সুন্দরবনের দীপাঞ্চল এলাকার সন্দেশখালি — লোনা মাটির এলাকায় লড়াই শুরু হয়েছে। এ লড়াই এক দ্বীপ থেকে আর এক দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ছে।বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায়,” রাফ অ্যান্ড টাফ”-এর সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনীদের বিরুদ্ধে মহিলারা রুখে দাঁড়িয়েছেন।দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, যার ফলেই হাতে যা পেয়েছে তাই নিয়েই মোকাবিলা করছে। ভবিষ্যতে ওই দুষ্কৃতী বাহিনীদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের বুকেই নিশানা করবে সন্দেশখালীর মানুষ।কারণ অত্যাচার শেষ কথা বলে না — শেষ কথা বলে জনগণ ।১৯৭১ — ৭২ এই সময়ে চরম সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছিল এই রাজ্যের তৎকালীন সরকার।তা সত্ত্বেও দমাতে পারেনি মানুষের সংগ্রামী মেজাজ কে।১৯৭১ এর নির্বাচনে মিলিটারি নামিয়েও সিপিআই(এম)কে রোখা যায়নি। বিধানসভা নির্বাচনে সি পি আই (এম)১১১ টি সিট পেয়েছিল একক শক্তিতে।যদিও সরকার করতে ডাকেনি তৎকালীন রাজ্যপাল।।১৯৭২ সালে জাল জোচ্চুরি করে সিদ্ধার্থ শংকর রায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তাঁর নেতৃত্বে সরকার গঠন হলো।১৯৭২ থেকে ১৯৭৭, চলে ছিল চরম সন্ত্রাসের রাজত্ব ।তার মধ্যেই সিপিআই(এম)র নেতৃত্বে বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। চরম সন্ত্রাসের পথে হাঁটতে হাঁটতে ১৯৭৭সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠন করল।তারপর ইতিহাস।সেই শিক্ষা থেকেই আজ সন্দেশখালীর মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। পুলিশি অত্যাচার বাড়ছে এবং তৃণমূল কংগ্রেস ফিনিশিংয়ের চেষ্টা করছে। কিন্তু পারবে কি শেষ রক্ষা করতে !পারবে না। ইতিমধ্যেই প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার।

সিপিআই(এম )রাজ্য কমিটির সদস্য সন্দেশখালির প্রাক্তন বিধায়ক ,ক্ষেতমজুর ইউনিয়নের রাজ্য কমিটির সম্পাদক নিরাপদ সর্দারকে বেআইনি ভাবে পুলিশ যে পদ্ধতিতে গ্রেপ্তার করেছে তা খুবই অমানবিক ও প্রতিহিংসামূলক।দাগী অপরাধী যারা,তাদেরকেও এভাবে গ্রেপ্তার করা হয়নি।প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বরকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য ১১১ জনের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। সেখ শাহজাহান কোথায়? দলদাস পুলিশ সব জেনেও না জানার ভান করছে।সে যদি কাজের লোক ও ভালো ছেলে হয় তাহলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন! তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো র যদি বুকের পাটা থাকে তাহলে ঘোষণা করুক ,” যা শাহজাহান পুলিশের হাতে ধরা দে।” না ,সে সাহস নেই ওনার। উনি পুলিশ দিয়ে ফিনিশিং করতে পারবেন তো !দিন আসছে উনিই ফিনিশ হয়ে যাবেন। উনি তো আবার গুন্ডা কন্ট্রোল করেন।

গুন্ডারাই এবার ওনাকে কন্ট্রোল করবেন ।কতদিন নিরাপদ সর্দারের মত মানুষকে আটকে রাখতে পারবেন।সুশান্ত ঘোষ, মনোরঞ্জন পাত্র সহ পশ্চিম মেদিনীপুরের কয়েকডজন নেতাকর্মীদের জেলে আটকে রাখতে পারলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো।২০১১ সালের পর অনেক পুলিশী অত্যাচার হয়েছে, পার্টি অফিস দখল হয়েছে,বাড়ী ছাড়া হয়েছে, হাজার হাজার সিপিআই(এম)নেতা, কর্মীদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেল খাটানো হয়েছে তা সত্ত্বেও মানুষের দাবী দাওয়া নিয়ে লড়াই বন্ধ করতে পারেনি? লড়াই আরো জমাটী হয়েছে ও হচ্ছে। অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে আজ সন্দেশখালীর মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে ।এক বুক জ্বালা, যন্ত্রণা, ঘৃণা নিয়ে তারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ প্রতিরোধে সামিল হয়েছে। কোনমতেই এই প্রতিবাদ প্রতিরোধকে থামানো যাবে না।১৯৭১ —১৯৭৬ পর্যন্ত আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসকেও মানুষ প্রতিরোধ করতে সমর্থ হয়েছে।

সন্দেশখালির আগুনের উত্তাপ গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। শাহেনসা শাহজাহান, আমিন গাজী, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারকে আজ পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে না। ঠিক যেমন বীরভূমের পাড়ুই গ্রামে সাগর ঘোষ হত্যাকাণ্ডের এফ আই আরে নাম থাকা প্রথম “দুই ভদ্রলোক”কে পুলিশ খুঁজে পাচ্ছিল না। হাইকোর্ট ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন তুলেছিল যে, দুই ভদ্রলোককে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না কেন,–এমনকি সিআইডির তদন্তকারী অফিসারের উপর অনাস্থা প্রকাশ করে হাইকোর্ট অবিলম্বে তার অপসারণও চেয়েছিল।কেন ভর্ৎসনা করেছিল হাইকোর্ট ।১) এফ আই আরে নাম থাকা প্রথম দু’জন ভদ্রলোক অধরা (দুজন ভদ্রলোক হল অনুব্রত মণ্ডল, বিকাশ রায়চৌধুরী এলাকাতেই ছিলেন) অথচ পুলিশ তাদেরকে খুঁজে পাচ্ছিল না। ২) গুলি চালানোয় দুই অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হয়নি(সুব্রত রায় ও ভগিরথ ঘোষ )কে থানার কাছাকাছি ঘুরতে দেখা গেছে ।৩) আহত সাগর ঘোষের বয়ান নেয়নি তদন্তকারীরা ।(ডাক্তার জানিয়েছেন তিনি তখনও সচেতন ছিলেন) ৪) তদন্তকারী অফিসার এই তদন্তের পক্ষে উপযুক্ত নন। হাইকোর্টের নির্দেশ:–*তদন্তের দায়িত্ব নেবেন রাজ্য পুলিশের ডিজি * তিনি দল গড়ে কোর্টের তত্ত্বাবধানে কাজ করবেন।* দলের প্রতি সদস্যকে হতে হবে সৎ ও নিরপেক্ষ।* তদন্তে প্রশাসনের কোন হস্তক্ষেপ চলবে না। ডি জিও রাজ্যের কাছে মতামত চাইবেন না। **প্রথম অগ্রগতি রিপোর্ট চাই পনেরো দিনের মধ্যে।একটা রাজ্যের সরকারের উপর কতখানি অনাস্থা হলে হাইকোর্ট এই নির্দেশ দিতে পারে। লাভপুর গণধর্ষণ কাণ্ডেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিবের পাঠানো রিপোর্টেও সুপ্রিম কোর্ট সন্তুষ্ট হতে পারেনি। পুলিশ ও আমলারা যদি দলদাস হয় তাহলে তার সরকারও এই ভাবেই চলে। জাল জোচ্চুরি, চুরি ,ডাকাতি, ধর্ষণ , মদের টাকার উপরে দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের সরকারটা। পরিবেশ, পরিস্থিতি, দ্রুত বদলাচ্ছে –এটাকে কাজে লাগাতে হবে বামপন্থীদের। বিশেষ করে সিপিআই(এম )কর্মীদের। কত জ্বালা যন্ত্রণা হলে তবেই টিভির সামনে মহিলারা ওই লজ্জার কথা বলতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী সব শুনছেন কি !তিনি কি প্রতিকার করবেন। কিছুই করবেন না। প্রতিকার করতে হবে মানুষকে। সুযোগ এসেছে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। সামনের লোকসভা নির্বাচন। মানুষ সাহস করে প্রতিবাদ, প্রশ্ন করছে ।এটাকেই ছড়িয়ে দিতে হবে সারা রাজ্য জুড়ে।

এরকম চাপা ক্ষোভ অনেক জায়গায় চাপা পড়ে আছে। চাপা ক্ষোভের পাথরটা সরিয়ে দিতে হবে।এই নারী ও টাকা লোভী মস্তানদের ছোটাচ্ছে মহিলারাই। কদিন ধরে সন্দেশখালীতে যা ঘটে চলেছে তা কি মোমবাতি ওয়ালা বুদ্ধিজীবীরা দেখতে শুনতে পাচ্ছেন না!! চুপটি ও ঘাপটি মেরে বসে আছেন কেন? নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর –সেই সময়কার ইন্টেলেকচুয়াল মানুষগুলো গেল কোথায়?? বিবেকবোধ, মনুষত্ব কোথায় গেল তাঁদের। ছিঃ ছিঃ।এখন আবার ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে শুভেন্দু অধিকারী। শাহাজাহানের সাথে উনিওতো মিটিং করেছিলেন।আর ফিনিশিং এর তত্বে উনিওতো বিশ্বাসী।২০১০ সালের মার্চ মাসে এবিজি কে তাড়াতে মমতা ব্যানার্জির স্নেহধন্য শুভেন্দু অধিকারী “কমিটি”করেছিল। সেদিন উদ্ধত সাংসদের উক্তি ছিল ,”আমি স্টাটিং বিশ্বাস করি না। ফিনিশিং -এ করি। বিজেপি ও তৃণমূল দুটি দলই কমিউনিস্ট সহ বামপন্থীদের ফিনিশ করতে পারবে তো! সারা দেশে যা হচ্ছে আমাদের রাজ্যেও তাই হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিবাদ করলে জেল,সারের দাম বাড়ছে কেন জিজ্ঞেস করায় “মাওবাদী”, মৌসুমী ও টুম্পা মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করায় ,রণচন্ডী ভঙ্গিতে তাদেরকে সিপিএম বানিয়ে দেওয়া, কার্টুন আঁকলে জেল, ধর্ষণ মানে সাজানো ঘটনা, ধর্ষণের কিনারা করলে পদচ্যুতি, কৃষক ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করলে অস্বীকার ,সাংবাদিক পেটালেও সাজানো ঘটনা, সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠলে তা কুৎসা ,বামপন্থী হলে মিথ্যা মামলা, প্রতিবাদ করলে পুলিশি অত্যাচার -এই অনবদ্য ফিনিশিং- এর সিরিজ দেখছে রাজ্যবাসী।রাজ্যবাসীদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা –কি হবে রাজ্যে ।রাজ্যে ফিনিশিং মানে ভ্যানিস নয়, ভ্যানিস যদি খুন হয়, ফিনিশ তবে খুনের চেষ্টা । রাজ্য রাজনীতির গণতন্ত্র কে খুন করার চেষ্টা হচ্ছে, মানুষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, কর্মসংস্থানকে খুন করার চেষ্টা হচ্ছে,এই রাজ্যের যুবসমাজের সোনালীস্বপ্ন , শিল্প -সংস্কৃতিকে খুনের চেষ্টা করছে তৃণমূল কংগ্রেসের মাতব্বররা ।আর সেই তৃণমূলের মাতব্বরদের বিরুদ্ধে সন্দেশখালীর মানুষ প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তাদের সাথে আছে রাজ্যের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ।এই আন্দোলনের চাপেই প্রশাসনকে বাধ্য করতে হবে শাহজাহান সহ শিবু হাজরা,উত্তম সরকার, আমীর গাজী কে ধরতে।একদিন না একদিন ধরা তো পড়বেই।এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের এনেই বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করতে হবে।সংসদীয় ব্যবস্থার অভ্যন্তরে ও বাইরে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে আরো জোরদার করতেই হবে।এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।কাজী নজরুল ইসলামের কথায়,”সত্যকে অস্বীকার করিয়া ভন্ডামি দিয়া কখনো মঙ্গল উৎসবের কল্যাণ প্রদীপ জ্বলিবে না।” প্রদীপের তেল শেষ হয়ে আসছে, দপ করে একদিন নিভে যাবে।