জার্মানি যে উগ্র জাতি-বিদ্বেষী নীতিগ্রহণ করেছিল, সম্ভবত সেই কারণেই হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রহ ইতালি থেকে সরে এসেছিল জার্মানির ওপর। বাস্তব প্রেক্ষিতে, এই পছন্দের পরিবর্তনের প্রকাশ্য প্রতিফলন ঘটেছিল দেশের বাইরে সক্রিয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর সাথে সাভারকরের সংযোগ স্থাপনের প্রয়াসের মধ্যে। পুরো ১৯৩৮ ধরে সাভারকর প্রবাসে বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা রাসবিহারী বসু’-র সাথে চিঠিপত্র আদানপ্রদান করেছিলেন। [রাসবিহারী বসু সম্পর্কে দ্রষ্টব্য – Uma Mukherjee, Two Great Indian Revolutionaries Firma KLM, Calcutta, 1966]। রাসবিহারী ১৯১৫ থেকে জাপানে বসবাস করছিলেন এবং ১৯২৩-এ তিনি জাপানি নাগরিকত্ব পান। তাঁর সাথে সে দেশের চরম দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলো বিশেষত Association of the Black Dragon-র ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল [ASMAE, AP Giappone (Japan), b6, 1934, b Movemento Panasiatico ( Pan- Asiatic Movement)Express telegram n. 166/113, from Italian Embassy, Tokyo, February 24, 1934, to the Ministry of External Affairs, signed Anriti) আমাদের কাছে থাকা সূত্র অনুযা ১৯৩৮-র মার্চ থেকেই বসু ও সাভারকর পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছিলে। The Mahiratta প্রচারের লক্ষ্যে বসু’র হিন্দু মহাসভার সভাপতিকে লেখা দু’টি চিঠি প্রক করে এর প্রত্যাশিত ফল হয়েছিল এই যে-

হিন্দু সংগঠনের আদর্শকে সমর্থন করে ও ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্তিতি সম্পর্কে আপনার গভীর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নীতি লক্ষ্য করে দেশের হিন্দু সাংগঠনিক নিজেদের আরও শক্তিশালী মনে করছে [NMML, আগস্ট ১৮]। 

১৯৩৮-র গ্রীষ্মকালে রাসবিহারী জাপানে হিন্দু মহাসভার একটি শাখা খোলার ব্যাপারে তাঁর ইচ্ছার কথা সাভারকরকে জানান। যদিও জঙ্গী সদস্যের সংখ্যা তেমন বেশি নয়, তা হয়ে উঠতে পারে –

হিন্দু মহাসভা এবং পূর্বের দেশগুলোর হিন্দুরাজের সরকারী আন্তর্জাতিক মুখপর [NMML)।

সাভারকর এ প্রসঙ্গে ইতিবাচক সাড়া দেন। তিনি বসুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়িত করার পরামর্শ দেন। অবশ্য সাভারকর এটাও জানিয়ে দেন যে, হিন্দু মহাসভার জাপানী শাখাকে ভারতে মূল দলের কথা মেনে চলতে হবে (NMML পূর্বোল্লিখিত রাসবিহারী বসুকে লেখা সাভারকরের চিঠি, Nov. 14 1938, স্বাক্ষর সভাপতি, হিন্দু মহাসঙ্গ)। এই বছরেরই শীতকালে দুই নেতার মধ্যে এতটাই ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যে, সাভারকর হিন্দু মহাসভার আসন্ন বার্ষিক অধিবেশনে বার্তা পাঠানোর জন্য বসুকে অনুরোধ করেন [NMMI]।

বোম্বেতে অক্ষশক্তিগুলোর দূতাবাসের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের জন্য সাভারকরের প্রয়াস সফল হয়নি। সম্ভবত, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার সূত্রে অন্য দেশের সাথে সমঝোতা অনেক কঠিন হয়ে উঠেছিল। একমাত্র জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে সাভারকরের পূর্বোল্লিখিত ভাষণটি সে দেশের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশ করা গিয়েছিল। মারাঠী কাগজগুলোতে জার্মানির ইহুদী নীতির প্রচারের বিনিময়ে, অক্ষশক্তিভুক্ত দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের ভার ছিল যুগলকিশোর বিড়লার ওপর [NMML, পূর্বোল্লিখিত, বিড়লাকে লেখা সাভারকরের চিঠি Nov 2 1938, নিজের হাতের স্বাক্ষর VDS]। অন্যদিকে হিন্দু মহাসভার সাথে যোগসূত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জার্মান নিউজ এজেন্সির G. L. Lesczezynski এবং বোম্বের একটি সংস্থার ম্যানেজার P.Pazze-র ওপর। এদের উদ্যোগেই সাভারকরের ভাষণ Volkischer Beobachter, — মুদ্রিত হয় (NMML, পূর্বোল্লিত্তি, হিন্দু মহাসভার সম্পাদকের Pazzo কে লেখা চিঠি, Nov. 19, 1938, এবং একই তারিখে Lesczezynski র Malekar-কে লেখা চিঠি)। এই দেওয়া নেওয়ার সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ Lesczezynski -র সাভারকরকে Mein Kampf (হিটলারের আত্মকথন)-র একটি কপি পাঠানো।

আজকাল চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তাদের লেখায় হিন্দু মহাসভার সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র ব্যবহার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে অক্ষশক্তিগুলো সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসুর অবস্থানের তুলনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে তারা ১৯৪০-র জুনে বোম্বেতে বসু এবং সাভারকরের মধ্যে একটি সাক্ষাৎকারের কথা বলেন। এই সময়েই নাকি সাভারকর সুভাষকে উপদেশ দেন—তিনি যেন ইউরোপে যান ও একনায়কদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। অবশ্য উল্লেখিত দুই নেতার মধ্যে কথাবার্তার কোন প্রামাণ্য নথি পাওয়ানি। Times of India- ২৪ জুন, ১৯৪০-র সংস্করণে প্রকাশিত একটি ছোট নিবন্ধের বক্তব্য অনুযায়ী- 

শনিবার সন্ধ্যেয় দাদারে তাঁর বাসভবনে সর্ব ভারতীয় হিন্দু মহাসভার সভাপতি ভি ডি সাভারকরের সাথে শ্রীযুক্ত বসুর কথা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং হিন্দু মহাসভা ও ফরওয়ার্ড ব্লক অন্যান্য দলগুলোর সহযোগিতায় কী করতে পারে, তা। জানা গেছে, এই মত বিনিময়ের ফল তেমন আশাব্যঞ্জক নয়।

এই ঘটনাপর্ব যথারীতি পুলিসের নজর এড়ায়নি। তাদের তরফেও এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে—

সুভাষ চন্দ্র বসু ২২ জুন বোম্বেতে আসেন, এম এ জিন্নাহ এবং ভি ডি সাভারকরের সাথে আলোচনায় বসেন। ফরওয়ার্ড ব্লক ও হিন্দু মহাসভার মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয়ে কথাবার্তা ফলপ্রসূ হয়নি। বোম্বে ফরওয়ার্ড ব্লক ২৩ জুন একটি সভা আয়োজনের চেষ্টা চালায়, কিন্তু সমর্থনের অভাবে তা পরিত্যক্ত হয়। [MSA, Home Special Department, 1023, 1939-40, SA dated June 29, 1940, ‘Forward Bloc’]

 আলোচ্য সাক্ষাৎ সম্পর্কে হিন্দু মহাসভার তরফে কোন নথি না রাখার সম্ভাব্য কারণ ছিল দুই নেতারই ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে থাকা। তাই স্পর্শকাতর বিষয়ের কোন নথি রাখাটা বুদ্ধির কাজ হত না। এমনকি, সুভাষ চন্দ্র বসুর নিজস্ব কাগজপত্র বা লেখায় সাভারকরের সাথে তাঁর দেখা হওয়ার কোন উল্লেখ নেই। তাই দুজনের ভেতর কী কথা হয়েছিল, তা বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। একমাত্র সূত্র হল ১৯৫২-তে ‘অভিনব ভারতে’র বিলয়ের সময় সাভারকরের পেশকরা ভাষণটি। এটি তেমন জোরালো প্রমাণ। নয়, কেননা এর কোন লিখিত প্রমাণ নেই এবং এর সময়টিও মূল ঘটনার বহু পরের।

পুরো ঘটনা নিয়ে যে ধারণা করা যেতে পারে তা হল, এটি একধরণের ইতিহাস রচনা সংক্রান্ত উদ্ভাবন। যুদ্ধের সময় নিজেদের দ্বৈত মনোভাবকে যথার্থতা দেওয়ার জন্যই এই প্রয়াস চালানো হয়েছে। যদি এরকম সাজানো যায় যে, সুভাষের কার্যকলাপে সাভারকরের অনুমোদন ছিল, তবে শুধু এটাই প্রমাণ হবে না যে, ইউরোপে বসুর পরিকল্পনায় সাভারকরের এক ধরণের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, আরো বড়কথা, মেনে নিতে হবে যে, সাভারকর ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।

সুভাষ চন্দ্র বসু ও সাভারকরের মধ্যে যে দেখা হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই এবং দুই নেতা সুভাষের ইউরোপে গিয়ে অক্ষশক্তিবর্গের সহায়তা লাভের ইচ্ছা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তবে, তার অর্থ এই নয় যে, সাভারকর বসুকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র ১৯৩৩ থেকেই একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলোর সাথে নিজস্ব যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন। এটাও লক্ষ্য করার বিষয় যে, গান্ধী হত্যার চার বছর পরে, যখন হিন্দু মহাসভা ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর ভাবমূর্তি দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তখন হিন্দু মহাসভার সভাপতি নেতাজীর সাথে সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। অর্থাৎ উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলগুলো তাদের রাজনৈতিক অতীতকে কলঙ্কমুক্ত করার এবং একটা সুস্পষ্ট ব্রিটিশ বিরোধী অবস্থান পুনরাবিষ্কারের প্রয়াস চালিয়েছিল। তাই তারা বোঝাতে চেয়েছিল যে, সুভাষের পরিকল্পনাকে সাহায্য করার জন্য হিন্দু মহাসভা আড়ালে আড়ালে তৈরি ছিল।

একমাত্র গান্ধী হত্যায় জড়িত থাকাটাই হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করেনি। এটা যুদ্ধ চলাকালীন তাদের স্ববিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অনেক আগে থেকেই ঘটে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিন্দু জাতীয়তাবাদ যে নীতি নিয়েছিল, তাকে বলা হয়েছে ‘responsive co operation’। এই নীতি ক্ষমতা হস্তান্তর বা ব্রিটিশের সাথে সম্পর্কের প্রসঙ্গে সবসময়ই ছে মনোভাব পোষণ করেছে। সাভারকর ১৯৪২-এর এক ভাষণে নিজেই এই দোলাচলত প্রকাশ করেছেন, responsive Co-operation-র নীতিতে……নিঃশর্তে সহযোগিতা থেকে সক্রিয় এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধ পর্যন্ত সমস্ত দেশাত্মবোধক কার্যকলাপের অস্তিত্ব রয়েছে [LC Khare (ed) Hindu Rashtra Darshan, Bombay, 1949, p266]। সুতরাং, এটা আশ্চর্যের নয় যে, এই স্ববিরোধিতা উগ্র হিন্দু জাতীয়বাদের শক্তিগুলোর প্রতি প্রায় সার্বিক সংশয়ের সৃষ্টি করেছিল এবং এদের বিরুদ্ধে শত্রুর সাথে হাত মেলাবার অভিযোগ উঠেছিল।

যুদ্ধ শুরু হবার অব্যবহিত পরেই হিন্দু মহাসভা স্থির করেছিল যে, এর কার্যানির্বাহী সমিতি (সেপ্টেম্বর, ১০,১৯৩৯) নিম্নলিখিত আচরণ পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করবে।

ডানজিগের অধিবাসীদের রাইখে ফিরে আসার দাবির যৌক্তিকতা বা অন্য বিষয় নিয়ে কোন কথা বলা যাবে না, কারণ নীতিগতভাবে আমাদের ডানজিগের জার্মানদের সমর্থন করতে হবে।…কোন পরিস্থিতিতেই আমরা এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের সঙ্গে থাকতে পারি না [NMML Savarkar papers, microfilm on 12 cit Letter to Malekar to Savar Sept-7,1939]।

১০ সেপ্টেম্বরের কার্যনির্বাহী সমিতি মহাযুদ্ধ আরম্ভের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত জরুরী অবস্থায় দেশকে প্রস্তুত রাখার জন্য কি কি করা উচিত সে সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত নেয়- 

ভারতবর্ষকে কোন সামরিক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করবার দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকার এবং আমাদের নিজেদেরও। যেহেতু দুর্ভাগ্যবশত আমরা অন্যের সাহায্য ব্যতীত নিজেদের দায়িত্ব পালনে অপারগ, তাই ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে মন খোলা সহযোগিতার যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে [NMML Moonje Papers, Subject files n. 51]।

এই সহযোগিতার প্রাথমিক শর্ত হল একটি ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ব্রিটিশদের পুরো ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এ বিষয়ে হিন্দু মহাসভা কংগ্রেসের তুলনায় নরম মনোভাব নিয়েছিল।

চলবে…

___________________________________________

গ্রন্থসূত্র: মহাফেজখানার দলিল 

সুভাষ চন্দ্র বসু ও অক্ষশক্তি: সুধীপ্রধান 

অবিভক্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনে বাংলা প্রেক্ষাপট: ভারত – ভানুদেব দত্ত 

সুভাষবাদ : নৃপেন চক্রবর্তী