সাগরদিঘীর উপনির্বাচনের ফল অন্য চোখে
চয়ন ভট্টাচার্য
সাগরদিঘী বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অনেক অঙ্ক পাল্টে দিয়েছে তা এই রাজ্যের শাসকদলের অনেক নেতা নেত্রীই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বীকার করে নিচ্ছেন। কেউ কেউ অবশ্য কোন ব্যক্তিগত মত প্রকাশ্যে না বলে মোবাইলে গত ২রা মার্চ সাগরদীঘি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলপ্রকাশের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাংবাদিক সম্মেলনে মেজাজ হারিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে ব্যক্তিগত স্তরে কুৎসিত আক্রমণ করে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে রাজনৈতিক ভাষ্যের ধরণটাই পাল্টে দিলেন। ঝালদা পুরসভার নির্বাচনের পর আরও একবার প্রমাণিত হল পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে পারে না।
সাগরদিঘী বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচন ও তার ফল প্রকৃতপক্ষে দুটি রাজনৈতিক বাস্তবতা সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত তৃণমূল কংগ্রেস হেরে গেলে বিজেপির জামানত জব্দ হয় এবং দ্বিতীয়ত তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির গোপন আঁতাত জনগণের সামনে উন্মোচিত করতে বামফ্রন্ট বিশেষত সিপিআইএম সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে দ্বিধা করে না। সাগরদিঘীতে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপিকে পরাজিত করার বার্তা দিতে উপনির্বাচনের প্রচারে সিপিআইএম প্রথম সারির সব নেতা নেত্রী সাধারণ সম্পাদক তথা পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম থেকে শুরু করে ভারতের গণতান্ত্রিক যুবফেডারেশনের সভানেত্রী যিনি পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্যও সেই মীনাক্ষী মুখার্জী পর্যন্ত সবাই মঞ্চে মাঠে পথে সর্বত্র প্রচার করেছেন। এই ভোটে বিজেপি তৃণমূল বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না হয় তার জন্য প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীর পক্ষ থেকে সমর্থনের আহ্বান পাওয়া মাত্র বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং সিপিআই এমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ইতিবাচক সাড়া দেন এবং দ্রুত মুর্শিদাবাদ জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাগরদিঘীর পার্টিকর্মীদের প্রচারে নামাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন, এই কাজটা বাম কংগ্রেস সমর্থক কর্মীদের কাছে ঠিক কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল।
সবচেয়ে বড় কথা, এন আর সি বিরোধী আন্দোলনের নেতা তরুণ আনিস খানের খুন হওয়ার ঘটনা থেকে বিয়াল্লিশ দিন ধরে মিথ্যা মামলায় ভাঙড়ের আই এস এফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর জেল বন্দী থাকা গত কয়েকমাসের মধ্যে ঘটে যাওয়ার কারণে তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপির পক্ষে সাগরদিঘীতে ধর্মীয় বিভাজনের তাস খেলা সম্ভব ছিল না। যতই বাজারি গণমাধ্যমে সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকে সরে যাওয়ার সরলীকরণ ব্যাখ্যা দেওয়া হোক তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির ওপর সাগরদিঘীর মানুষ আস্থা না হারালে দু বছরের মধ্যে তিন নম্বর স্থানে চলে যাওয়া বাম কংগ্রেস জোট প্রথম স্থানে চলে আসত না। মন্ত্রী সুব্রত সাহার মৃত্যুর ফলে সাগরদীঘি আসনে উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী করা হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয় দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে যিনি বিগত নির্বাচনে টিকিট না পেয়ে নির্দল প্রার্থী হয়েছিলেন এবং সেই অপরাধে বহিস্কৃত হয়েছিলেন । অন্যদিকে বিজেপির প্রার্থী দিলীপ সাহা নবগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন। উপরন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাসের অন্যতম প্রধান সহযোগী কংগ্রেস নেতা সাইদুর রহমানকে পনেরো বছরের পুরোন একটি অভিযোগে গ্রেফতার করায় তৃণমূল বিরোধী ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে। বাইশে ফেব্রুয়ারি সাইদুর রহমান জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরেই পঁচিশে ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন সাগরদিঘীর ও সি বিশ্বজিৎ সরকার কে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। এতেও শাসক দল কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে চলে যায়।
সাগরদিঘীর উপনির্বাচনে প্রচারে এসে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানত দুটি তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা করেছিলেন। একটি হল,তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন না করা” মীরজাফরকে সমর্থন করার মতো” অপরাধ! দ্বিতীয়টি হলো, শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাসের ছবি দেখিয়ে “বিজেপির নির্দেশে কংগ্রেস তার প্রার্থী বাছাই করেছে”- প্রচার করা। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুর্শিদাবাদের তৃণমূল কংগ্রেসের কেউ মনে করিয়ে দেয়নি যে, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুশি করতে ২০১৬তে সাগরদিঘী বিধানসভার কংগ্রেস প্রার্থী আমিনুল ইসলাম, কান্দির কংগ্রেস বিধায়ক অপূর্ব সরকার মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস বিধায়ক শাওনি সিংহরায়কে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করিয়েছিলেন। নবগ্রামের সিপিআইএম বিধায়ক কানাই মণ্ডলকেও তৃণমূল কংগ্রেসে নিয়ে আসেন শুভেন্দু অধিকারী। এইভাবে ভোটে সব আসনে না জিতেও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেই জনপ্রতিনিধিদের দলবদল করিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার সব পুরসভা চলে আসে তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে। ২০১৮ সালের ‘পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে শুভেন্দু অধিকারী ঘোষণা করেছিলেন,” মুর্শিদাবাদ জেলাতে ভালো ফল করতে হবে, এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাত শক্ত করুন, যাতে এই মুর্শিদাবাদ জেলাতে অন্য কোনও দল না থাকে৷’’
এবং সাগরদিঘীর এই উপ নির্বাচনের প্রচারে এসে নন্দীগ্রাম থেকে বিজেপির টিকিটে জিতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধীদল নেতা হওয়া সেই শুভেন্দু অধিকারী কি বলেছিলেন? মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসে থাকবার সময় তিনি টাকা দিয়ে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের কিনে নিতেন তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই বিতর্ক হয়েছিল। শিরোনামেও এসেছিল মিডিয়ার কাছে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান প্রাসঙ্গিক দুই দলের নেতাদের বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি। সাগরদিঘীর জনগণ যা বোঝার বুঝেছিলেন। বালি,কয়লা নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকা একটি দল যদি সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বিশ্বাসী আর একটি দলে নেতা কর্মী পাঠিয়ে বিরোধী দল সাজাতে চায়, সাগরদিঘীর জনগণ এবার বুঝিয়ে দিলেন তাঁরা এই দু পক্ষকেই প্রত্যাখ্যান করার জন্য তৈরি।