লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় পর্বের আগে রাজ্যে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সন্দেশখালি নিয়ে এক ভিডিও ঘিরে তোলপাড় হচ্ছে গণমাধ্যমে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গবাসীরা জেনে গেছেন সন্দেশখালির জঘন্যতম ঘটনাক্রম। শাহজাহান, শিবু হাজরা কারা এ কথা জেনে গেছেন রাজ্যের মানুষ। কি ঘটেছিল সন্দেশখালিতে কিছুই রাজ্যের মানুষ জানতে পারত না যদি না গ্রামের মহিলারা একজোট হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ন্যাকারজনক যৌন নির্যাতনের কথা মিডিয়ার সামনে না আনত। দেশজুড়ে নারী নির্যাতন বেড়ে চলেছে। আমাদের রাজ্যেও তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় নারী নির্যাতনে শীর্ষে। কিন্তু সন্দেশখালির ঘটনা সব নির্যাতন ছাপিয়ে চলে গেল।

দিনের পর দিন তৃণমূল কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে শিবু হাজরা, শেখ শাহজাহান সহ দুষ্কৃতী বাহিনী গ্রাম দাপিয়ে বেড়িয়েছে। একের পর এক জমির পাট্টা কেড়ে নিয়ে চাষের জমি দখল করে মাছের ভেড়ি বানিয়েছে। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন যে এই পাট্টা তাঁরা পেয়েছিলেন অতীতের বামফ্রন্ট সরকারের জমানায়। এই লুঠের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের মুখ বন্ধ করার জন্য গ্রামের পরিবারগুলির উপর নামিয়ে আনা হল যৌন সন্ত্রাস। মহিলাদের তৃণমূল কংগ্রেস অফিসে ডেকে নিয়ে চলে ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়ন। এ নিয়ে মুখ খুললে তাঁদের ঘরের পুরুষদের উপর নামিয়ে আনা হত অত্যাচার। এই ধরণের ঘটনা দেশে বিরল। সন্দেশখালিতে ২০১৬ পর্যন্ত্য বিধায়ক ছিলেন সি পই আই এম এর নিরাপদ সর্দার। তিনি এবারে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী। তিনি জানিয়েছেন যে ২০১৩ সালে তিনি বিধানসভায় সন্দেশখালির সন্ত্রাসের কথা জানিয়েছিলেন। বিধানসভার ধারাবিবরণীতে দেখা যায় যে তিনি বলেছিলেন যে জমি যাতে এরা ফেরত পায় এবং পুলিস যাতে নিরপেক্ষভাবে বর্গাদারের পক্ষে কাজ করে সেই দাবি তিনি করেছিলেন বিধানসভায়। এমন তথ্যও আছে সেই ধারাবিবরণীতে যেখানে তিনি বলেছিলেন জেরিয়াখালি গ্রাম পঞ্চায়েতে বলপূর্বক জমি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা। বিধানসভায় গণধর্ষণ , গ্যাং রেপের কথা বলার সময়ে বিধানসভার মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি সব কথা বলেছিলেন বিধানসভায়। সন্দেশখালি থেকে ঘরছাড়া হন বামপন্থী সমর্থকেরা। সেই কথাও বলেছিলেন তিনি। কিন্তু এ সত্ত্বেও শাহজাহান, শিবু হাজরার দাপট কমে নি। উত্তর ২৪ পরগণার সন্দেশখালি গত এক দশকে হয়ে ওঠে তৃণমূল কংগ্রেসের এক সন্ত্রাসের রাজত্ব।

এই সন্ত্রস্ত এলাকায় দাপিয়ে বেড়াত তৃণমূল কংগ্রেসের আশ্রিত মাফিয়া বাহিনী।

জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে এই গ্রামের মহিলারা একজোট হয়ে মিডিয়ার সামনে এই সন্ত্রাসের কথা ব্যক্ত করেন। গ্রামের কোন মহিলা বা পুরুষ সেই কথার বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি। সংবাদের শিরোণামে চলে আসে সন্দেশখালি।

এখন এক ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে বিজেপির মণ্ডল সভাপতি বলছেন যে টাকা দিয়ে গ্রামের মহিলাদের যৌন অত্যাচারের কথা বলানো হয়েছিল। একটি অপরিচিত স্টিং অপারেশনের ফলে এই ভিডিও নাকি সকলের সামনে আসে। অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জির পার্ক স্ট্রীট কাণ্ডের পর যে বলেছিলেন ‘সাজানো ঘটনা’ তার এক পুনরাবৃত্তি আমরা দেখলাম। ভিডিও যদি সঠিক হয়, তবে বিজেপিও এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত মেনে নিতে হবে। আর ভিডিও যদি ‘সাজানো’ হয়, তবে তৃণমূল কংগ্রেস দলের প্রবৃত্তি যে মহিলাদের সম্মানহানি করা তা অতীতের মত স্পষ্ট হয়ে যাবে। গ্রামের সব মহিলারা মিলে যে কথা বলেছেন, এবং পুলিশ তা নিয়ে খোঁজ খবর করেছে, মহিলারা গোপন জবানবন্দী দিয়েছেন, তা মিথ্যা কখনো হয়? তাই তো ঘটনা ঘটার পরেই নিরাপদ সর্দারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল তাঁর মুখ বন্ধ করার জন্য, যা কোনদিনই সম্ভব হবে না।২০১৩ সালের তাঁর বিধানসভায় উল্লিখিত সন্ত্রাসের খবর এখন সকলে জেনে গেছেন।মহিলাদের সম্পর্কে এই কথা বলা সন্দেশখালির মহিলাদের উপর আবারও সন্ত্রাস নামিয়ে আনার সামিল। আর এই সন্ত্রাসের দায় তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয়েরই।বিজেপি যদিও এই ভিডিওর কথা অস্বীকার করছে, আমাদের মনে করতে হবে কি ভূমিকা ছিল বিজেপির সন্দেশখালি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। তারা বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক হিন্দু-মুসলিম বিষয় বলে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল।বিজেপি-তৃণমুল কংগ্রেস এই দুটি দল কেউই সন্দেশখালির মহিলাদের মান-মর্যাদার কথা ভাবে নি। এই দুটি দলের বাইনারির মধ্যে মহিলাদের মানসম্মানের, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্ভ্রমের কোন জায়গা নেই। যে যৌন নিপীড়নের মধ্য দিয়ে এই গ্রামের মহিলারা দিন কাটিয়েছেন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তার কোন নজির সভ্য দেশে হয় না। যখন তখন যাকে খুশি তৃণমূল কংগ্রেসের অফিসে ডেকে নেওয়ার ঘটনা মিথ্যা নয়। তৃণমূল কংগ্রেস অতীতে এরকম একজন চম্পলা সর্দারকে একবার হাজির করিয়েছিলেন ‘সাজানো’ ঘটনায়, তাই তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মনে করেন দলে দলে মহিলাদের মানসম্মান নিয়ে এইভাবে ছিনিমিনি খেলা যায়। অডিও ভিস্যুয়াল মিডিয়ার ফুটেজে নেত্রীকে বলতে শোনা গেছে যে কিছু স্থানীয় ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ দেখছে। একথা তো তিনি বলেছিলেন। গ্রামের মহিলারা অত্যাচার সইতে সইতে ক্ষেপে উঠেছিলেন এবং তাদের সাথে গ্রামের মানুষ ক্ষেপে উঠেছিলেন বলে পুলিশ শাহজাহান, শিবু, উত্তমকে গ্রেপ্তার করে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। গণবিক্ষোভের মুখে ছিল সেদিন এই দুষ্কৃতীরা। সন্দেশখালির মানুষের সাথে যে ঘটনা ঘটেছে তার কোন ক্ষমা হয় না।

যে কোন মাফিয়া দুষ্কৃতীবাহিনী কোন অঞ্চলে লুঠপাট চালাতে হলে সবচেয়ে প্রথমে সে অঞ্চলের মহিলাদের মানসম্ভ্রম কেড়ে নেয়, যৌন নির্যাতনের হুমকি দেয়, তারপর দেয় ধর্ষণের হুমকি এবং সাথে সাথে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। দুষ্কৃতীরা মনে করে যে এইভাবেই চুপ করানো সম্ভব মানুষকে এবং তারাও বিনা বাধায় জমি কাড়া, পাট্টা কেড়ে নেওয়া, চাষের জমিতে নোনা জল ঢোকানো এই সব বিনা বাধায় করে যেতে পারবে।কিছুদিন এইভাবে চালানো সম্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত্য সত্য সামনে আসবেই। মানুষ যে মুখ বুজে চুপ করে সব সহ্য করে না, সন্দেশখালি তার প্রমাণ।

আজ তৃনমূল কংগ্রেস এই ভিডিও সত্যি বলে বলছেন যে মহিলাদের বিজেপি টাকা দিয়ে এই কথা বলিয়েছে! আর কত নীচে নামতে পারে একটি রাজনৈতিক দল? মহিলাদের এত অসম্মান আর যৌন নির্যাতনের নজির তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি দল যা গত কয়েক বছরে রেখেছে, তা দেশের, রাজ্যের মাথা সারা পৃথিবীর কাছে নীচে নামিয়ে দিয়েছে।কি ঘটেছিল হাসখালিতে? কি ঘটেছিল কামদুনিতে? কি ঘটেছিল ধূপগুড়িতে? প্রতিটি যৌন নির্যাতন, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুনের ঘটনায় অভিযুক্তকে আশ্রয় দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস দল। এই দল অপরাধকে সবসময় প্রশ্রয় দিয়েছে। যেমন বিজেপি দলও অপরাধীকে আড়াল করেছে এবং ধর্ষককে আশ্রয় দিয়েছে। কি ঘটেছিল উন্নাওতে? কি ঘটেছিল কাঠুয়াতে? কি ঘটেছিল বিলকিস বানোর ক্ষেত্রে? কি ঘটেছিল দেশের মেডেলজয়ী কুস্তিগিরদের সঙ্গে? দেশের নাম উজ্জ্বল করা মহিলা কুস্তিগিররা দিল্লীর রাজপথে তাঁদের মেডেল রেখে বিজেপি সাংসদ ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার প্রতিবাদ করেননি? এই ঘটনার কোন ক্ষমা হয়? এখন এই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ব্রিজ ভূষণকে প্রার্থী না করে তার ছেলেকে প্রার্থী করেছে; ক্ষোভ জানাচ্ছেন কুস্তিগিরেরা। মহিলা কুস্তিগিরেরা সুবিচার পান নি। ওদিকে কর্ণাটকে নির্বাচনে বিজেপি জোটের প্রার্থী প্রজ্জ্বল রাভান্না একের পর এক ধর্ষণকাণ্ডকে ক্যামেরাবন্দী করে রেখেছেন! এই অপরাধের কোন ক্ষমা হয়? এ নিয়ে বিজেপি দল বা কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় মহিলা কমিশন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। প্রজ্জ্বল রাভান্না দেশ ছেড়ে এখন অন্যত্র রয়েছেন বলে জানা গেছে।

সন্দেশখালির ঘটনা বেনজির। বিজেপি এই ক্ষেত্রে সাধু সাজলেও বিজেপি দলের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলিই দেখিয়ে দিচ্ছে যে তারাও মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনকারী এবং ধর্ষকদের আশ্রয় দিয়ে এসেছে। তৃনমূল কংগ্রেস দল এবং বিজেপি-এই দুটি দল বিশেষ করে মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতকদের, অপরাধীদের আড়াল করেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে।যে কোন অপরাধের ক্ষেত্রেই বিজেপি সাম্প্রদায়িক তাস খেলে মানুষের মধ্যে বিভাজন বাড়িয়ে দিয়েছে। সব ধর্ম জাতপাত নির্বিশেষে গরিব সাধারণ মানুষকে সন্ত্রস্ত করে, মহিলাদের সম্মান কেড়ে এই দুটি দল লুঠ তরাজ চালাচ্ছে। সন্দেশখালির ঘটনা এই কথা আবার সামনে এনে দিল।মহিলাদের সম্পর্কে, তাঁদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে এই দুটি দল একরকম দৃষ্টিভঙ্গী বজায় রাখে। সন্দেশখালির ঘটনা প্রকাশ্যে আনল যে ধর্ষকদের কিভাবে যেন তেন প্রকারেণ সুরক্ষা যোগায় এই দল।এখন গ্রামের মহিলাদের সুবিচারের কথা পিছনে পড়ে যাবে কি? সামনে কি মিডিয়া এবং আলোচনায় এই দুই দলের নির্বাচনের বাইনারি মুখ্য হয়ে উঠবে? নির্বাচন কি সন্দেশখালির মহিলাদের কান্না, যন্ত্রণা ঢেকে দেবে না কি মানুষই এই অসম্মানের উত্তর দেবে? এই দুই দলের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার লড়াই এই ভিডিও প্রকাশ করে সাধারণ মহিলাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে চাইছে। সন্দেশখালির লড়াই, মহিলাদের অসম্মানের কোন নজির এই রাজ্যে নেই, কোথাও নেই। আগামী দিনে মানুষই এর উত্তর দেবে।