতালিয় প্রতিনিধিরা হিন্দু জাতীয়তাবাদের চরমপন্থী অংশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। বোম্বের ইতালির কনস্যুলেট স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছাকাছি আসার উদ্যোগ নেয়। এই শহরের ইতালিয় কূটনৈতিক মিশন মহারাষ্ট্র ও বাংলার আমূল সংস্কারপন্থী আন্দোলনগুলোর সাথে বোম্বে ও কলকাতার ইতালিয় কনস্যুলেট দুটিকে সংযোগকারী নেটওয়ার্কের অংশ ছিল।
১৯৩৮-র জুন থেকে বোম্বে কনস্যুলেট যত বেশি সম্ভব ভারতীয় ছাত্রকে ইতালিয় ভাষা শিক্ষার পাঠক্রমে ভর্তি করাতে শুরু করে। এর লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের ইতালি তথা ফ্যাসিবাদের সমর্থনে দলে টানা। এই কাজের জন্য বোম্বেতে ইতালিয় কার্যকলাপ সামলানোর নির্দিষ্ট দায়িত্ব। দিয়ে রোম থেকে পাঠানো হয় Mario Carelli-কে। Carelli ইতালিয় সরকারের তত্ত্বাবধানে এবং Giovanni Gentile-র সভাপতিত্বে ১৯৩৩-এ রোমে গঠিত Institute for Middle and Far East (ISMEO)-র সচিব ও গ্রন্থগারিক ছিলেন। [মুম্বইয়ের ইতালিয় কনস্যুলেটের উল্লেখিত কার্যকলাপের বর্ণনা রয়েছে- Giovanni Gentile Foundation, Rome, correspondence form third parties to Gentil, F. Carelli Mario, undated latter, নিশ্চিত ভাবেই লিখিত 29শে জুন 1938 সালে এবং Letter dated October 11, 1938।]
বোম্বেতে ছাত্রদের মধ্যে তার নজরে এসেছিলেন মাধব কাশীনাথ দামলে। শিক্ষকের উপদেশেই দামলে মুসোলিনির ‘Doctrine o Fascism’ মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ১৯৩৯-এ তা নিজের প্রতিষ্ঠা করা পত্রিকা লোখান্ডি মোর্চায় (লৌহ জোট) ধারাবাহিক নিবন্ধের আকারে প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাতো পাঁচ পর্বে ছাপা হয় Antonio Pagliaro-র পুস্তিকা ‘Fascism against Communism’ Carelli- The Institution of the House of the Fasci and corporations।
১৯৩৯-র শরৎকালে লোখান্ডি মোর্চায় এমন এক উগ্র নিবন্ধ প্রকাশিত হয় যে, পত্রিকাটি পুলিসের নজরে পড়ে যায়। এর ফলে, ইতোমধ্যেই গোয়েন্দা বিভাগের নজরে থাকা শহরে বাধ্য হন পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ রাখতে ও জরিমানা দিতে। দামলে ছিলেন পুনের শিক্ষ ব্রাহ্মণ। তিনি থাকতেন বোম্বেতে, যেখানে তাঁর বাবার ছাপাখানা থেকেই মুদ্রিত হতো লোখাই পুলিসের বিবরণ অনুযায়ী
দামলে জঙ্গি রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী এবং নিজেকে তিনি বাল . তিলকে’র অনুগামী বলে মনে করেন ……. দামলে প্রকাশ্যেই বলেন যে তিনি ইতাি ও নাৎসি জার্মানির ইতিহাসের পরম ভক্ত’ (MSA, Home Special Department,830 (1) 1939, note dated July 1, 1939)। এর চেয়ে আরও অর্থবহ হলো ইতালিয় কনসাল যে চোখে দামলেকে দেখেছেন, তা
ফ্যাসিস্ত ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ দামলে Iron Guards নামে সংগঠন গড়েছেন। আমাদের ধাঁচটা তিনি নিয়েছেন, কিন্তু সেটাকে ভারতের বিশেষ পরিস্থিতিতে নতুন চেহারা দিয়েছেন।
তিনি এবং তার সাথীরা Black Shirt পরেন ভারতের প্রথম Black Shirt যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এই সংগঠনটির বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
ফ্যাসিস্ত ভাবাদর্শ ও অনুশীলনের প্রভাব প্রধান হিন্দু চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর পরিসীমা ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছিল। সম্ভবত পৌঁছে গিয়েছিল দ্বিতীয় স্তরের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির আনাচে-কানাচে এবং শরীর-চর্চা অথবা আধা-সামরিক প্রশিক্ষণের কেন্দ্রগুলোতে। এটা বোঝা যায় ১৯২৯-র ১০ মার্চ এম আর জয়াকার প্রতিষ্ঠিত স্বস্তিক লিগের উদাহরণ থেকে। এই প্রতিষ্ঠানের সংগঠনে হিন্দু মহাসভার স্বনামধন্য নেতা জয়াকার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ফ্যাসিস্ত, আধা-সামরিক সংগঠনসমূহের কাছ থেকে। তাঁর নিজের ভাষায়-
অদূর ভবিষ্যতে, আমাদের সর্বাধিনায়ক ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যেকার ছেলেদের নিয়ে একটা ক্যাডেট বাহিনী গড়ে তুলতে চান। এই ক্যাডেটরা যে প্রশিক্ষণ পাবে, তাতে তারা শেষ পর্যন্ত লিগের স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ দিতে পারবে…
এ প্রসঙ্গে Sunday Chronicle-এ ছাপা একটা ছবির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ছবিটা ছিল মুসোলিনির দু’জন ‘বালক সেনার’, যারা ইতালির Camp Dux-তে, ১৪ থেকে ১৮ বছরের ছেলেদের সংগঠন Avan Guordista-র বার্ষিক ক্যাম্পে প্রহরীর কাজ করছে। এই সংগঠনে ছেলেরা যুদ্ধবিদ্যার প্রাথমিক শিক্ষা পায়। আমরা বা আমাদের ক্যাডেটরা এরকম প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের কথা ভাবতে পারিনা। তবে ছেলেদের সামরিক শৃঙ্খলা শেখানো কখনো বৃথা যাবে না এবং ভবিষ্যতে এরা আদর্শ স্বেচ্ছাসেবক হয়ে উঠবে [NAI, Jayakar papers, microfilm, on 13, Swastik Herald of November 7, 1934] |
১৯৪০-এ যখন নাৎসিবাদ তার হিংস্র চেহারা প্রকাশ্যে এনেছিল এবং ‘স্বস্তিকা’ এক অশুভ প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয়েছিল, তখন লিগ বাধ্য হয়েছিল নাৎসিবাদের সংশ্রব ত্যাগ করতে। আপাত দৃষ্টিতে তারা হিটলারের ধ্বংসাত্মক মানব-নিধন নীতির বিরোধিতা করেছিল।
চলবে…
_________________________________________
গ্রন্থসূত্র: মহাফেজখানার দলিল,
আনন্দ বাজার আর্কাইভ 
সুভাষচন্দ্র বসু ও অক্ষশক্তি: সুধীপ্রধান