মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে সরাসরি না হলেও আড়াআড়ি ভাবে সন্দেশখালিতে মেয়েদের বিক্ষোভ নিয়ে অবশেষে দুটো কথা শোনা গেল। তিনি মেনেছেন, ক্ষোভ তো থাকতেই পারে। তাই তো তিনি ওখানে ‘মহিলা টীম’ রেখেছেন, পুলিশেরও ‘মহিলা টীম’ রয়েছে, তদুপরি আসল ঘটনা তো জানতে হবে, তাই সেখানে তিনি খোদ রাজ্য মহিলা কমিশনের সভানেত্রীকেও পাঠিয়েছেন।

মুশকিল হল, জানা যাচ্ছে কোনো টীমই নাকি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে ‘তেমন গুরুতর অভিযোগ’ পায়নি। ধর্ষণের অভিযোগই যেখানে আসছে না, সেখানে নারীনির্যাতন হয়েছে বলা যায় কীকরে? রাত্রিবেলায় পার্টি অফিসে বা ক্লাবে ডেকে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা, আপত্তি করলে স্বামীসন্তানকে তুলে নিয়ে যাবার হুমকি, ক্লাবের মোচ্ছবে মেয়েদের অংশগ্রহণ করতে এবং নানা আপত্তিজনক ‘কাজ’ করতে বাধ্য করা এইসব অভিযোগই যে আইনত নারীনির্যাতনেরই উদাহরণ– ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির কথা কেউ প্রাথমিক ভাবে না বললেও– মুখ্যমন্ত্রীর ‘টীম’ সেকথা মানতে নারাজ। খোদ মহিলা কমিশনের সভানেত্রীও এমনই আইনজ্ঞ যে এই বিচারের ওপর তাঁর শিলমোহর দিয়ে তিনিও বলেছেন ওখানে গিয়ে তিনি তেমন ভারি অভিযোগ কিছু পাননি। নালিশগুলি আরো খতিয়ে দেখে তার মধ্যে সারমর্ম আরো কিছু পেলেন কিনা এবিষয়ে তাঁর কোনো অভিমতও ফিরে যাবার পর থেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।

আইনের কচকচিতে জড়িয়ে পড়ে লাভ নেই। সন্দেশখালির মহিলারা লাঠিবাঁশ নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, এলাকার রাজা শাহজাহানের লোকজনকে মরিয়া হয়ে তাড়া করছেন, গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছেন না, তার প্রেক্ষাপটটা আরো অনেক বড়ো। এলাকার অনেক পরিবারের পুরুষেরা মারধোর, গায়েব করে দেওয়া, ফসল কেটে নেওয়া, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেবার ভয়ে গ্রামে থাকতে পারছেন না। নিজেদের এবং সন্তানদের রক্ষার্থে তাই মেয়েদেরই বাধ্য হয়ে মাঠে নামতে হয়েছে। অত্যাচার চরমে পৌঁছে গেছে বলেই নীরবে সহ্য করতে অভ্যস্ত গৃহবধূরাও উপায়ান্তরবিহীন হয়েই ফণা তুলে দাঁড়িয়েছেন।

এই দুর্বৃত্তরাজ তো সন্দেশখালিতে অনেক বছর ধরেই চলছে; শাহজাহানদের বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়েছে কখনো শুভেন্দু অধিকারী, কখনো জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকদের ছত্রছায়ায়। বামপন্থীদের অস্তিত্বও এই সময় জুড়ে প্রান্তিকই হয়ে গেছে সেখানে। জমি লুট করে তৃণমূল নেতার ‘ফার্ম’ তৈরি, মেছো ভেড়ি বানানো, একশো দিনের কাজের টাকা কেড়ে নেওয়া, পাচার ও সবরকম বেআইনি কাজ তো কোনোরকম বড়ো বাধা পায়নি অনেকদিনের মধ্যে। বরং মুখ্যমন্ত্রীর অনবদ্য ভাষায় ওখানে আর এস এস ঢুকে পড়ার ফলে (যেন তাঁর অজান্তেই ঢুকেছে) কিছু ‘দাঙ্গা স্পট’ও তৈরি হয়ে গেছে। এবারেও সন্দেশখালির বিক্ষোভ শুরু হবার পর হঠাৎ করেই এই ধুয়ো উঠেছিল যে ওখানে অত্যাচারিত হিন্দুরা অত্যাচারী মুসলিম সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। লক্ষণীয় এবারে এই ধুয়ো এখন পর্যন্ত তেমন ফলপ্রসূ হয়নি।

আর আসল প্রশ্নটা এইখানেই। তৃণমূলের নেতানেত্রীদেরও প্রশ্ন সেটাই। সত্যিই যদি তোদের ওপর এতদিন ধরে এত অত্যাচার চলছিল তাহলে এর আগে তা নিয়ে তোরা নালিশ জানাসনি কেন? এখন হঠাৎ করে মুখে কথা আসছে তার অর্থ তোদের কেউ উশকানি দিচ্ছে অশান্তি তৈরি করতে। ক্ষমতায় অন্ধ এই নেতানেত্রীরা বোঝে না যে বাস্তব পরিস্থিতি কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। পরিপার্শ্বগত অবস্থার পরিবর্তনের প্রভাব মানুষ—সবচাইতে অসহায় দীনহীন মানুষও– অনুভব করে, মাথা তোলার চেষ্টা করে, দমবন্ধ অবস্থাকে কাটিয়ে উঠতে আপ্রাণ সক্রিয় হয়। সেচেষ্টার জন্য বাইরে থেকে উশকানির দরকার হয় না। এপ্রতিবাদ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। দশবারো বছরে ক্ষমতার ভারসাম্য না টললেও পশ্চিমবঙ্গেও যে পরিস্থিতি কিছু কিছু বদলাচ্ছে এই উত্থান তারই প্রতিক্রিয়া।

নিরাপদ সর্দার বা এমন কাউকে এর খেসারত দিতে বিনা অপরাধে জেলে যেতে হতই। আসলে কিছুদিন আগে সন্দেশখালি প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য তিনি করেছিলেন যার মধ্যে কিছু সারগর্ভ কথার উচ্চারণ আছে,  যা আমাদের বামপন্থীদের গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করা দরকার। উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারছি না; কিন্তু মোটামুটি তিনি যা বলেছিলেন তা এই যে, বর্তমানে সন্দেশখালিতে অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের মধ্যে একটা মেরুকরণ ঘটেছে; ধর্মজাতপাতনির্বিশেষে অত্যাচারিতরা এককাট্টা হতে সক্ষম হয়েছে বলেই আমরা সন্দেশখালির কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। আরো একটি কথা যোগ করা যায় এইসঙ্গেঃ এই সাধারণ মানুষের অনেকেই এতদিন তৃণমূল আর বিজেপির সঙ্গে ঘুরেছে, তাদের মিছিলে মিটিং-এ গেছে, তাদের প্রসাদ পেয়েছে; কিন্তু আজ যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ‘অত্যাচারিত’ এই পরিচয়টা তাদের একই লক্ষ্যে নতুন করে মিলিয়ে দিয়েছে। তৃণমূল-বিজেপি আর এদের ওপর নিজেদের প্রভাব নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না।

যে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনেরই ভিত্তি যারা উৎপীড়িত ও বঞ্চিত তাদের জোট বাঁধা। সন্দেশখালিতে সেটা ঘটেছে। কোনো রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা এই বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে এমনটা নয়। বামপন্থী গণসংগঠনগুলি তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, এই ক্ষোভকে জনাবর্তে প্রচার করার কাজে কিছুটা সহায়ক হয়েছে এই পর্যন্ত আমরা বলতে পারি। বস্তুত এর আগে যেখানে সম্ভব সন্দেশখালি ও সংলগ্ন এলাকায় সন্ত্রাসের চিত্রও বামপন্থী গণমাধ্যমই একমাত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সন্দেশখালির মানুষের এই উত্থান ঘটার আগে পর্যন্ত তা ছিল অরণ্যে রোদন। এই প্রসঙ্গে শত্রুপক্ষের যে ঘুঘুটির বিবৃতিও আমাদের একটু মন দিয়ে শোনা উচিত তিনি হলেন তৃণমূলের প্রধান মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। কারো কারো মনে থাকতে পারে আন্দোলন শুরু হবার অল্পদিন বাদেই এই সবজান্তাটি কিছুটা হুমকির সুরে জানিয়েছিল, এই বিক্ষোভ নিয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা করার কিছু নেই। কিছুদিনের মধ্যেই এটা চাপা পড়ে যাবে; খবরের কাগজ বা চ্যানেলে সন্দেশখালির নাম কিছুদিন বাদে আর শোনা যাবে না। এর সবটা অন্তঃসারশূন্য আস্ফালন ছিল না।

ঘুঘুরা ভালোই বোঝে যে অত্যাচারিত মেয়েরা আগুয়ান ভূমিকায় আসার পর থেকেই সন্দেশখালির খবর জনাবর্তে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এও জানে যে এরা  গৃহস্থঘরের মেয়েবউ। প্রাত্যহিক জীবনজীবিকার লড়াই নিয়ে উদব্যস্ত, রুজির জন্য এটাওটা কাজও এদের অনেককেই করতে হয়। সেইসব জোগাড় করে, ভাতের হাঁড়ি উনুনে চাপিয়ে ক্ষুধিত বাচ্চার কান্না থামিয়েই তারা শাহজাহানের ফৌজের হাত থেকে গ্রামরক্ষার অসম লড়াই করে চলেছে। এমন স্বতঃস্ফূর্ততা দৈনন্দিনের তাগিদেই একটি স্বাভাবিক সময়সীমায় নিবদ্ধ। এই এক আন্দোলন অন্যান্য জায়গায় অন্যান্য উৎপীড়িতের আন্দোলনের আগুনের সঙ্গে মিশলে তবেই শুধু তা দাবানলে পরিণত হতে পারে। সেটা যাতে কোনোমতে না ঘটে তা সুনিশ্চিত করতে হবে, ঘুঘু তার বিবৃতিতে এই ইঙ্গিতই দিয়েছে।

একদিকে পুলিশের লাগাতার ভীতিপ্রদর্শন, মাস্তানবাহিনীকে অবাধে বিচরণ করতে দিয়ে আতংক জিইয়ে রাখা, মামলার পরে মামলা, অন্যদিকে মমতা-কথিত ‘টীম’গুলির জমজমাট আনাগোনা, কেন্দ্র ও রাজ্যের নানা কমিশনের আশ্বাস, মিডিয়ার দাক্ষিণ্য ইত্যাদি কারণে যে প্রাত্যহিক অত্যাচার মেয়েরা সহ্য করছিলেন তার থেকে কিছুটা সাময়িক রেহাই– এগুলো সবই অবস্থাকে সামাল দেবার জন্য শাসকের বহুমুখী কৌশলকে মজবুত করে। শুভেন্দুদের সার্কাসও এলাকায় নিজেদের প্রভাব ফিরিয়ে আনারই পূর্বপ্রস্তুতি। কুণাল ঘোষের ধূর্ত বিবৃতি একদিকে ‘উশকানি’র তত্ত্বকে চাউর করে যাতে বিক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ততা নজরে না আসে, অন্যদিকে এধরনের সব আন্দোলনই যে শেষপর্যন্ত শাসকের সঙ্গে সমঝোতায় শেষ হতে বাধ্য এই নষ্টদুষ্ট সাংসারিক জ্ঞানটি সেখানে তুলে ধরা হয়।

একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন একটি শমে আসার মানেই কিন্তু এই নয় যে তা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেল। স্বতঃস্ফূর্ততার সুযোগ নিয়ে তাকে বিপথে টানবার, অত্যাচারী-অত্যাচারিতের মেরুকরণকে হিন্দু-মুসলমানের মেরুকরণে পরিণত করার সম্ভাবনা থেকে যায় বইকি। তবু কখনো কখনো জন-আন্দোলনের ইতিহাসে আমরা এমনও দেখি যে জোটবদ্ধ লড়াইয়ের একটি স্থায়ী রেশ সাধারণের মনের জমিতে থেকে যায়, আবার দুচারবছর পরে সুযোগ পাবামাত্র সেখানে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যূথবদ্ধ অসন্তোষের আঁচ টের পাওয়া যায়, আন্দোলনের নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। অথবা এমনও হয় যে এক এলাকার বিক্ষোভে ভাটা পড়লে পাশের এলাকাতে সেই একই আগুন জ্বলে ওঠে।

এখন সন্দেশখালিতে শাসকের উদ্দেশ্য মেয়েদের কিছুটা ভয় দেখিয়ে, কিছুটা আশ্বাস দিয়ে রাস্তা থেকে ঘরে ফিরিয়ে আনা। এর জন্য রাজনৈতিক বিরোধীদের গালাগাল দেবার পাশাপাশি মেয়েদের ওপর দৈনন্দিন অত্যাচারে কিছুটা ক্ষান্তি দেওয়া, নিজেদের দু-চারটে চুনোপুঁটিকে গ্রেফতার করা, এমনকী দরকার বুঝলে মায় শাহজাহান বা শিবু হাজরাকে গোপন ঘাঁটি থেকে বাইরে বার করা ইত্যাদি লোক-দেখানো কিছু পদক্ষেপ তারা নিতেই পারে। এভাবে আন্দোলনকে কিছুটা প্রশমিত করলে মানুষ ভাববে লড়াইয়ের ফল কিছুটা পাওয়া গেল।

কিন্তু মানুষ যখন এই সীমিত সাফল্যে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচছে, সেই অবকাশে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে পারে জমির দখল নিয়ে বৃহত্তর লড়াই। যে হাজার হাজার একর জমি তৃণমূলীরা (কোথাও কোথাও আর এস এস) পুলিশ ও মাস্তানদের সাহায্যে নিজেদের কুক্ষিগত করেছে, যে হাজার হাজার মানুষকে নিজ বাসভূমে গৃহহারা করেছে, ঘর ছেড়ে পরিবার ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছে, যেসমস্ত এলাকাকে যথেচ্ছাচারের রাজত্বে পরিণত করা হয়েছে সেখানকার পরিস্থিতিটাকে যাতে আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যায়, বিক্ষোভের সীমানার বাইরে লোকচক্ষুর বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়, এই মুহূর্তে শাসকের কাছে সেটাই সবচাইতে জরুরি। জমানা যে তাদেরই এই বিশ্বাসে মানুষের সমর্থন ফিরে পেতে কমরেড নিরাপদ সর্দার যাকে ‘অত্যাচারিতের জোট’ বলেছেন সেই ধারণাটাকেই তাদের নস্যাৎ করতেই হবে। শুধু পাশে থেকে সমর্থন জানানো নয়, এলাকার মধ্যে বামপন্থীদের স্থায়ী প্রভাব বৃদ্ধি পেলেই একমাত্র সেই ‘অত্যাচারিতের জোট’-এর ভিত্তি আরো মজবুত হতে পারে।