সন্দেশখালির প্রাক্তন সিপিআই(এম) বিধায়ক নিরাপদ সর্দার দক্ষিণ কলকাতার টালি নালার ডানদিকে বাঁশদ্রোণী চিরন্তনী পার্কে ভাড়াবাড়িতে থাকেন এই খবর স্থানীয় সিপিআই(এম) নেতৃত্ব এবং তাঁর প্রতিবেশীরা কয়েকজন জানলেও বেশিরভাগ মানুষই জানতেন না। সন্দেশখালির ঘটনার আগে শাজাহান শেখ ফেরার হওয়ার সময় থেকে টিভি চ‍্যানেলে সম্প্রচারিত সাক্ষাৎকার ও ইউটিউবে শেখ শাজাহানকে নিয়ে তাঁর বক্তব্য প্রচার হওয়ার পর তাঁর চেহারার সঙ্গে পরিচিত হলেও গত১১ ই ফেব্রুয়ারি যখন নিরাপদ সর্দারকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন‍্য বাঁশদ্রোণী থানায় নিয়ে আসা হলো তখন অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এমন নিরীহ গ্রাম‍্য মাস্টারমশাইকে কেন কলকাতা পুলিশের একটি থানার জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন পড়ল? তাঁর স্ত্রী দীপা সর্দার বুঝতে পারছিলেন না। ফ্ল‍্যাটের যিনি মালকিন তিনি বললেন কম করে কুড়ি বাইশজন পুলিশ কর্মী দু জন অফিসারের নেতৃত্বে ভ‍্যানে করে তুলে এনেছে। কি এমন ব‍্যাপার হলো যে,ভালো মানুষটাকে এখানকার থানায় নিয়ে আসতে হল? ততক্ষণে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা সম্পাদক রতন বাগচি সোশ‍্যাল মিডিয়া মারফত প্রচার করে দিয়েছেন খবরটি। ফলে দ্রুত সিপিআই(এম) স্থানীয় স্তরের কর্মীরা জেলা কমিটির সদস‍্য মোহিত ভট্টাচার্য ও রওশন মণ্ডলের নেতৃত্বে সমবেত হন বাঁশদ্রোণী থানার সামনে । দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা সিআইটিইউ সম্পাদক দেবাশিস দে হাজির ছিলেন। চলে আসেন আইনজীবী ফিরদৌস শামিম,চন্দ্রচূড় চ‍্যাটার্জী রা। রাজ‍্য কমিটির সদস্য সুদীপ সেনগুপ্ত, কলকাতা জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য সুব্রত দত্তও পৌঁছে যান।

আধঘন্টার মধ‍্যেই বোঝা যায় জিজ্ঞাসাবাদ করার নামে আসলে আটক করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্য খেতমজুর আন্দোলনের অন‍্যতম সংগঠক নিরাপদ সর্দারকে। শুধু তাই নয়, খবর রটে যায় ইডি অফিসারদের ফেরার অভিযুক্ত শেখ শাজাহানের অনুগামী শিবু হাজরার এফ আই আরের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হতে পারে সন্দেশখালির প্রাক্তন বিধায়ককে। ফলে উপস্থিত পার্টিনেতা কিশোর দাশগুপ্ত,যুবনেতা জয় চ‍্যাটার্জী, দ্বৈপায়ন চক্রবর্তীরা শ্লোগান তোলেন ” শাজাহান শিবু হাজরাকে ছেড়ে রেখে নিরাপদ সর্দারকে আটক করা হল কেন বাঁশদ্রোণী থানা জবাব দাও। ” “শেখ শাজাহানকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন মমতা ব‍্যানার্জী জবাব দাও!” তাপস ব‍্যানার্জী,কৌশিক ঘোষ, সম্রাট চক্রবর্তী প্রমুখ পার্টিনেতাদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতা জেলা কমিটি ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা কমিটির নেতারা জেলা সম্পাদক রতন বাগচি ও রাজ‍্য কমিটির সদস্য রাহুল ঘোষের নেতৃত্বে বাঁশদ্রোণী থানায় নিরাপদ সর্দারের সঙ্গে দেখা করেন। ভরসা পেলেন দীপা সর্দার। শাজাহান, শিবু,উত্তম লাল্টুদের দৌরাত্ম্যের সঙ্গে তিনিও পরিচিত। মমতা ব‍্যানার্জী অভিষেক ব‍্যানার্জীর বিরোধীশূন‍্য করার ডাককে বাস্তবায়িত করার জন‍্যই ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোবার পরেই সন্দেশখালি এলাকা ছাড়া করা হয় নিরাপদ সর্দারকে।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর কার্যত সিপিআই(এম) কর্মীদের লক্ষ্য করে ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করা হয় সন্দেশখালিতে বিজেপিকে জায়গা করে দেওয়ার জন‍্য। সন্দেশখালির অনেক দ্বীপের বাসিন্দারা ২০১৮ এবং ২০২১ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন নি। ন‍্যাজাট থানা ও সন্দেশখালি থানা এবং বসিরহাটের এস পি অফিস বার্তা ছড়িয়ে দেন,’ তৃণমূল করতে না চাইলে বিজেপি করুন কিন্তু সিপিআইএম করা যাবে না।”
বাঁশদ্রোণী থানার অফিসার ইনচার্জ অমিত শঙ্কর মুখার্জী রাজ‍্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। ১১ ই ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ তিনি ফিরদৌস শামিম,চন্দ্রচূড় চ‍্যাটার্জী সুদীপ সেনগুপ্ত,শতরূপ ঘোষ,কৌস্তভ চ‍্যাটার্জীদের কাছে স্বীকার করেন “ওপর থেকে ” নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিরাপদ সর্দারকে আটক করে সন্দেশখালি থানার হাতে তুলে দেওয়ার জন‍্য। কেন? নিরাপদ সর্দার সহ ১০১ জন তাকে খুন করার চেষ্টা করেছেন। কবে? ৭ ই ফেব্রুয়ারি। সেদিন সিপিআইএম এর রাজ‍্য কমিটির সভা ছিল কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে,রাজ‍্য কমিটির সদস্য হিসাবে নিরাপদ সর্দার সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। ৮ ই ফেব্রুয়ারি তাঁকে যেতে হয়েছিল খেতমজুর সংগঠনের কাজে বাঁকুড়ায়। তবুও মমতা অভিষেকের পরিকল্পনা মাফিক ফাঁসানো হল নিরাপদ সর্দারকে। কিন্তু একজন ফেরার অভিযুক্ত কেমন করে এফ আই আর করতে পারে? বাঁশদ্রোণীর প্রবীণ পার্টিনেতা প্রদীপ দত্ত যিনি নিজে রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে দীর্ঘ সময়ে কারাবন্দী ছিলেন বাবা অর্ধেন্দু দত্তের সঙ্গে ষাটের দশকের শেষে,তিনি বললেন, “পারে, পুলিশ যদি কোনভাবে তার বয়ান যোগাড় করে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে। এক্ষেত্রেও সম্ভবত তাই হয়েছে। “

ততক্ষণে রাজ্য কমিটির নেতা সুদীপ সেনগুপ্ত ঘোষণা করে দিয়েছেন, “সন্দেশখালি থানার ও সি কে আমরা আমাদের কমরেডকে নিয়ে যেতে দেবো না। দোষী শাজাহান,শিবু হাজরা মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকবে আর নির্দোষ নিরাপদ সর্দারকে পুলিশ আটকে রাখবে তা হতে পারে না। ” সঙ্গে সঙ্গেই জমায়েতের বড়ো অংশ থানার সামনে বসে পড়ে। শ্লোগানের জোর বেড়ে যায়। পুলিশের নিষেধের তোয়াক্কা না করে মধুজা সেনরায়, পৃথা তা সৃজন ভট্টাচার্যরা থানার ভেতরেই শ্লোগান তোলেন “পুলিশ তুমি উর্দি ছাড়ো, তৃণমূলের ঝাণ্ডা ধরো। ” শতরূপ ঘোষ সমবেত পার্টিকর্মীদের বলেন, “পার্টির রাজ‍্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম আসছেন। একটু পরেই পৌঁছে যাবেন রাজ‍্যসভার সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। আমরা বলেছি ততক্ষণ অবধি নিরাপদদা যেন কোন কাগজে সই না করেন। “বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য পৌঁছে গেলেন সওয়া একটা নাগাদ। কাগজপত্র দেখলেন। বললেন “সব ক টাই জামিন অযোগ্য ধারা। কিন্তু মিথ‍্যা মামলা তো! নিম্ন আদালত জামিন না দিলে হাইকোর্টেই মুখ থুবড়ে পড়বে।” উত্তেজনা বাড়তে থাকে উপস্থিত পার্টি কর্মীদের মধ‍্যে। মিডিয়ার সাংবাদিকদের উঁচিয়ে ধরা বুমের সামনে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল। ও সি বাঁশদ্রোণী স্মার্ট হাঁটাচলার আড়ালে নিজের উদ্বেগ গোপন করছিলেন,কারণ গোপনে থানা থেকে নিরাপদ সর্দারকে সরিয়ে দিতে গেলে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হবে এই আশঙ্কা করছিলেন তিনি। উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা পুলিশকর্তারা বাঁশদ্রোণী থানায় পৌঁছে যাওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি পান ও সি বাঁশদ্রোণী। এ সময়ই পৌঁছে গেলেন সিপিআইএমের রাজ‍্য কমিটির সম্পাদক পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম।” থানার মধ‍্যে ঢুকবো না। তার কারণ,থানা চালাচ্ছে চোরেরা আর আটক থাকছে প্রতিবাদীরা। জমিচোর এবং জলাভূমির লুটেরা শুধু সন্দেশখালি নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে রাজত্ব করছে।সন্দেশখালির মহিলারা বলেছেন তাঁদের ইজ্জত লুঠ করেছে তৃণমূল। শুভেন্দু তৃণমূল কংগ্রেসে থাকার সময় শাজাহান কে নিয়ে বিডিওকে মারধর করেছিল। ” বললেন মহম্মদ সেলিম সইসাবুদ করিয়ে নিরাপদ সর্দারকে নিয়ে রওনা হওয়ার আগে দেখা গেল নিরাপদ সর্দার শ্লোগান তুললেন লড়াইয়ের। একই কথা বললেন তাঁর স্ত্রী দীপা “লড়াই চলবে। শাজাহান বিশু উত্তমরা অতিষ্ঠ করে তুলেছে আমাদের জীবন। আমরা চাই প্রতিকার। নিরাপদ সর্দার সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলেই আটক হলেন। ” বসিরহাটের দিকে গাড়ি রওনা হওয়ার পরেই সন্ধ্যায় সব থানায় বিক্ষোভ দেখানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।