৩০শে মার্চ। সকাল ৮ টা নাগাদ বিষ্ণুপুর থানার কোম্পানির পুকুরে আমতলা-বারুইপুর রোডের খালের ধারে পথ চলতি গ্রামের মানুষ এক যুবকের মৃতদেহ দেখতে পায়। যুবকের মাথাটা খালের জল-কাদার মধ্যে ডোবানো ছিল। তাই কার মৃতদেহ প্রথমে কেউই বুঝতে পারে নি। পরে সবাই বোঝেন এই দেহ স্থানীয় যুবক বিদ্যুৎ মন্ডলের। পুলিশকে খবর দিলে তারা এসে মৃতদেহ তুলে নিয়ে যায়, আর যথারীতি সাজানো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেয়।

তারপর থেকে ঘটনাস্থল, বিদ্যুৎ-এর বাড়ি বা গ্রামে কোথাও পুলিশ যায়নি। গ্রামের মানুষ বিদ্যুৎ এর চটি ছাড়া আরও এক জোড়া জুতো, একটা ইঞ্জেকশননের সিরিঞ্জ আর দুটো মোবাইল ফোন খুনের ঘটনাস্থল থেকে পেয়ে পুলিশে জমা দিয়ে আসে। ঘটনাস্থলে কাদায় ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল স্পষ্ট। পুলিশ কিন্তু ভুলেও আর ঐ রাস্তায় যায়নি। পুলিশ কুকুরও যায় নি।
কেন? এই প্রশ্ন ওঠা কি অস্বাভাবিক?

এই খুনের খবর ছবি ভিডিও সহ এগিয়ে-পিছিয়ে থাকা সহ, নানা নম্বর সম্বলিত সংবাদমাধ্যমগুলোকে পাঠানো সত্ত্বেও তা বেমালুম চেপে দেওয়া হ’ল? কেন?
এই প্রশ্ন তোলা কি অগণতান্ত্রিক?

বিদ্যুৎ এর ভাই ও বিধবা মা পুলিশে অভিযোগ করতে যান। এই অভিযোগ নিতেও বিষ্ণুপুর থানার পুলিশ গড়িমসি করে, এমনকি উপস্থিত সিপিআই(এম) নেতাদের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে। তা সত্ত্বেও জেদ ধরে দীর্ঘ সময় বসে থেকে পুলিশকে অভিযোগ নিতে বাধ্য করে, বিদ্যুৎ এর ভাই সহ স্থানীয় সিপিআই(এম) নেতৃত্ব।
পুলিশে অভিযোগ জানাতে চাওয়াটাও কি খুবই অন্যায় কাজ?

৩০শে মার্চ থেকে পুলিশ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই একবারের জন্যও কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, কাউকে আটক করেনি, কোনও তৎপরতা দেখায়নি, খুনের ঘটনার তদন্ত করার প্রশ্নে। কেন করেনি? এই প্রশ্ন তোলা অপরাধ?

কেন খুন হ’লো বিদ্যুৎ?
একটি নাবালিকা মেয়েকে জবরদস্তি বিয়ে করতে চায় একটি ছেলে, যে কি না স্থানীয় তৃণমূলের এক জমি মাফিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ায় বিদ্যুৎ। পুলিশের কাছে পরিবারটির সদস্যদের নিয়ে যায় বিদ্যুৎ এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে। যেহেতু শাসকদলের জমি মাফিয়ার ঘনিষ্ঠ এই অন্যায় কাজে যুক্ত, তাই পুলিশ এই অভিযোগকে আমল দেয়নি স্বভাবিকভাবেই।নাছোড়বান্দা বিদ্যুৎ জাতীয় মহিলা কমিশন সহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠি পত্র লিখে, পুলিশকে বাধ্য করায় অভিযোগ নিতে এবং লোক দেখানো সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ছেলেটি ও তার পরিবারের কয়েকজনকে পুলিশ বাধ্য হ’য়ে গ্রেফতার করে।

বিদ্যুৎ কি অন্যায় করেছিল? বিদ্যুৎ
ডি ওয়াই এফ আই ও সিপি আই(এম) কর্মী। তাই দলের শিক্ষায়- নীতিতে উদবুদ্ধ বিদ্যুৎ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অসহায় দরিদ্র নাবালিকার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এটা কি অপরাধযোগ্য কাজ?

এইবার শাসকদলের মাফিয়ারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ দীর্ঘ ৬মাসের বেশি সময় ধরে বাড়ি ও গ্রাম ছাড়া হতে বাধ্য হয়।

নাবালিকার বিয়ে আটকানোর জন্য বাড়ি ছাড়া, কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন- সংবাদ মাধ্যম নীরব, নিশ্চুপ – এটা একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতা? কোথায় যাচ্ছে বাংলা? প্রশ্নটা কি খুবই অশালীন?

এরপর স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতা সালিশি সভা ডেকে নিদান দেয়, ২লক্ষ টাকা জরিমানা দিলে গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হবে বিদ্যুৎকে। এটা খাপ পঞ্চায়েত নয়? সারা বাংলা জুড়ে এই খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা তুলছে তৃণমূলীরা – এটা জানে না পুলিশ? থানায় এর প্রতিকার চাইতে গেলে পুলিশ কি বলে না, কিছুটা কম করে দিচ্ছি, টাকা দিয়ে মিটিয়ে নিন? এটা কে না জানে? কোনও সান্ধ্য কালীন আলোচনা এই নিয়ে হয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে? খুব অস্বস্তিকর, শালীনতার মাত্রা ছাড়ানো প্রশ্ন হয়ে গেল – তাই না!!

নাবালিকাকে বে আইনিভাবে বিয়ে করা আটকানোর জন্য বাড়ি ছাড়া, তারপর আবার ২লক্ষ টাকা জরিমানা – এই হ’লো তৃণমূলের খাপ পঞ্চায়েতের নিদান। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন সংবাদ মাধ্যম সব জেনেও নীরব। এটাই বর্তমানে গণতন্ত্রের ‘বাংলা মডেল’।

বিষ্ণুপুর থানার আন্ধারমানিক, জুলপিয়া সহ ৪/৫ টা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা সম্পূর্ণভাবে তৃণমূলী জমি মাফিয়াদের দখলে। কেউ বিরোধিতা করতে পারে না। মেরে, ঘর জ্বালিয়ে জমি কেড়ে নিয়ে সব সিপিআই(এম) কর্মীদের গ্রামছাড়া করেছে এই জমি মাফিয়ারা পুলিশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ২০১১ সালের পর থেকেই। এমন কি যে তৃণমূল কর্মী বা সমর্থকরা প্রতিবাদ করেছেন, তাদেরও একইভাবে অত্যাচারিত হ’তে হয়েছে। এখানে সব তৃণমূলী জমি মাফিয়াদের হাতে পিস্তল। সমগ্র দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার পুলিশের কাছে মোট যা আগ্নেয়াস্ত্র আছে তার কয়েকগুণ বেশী আগ্নেয়াস্ত্র আছে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের ভাইপো নিয়ন্ত্রিত তৃণমূলী মাফিয়াদের হাতে। পুলিশ মন্ত্রী, পুলিশ, প্রশাসন, সংবাদ মাধ্যম – কে জানে না একথা? কিন্তু প্রশ্ন তোলা যাবে না? তাতে মাফিয়া- পুলিশ-তৃণমূল, আর তাদের ধামাধারীদের আতাঁতকে নাকি খুব অসম্মান করা হয়!!

বিদ্যুৎ সাহস করে বাড়ি ফিরেছিল বিধবা মা’র কাছে থাকবে বলে। কপর্দকহীন বিদ্যুৎ জরিমানা না দিয়ে গ্রামে ঢোকার অপরাধে খুন হ’লো।

বিদ্যুৎ এর খুনের প্রতিবাদে ৫ই এপ্রিল প্রায় হাজার খানেক গ্রামবাসীদের নিয়ে থানা ঘেরাও করে সিপিআই(এম)। সেইদিন পুলিশের কর্তারা ১ মাস সময় চেয়েছিলেন, খুনের কিনারা করার জন্য।

১মাস অপেক্ষা করার পর ৭ই এপ্রিল প্রতিবাদ সভা হয় বিদ্যুৎ এর গ্রামের অদূরেই কয়ালের মোড়ে।
খুব অন্যায় হয়েছে এই সভা করা? যেখানে ২০১১ এর পর সিপিআই(এম) কেন, কোনও বিরোধী দলকে গায়ের জোরে কোনও কর্মসূচী করতে দেওয়া হয়নি, সেখানে জমি মাফিয়াদের মুক্তাঞ্চলে ৩ হাজার গ্রামবাসী নিয়ে সভা করার সাহস হয় কি ভাবে সিপিআই(এম) এর!?

এই সভার আগের রাতে ২ জন পুলিশ শহীদ বিদ্যুৎ এর মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, তিনি কাকে সন্দেহ করছেন। অমলাদেবী বলেন, আপনারা পুলিশ এতদিন বাদে এসেছেন? আপনারা কি তদন্ত করছেন যে, এখনও আমার ছেলের খুনের কিনারা হ’লো না?

আসলে পুলিশের উদ্দেশ্য ছিল, যদি কোনো তৃণমূল নেতা বা তাদের ঘনিষ্ঠ কারোর নাম অমলাদেবী বলেন, সাথে সাথে সেই নাম স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তাহলে টাকার টোপ বা ভয় দেখিয়ে অথবা অত্যাচার চালিয়ে সাক্ষ্যদান থেকে বিরত করা হবে বিদ্যুৎ এর বেঁচে থাকা ভাই, বিধবা মা’ অথবা সাক্ষ্যদানে আগ্রহী গ্রামবাসীদের।

এসব বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যদি না টিকিটা কালিঘাটে বাঁধা থাকে।

পুলিশের কুকুরও গন্ধ শুঁকে খুনীদের শনাক্ত করে দিতে পারে দ্রুত, আর ৩৭ দিনের মাথায়ও পুলিশ বিদ্যুৎ খুনের কিনারা করতে পারে না? তাহলে এত অর্থ ব্যয় করে পুলিশ রাখার অর্থ কি? এর বদলে কুকুর রাখলেও তো কিছু কাজ হ’তে পারতো আর মানুষের ট্যাক্সের টাকাও কম খরচ হ’তো – এই সভায় এই প্রশ্ন তোলা খুবই অশ্লীল?

বিদ্যুৎ খুনের খবর দেখানো হয় না, অথচ কালো টাকা সাদা করার জন্য তৈরি করা ফুটবল ক্লাবের খবর ঘটা করে দেখানো হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর লুচির তাপমাত্রা কত ছিল, সেটাও খবর হয়।

পুলিশের কুকুর খুনের কিনারা করতে পারে, কিন্তু পুলিশ করে না বা করতে পারে না – এই প্রশ্ন তুলে কি ভয়ানক অশালীনতার পরিচয় দিয়েছেন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব!!তাহলে কি বলা উচিত ছিল?

আনিস খান খুনের কিনারা ১৫ দিনে হবে – মূখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ঘটা করে ঘন্টা খানেক, ৯,১৮,২৪ সর্বত্র প্রচার করা হ’লো। কিন্তু আজ ৭৮ দিনের মাথাতেও কিছুই হ’লো না। মীনাক্ষী সহ ১৬ জন আধ মাস জেল খেটে আসলেন, বাম ছাত্র-যুব-মহিলারা কয়েকবার গ্রেফতার হ’লো, আর খুনীরা দিব্যি ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুরছে। এর প্রতিবাদে সান্ধ্যকালীন কোনও আলোচনার আসর বসেনা কেন সংবাদ মাধ্যমে? কি উচ্চ মানের শালীনতাবোধ এটা – তাই না!!
খুনীর গ্রেফতার চেয়ে বামকর্মীরা জেলে যায়, আর খুনীদের আড়াল করা সরকার ফূর্তিতে কেন থাকে? তাহলে পুলিশ-পুলিশ মন্ত্রী এদের কাজ কি? নীরব সংবাদমাধ্যমই বা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ কেন? খুব অশালীন প্রশ্ন হ’য়ে গেল, তাই না!?

কোথায় পুলিশকে খুনের কাজে লাগানো হচ্ছে বা খুনীদের আড়াল করতে কাজে লাগানো হচ্ছে – সংবাদ মাধ্যম জানে না?

একবারও তো বলা হচ্ছে না আনিস হত্যার ৭৮ দিন পরে বা বিদ্যুৎ হত্যার ৩৮ দিন পরেও কেন খুনের কিনারা হয় না?

এটা বুঝতে কারোর অসুবিধা হওয়ার তো কথা নয়, যদি না বিজ্ঞাপন বা খামের লেনদেন থাকে।

আর কালিঘাটে দাসখত দেওয়া থাকলে পুলিশ না পুলিশের কুকুর, কার মান- সম্মান বেশি সেই নিয়ে অযথা বিতর্ক তুলে, খুনীদের আড়াল করার চেষ্টা করাটা বাধ্যতামূলক হয় – এটাও বুঝতে কারোরই বিশেষ অসুবিধা হয় না।

তবে খুনীদের আড়াল করতে গিয়ে অযথা যারা কুতর্ক জুড়লেন তাঁদের অন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। কারণ ক্ষেতমজুর বিদ্যুৎ মন্ডলের হত্যার খবর চেপে রেখেছিল যেসব সংবাদমাধ্যম এতদিন, আজ অযথা কুতর্ক তুলে তাঁরা অন্তত এই নৃশংস খুনের ঘটনাকে প্রকাশ্যে এনে ফেললেন নিজেদের অজান্তেই। আন্তরিক ধন্যবাদ আপনাদের।

বিদ্যুৎ মন্ডলদের লড়াই খবর হয় না, কারণ ওরা ১০আঙুল ভরা হীরে খচিত আংটি ডুবিয়ে ফুলকো লুচি খাবার ক্ষমতা ধরে না। বিদ্যুৎ দের বাড়ির উঠোনে রোলস রয়েস- মার্সিডিস- পোর্শে গাড়ি থরে থরে সাজানো থাকে না। ওরা কোটি কোটি টাকা ব্যাঙ্কের থেকে নেওয়া ঋণ ফেরত না দিয়েও নানা মন্ত্রী/আমলার সাথে বৈঠক করার সুযোগ পায় না। সর্বোপরি খবর ছাপা বা চাপার জন্য কর্পোরেট মিডিয়াকে বিজ্ঞাপন বা খাম দেওয়ার ক্ষমতা ধরে না।

তবে এই পৃথিবীতে সবাই শুধু পকেট বা পাকস্থলীর জন্যই বাঁচে না, মেরুদণ্ডটার গুরুত্ব বিদ্যুৎ -দের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তাইতো এক বিদ্যুৎ শহীদ হ’লে হাজার বিদ্যুৎ এর ঝলক আকাশের অন্ধকারকে ফালাফালা করে দেয়।

শমীক লাহিড়ী
৮ই মে, ২০২২