এক অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। আজকের সময়ে সব হিন্দুত্ববাদের নামে সব থেকে বড় যে বিপদের সম্মুখীন আমরা হয়েছি তা হলো ফ্যাসিবাদ। কিন্তু কেন ফ্যাসিবাদকে সব থেকে বড় বিপদ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদের সর্ব প্রথমে বুঝতে হবে যে, ফ্যাসিবাদ আসলে কাকে বলে এবং তার স্বরূপ কি? বিগত শতকে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও আলাপ আলোচনা হয়েছে। যে আলোচনা বর্তমান সময়ে আমাদের ভারতের পরিপেক্ষিতে অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠেছে। গত শতকের তিরিশের দশকে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের নগ্ন, বীভৎস ও ভয়ংকর রূপ আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি ফ্যাসিবাদের জনক মুসোলিনির ইতালিকে। তোজোর জাপানকে।


বিগত শতক থেকে ফ্যাসিস্টদের সম্পর্কে তাদের তত্ত্ব, আদর্শগত ভিত্তি ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বহু লেখক বিশ্লেষণ করেছেন। এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ ফ্যাসিস্টদের এক একটি বিশেষ দিক নিয়ে এই আলোচনা করেছেন। ফলে সামগ্রিক ভাবে ফ্যাসিবাদকে অনুধাবন করার মতো সহজতর বা সরলতর কোন ব্যাখ্যা নেই। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে এর প্রকাশ এমন ভয়ংকর ভাবে ঘটেছিল যে তাকে সহজভাবে ফ্যাসিবাদকে সূত্রায়িত করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। আর্নস্ট নোল্ট কমিউনিস্ট বিরোধীতাকেই ফ্যাসিবাদের মূল লক্ষ্য বলে চিহ্নিত করেছিলেন। আবার ১৯২৯ সালে হবস বার্ডান বলেন, বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্কট দেখা না দিলে ফ্যাসিবাদ এমন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারতো না। দুটি বক্তব্যই কিন্তু সমানভাবে ঠিক। আবার অনেকে বলেন, পুঁজিবাদী শ্রেণী শোষণ তীব্রতর করার উদ্দেশ্যেই ফ্যাসিস্টদের জন্ম হয়। ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদেরই এক বিকট রূপ। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে শাসক শ্রেণী যখন তার প্রভুত্ব বজায় রেখে শ্রেণী শোষণ চালাতে পারে না তখন বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যেটুকু  স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র থাকে তা কেড়ে নিয়ে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব কায়েম করে। 


ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি ও আন্তর্জাতিকের অন্যতম সদস্য রজনী পাম দত্ত তার “ফ্যাসিজম অ্যান্ড স্যোস্যাল রিভলিউশন” গ্রন্থে লিখেছেন, ফ্যাসিবাদ বস্তুত বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে কোন অভিনব স্বাধীন দর্শন নয়। ঠিক এর বিপরীত। চূড়ান্ত অবক্ষয়ের এক নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আধুনিক ধনতন্ত্রের সবচেয়ে পরিচিত নীতি ও প্রবণতার সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সঙ্গতিপূর্ণ কর্মসূচি। তিনি ফ্যাসিবাদ বিকাশের অন্যতম প্রধান চারটি শর্ত চিহ্নিত করেন-
🔴 অরাজনৈতিক সঙ্কট ও শ্রেণী সংগ্রামের তীব্রতা,
🔴 সংসদীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক মোহভঙ্গ,
🔴 ব্যাপক অংশের পেটি বুর্জোয়া মধ্যশ্রেণী, স্লাম প্রলেতারিয়েতসহ শ্রমিক শ্রেণীর একটা অংশের উপর পুঁজিবাদী প্রভাব,
🔴 শ্রমিক শ্রেণীর মূল অংশের একটি স্বতন্ত্র শ্রেণী সচেতন বিপ্লবী নেতৃত্বের অভাব।


১৯৩৫ সালে সপ্তম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের রিপোর্টে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে জর্জি ডিমিট্রভ বলেছিলেন, ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদ হলো ফিনান্স পুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী এবং সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী অংশের সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্র। এই থিসিসে বলা হয়, ফ্যাসিবাদ যোগানদার পুঁজিরই রাষ্ট্রশক্তি। শ্রমিক শ্রেণী, কৃষক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লবী অংশের উপর সন্ত্রাসবাদী প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সংগঠনই হলো ফ্যাসিবাদ। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ হলো হীনতম সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ। অন্যান্য জাতির বিরুদ্ধে পাশবিক বিদ্বেষ জাগানোই হলো এর কাজ। 
অর্থাৎ ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা দখল মানে স্বাধারনত একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের বদলে অন্য একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা দখলের মতো স্বাভাবিক রাজনৈতিক পালাবদল নয়। এহলো বুর্জোয়া গনতন্ত্রের বদলে সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্র স্থাপন। 


বাক চাতুর্যের দ্বারা তারা জনগণের মন জয় করে। আগ বাড়িয়ে জনগণের প্রয়োজন ও চাহিদার কথা বলে। এভাবে তারা জনগণের মধ্যে বদ্ধমূল কুসংস্কারকে উসকে দেয় ও অন্ধকারময় বিধিনিষেধের দোহাই দিয়ে তাদের সংগঠিত করে। সুস্থ চেতনার বদলে প্রতিহিংসার রাজনীতি আমদানি করে। জাত্যাভিমানের দোহাই দিয়ে জনগণের মধ্যে হিংসাকে রপ্ত করতে, মেনে নিতে বাধ্য করায়। এমনকি তারা বিপ্লবী ঐতিহ্য ও জাতীয়তাবাদের নামে এক উগ্রপন্থার বীজ বপন করে জনগণের মনে। এভাবেই তারা জনগণকে সংগঠিত করে এবং তাদের হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড যুক্ত করতে বাধ্য করায়। তারা জনগণের মূল সমস্যাকে উপেক্ষা করে এবং সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মনোবৃত্তি সম্পন্ন ব্যাক্তিদের গ্রাসে তুলে দেয়। অথচ জনগণের দরবারে তারা “মিস্টার ক্লিন” বলে নিজেদের জাহির করে। বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সবথেকে প্রতিক্রিয়াশীল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভাঁওতাবাজ দলগুলির কার্যকলাপের ফলে বীতশ্রদ্ধ জনগণকে তারা মাঝপথে কব্জা করে এবং তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। নৈরাশ্যবাদ আর কপটতায় ফ্যাসিবাদের জুড়ি মেলা ভার।
যে মুখোশেরই আড়াল ফ্যাসিবাদ নিক না কেন, যে ছলনার পথেই তারা ক্ষমতা দখল করুক না কেন- ফ্যাসিবাদ হলো শ্রমজীবী মানুষের উপর মুনাফা ভোগীদের হিংস্রতম আক্রমণ, নিরঙ্কুশ সংকীর্ণতাবাদ আর পররাজ্য দখলের যুদ্ধ, জঘন্যতম প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবিপ্লব এবং শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতি মানুষের ক্রুরতম শত্রু।
চলবে….


গ্রন্থ সূত্র: ফ্যাসিবাদ: অতীত ও বর্তমান  -সুকমল সেন
শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য: ফ্যাসিবাদ বিরোধী দুর্গ  -জর্জি ডিমিট্রভ