২০১৩ সালের ২৩শে এপ্রিল সারদা চিটফান্ড কান্ডে সুদীপ্ত সেন এবং দেবযানী মুখোপাধ্যায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আজ দশ বছর ওনারা কারাবন্দী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্রুত প্রতিক্রিয়া ছিল, যা গেছে তা গেছে। একবছর SIT তদন্ত করল। বিরোধীরা স্পষ্ট অভিযোগ করেছে, অপরাধীকে ধরা দূর অস্ত, SIT প্রমাণের তথ্য লোপাট করছে। অবিলম্বে CBI তদন্ত চাই। মাননীয়া প্রমাদ গুণলেন। কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল, ডিভিশন বেঞ্চ ঘুরে ১১ কোটি সরকারী তহবিল উজার করেও সুপ্রীম কোর্টে থাপ্পর খেয়ে ফিরলেন। ২০১৪ সালের মে আসে শুরু হল CBI তদন্ত। গ্রাম বাংলার লাখ লাখ হত দরিদ্র নিঃস্ব মানুষ আশায় বুক বাঁধলেন। ধার্মিক দীন-দরদী প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। মনমোহন সিংহ ছিলেন নীরব, ইনি সরব মোদী। না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গাআআ- এত বড় হাঁ করলেন, যশোদা মা যেন মুখ গহ্বরে বিশ্ব ক্ষুধা দেখতে পেল। সুপ্রীম কোর্টে পরাজিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাল ছাড়েননি। ফুল, আম, দই, নয়া কুর্তা-পাজামা নিয়ে বানিয়া সফরে গেলেন। তারপর ৯টা বসন্ত কেটে গেছে। অনন্ত তদন্ত চলছে।

তদন্ত প্রক্রিয়া কি খুব দুর্ভেদ্য ছিল? রাজ্যসভার সাংসদ কুণাল ঘোষ স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন, সারদা চিটফান্ডের সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করার দাবী তুলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে চৌর্যযুগের খল-নায়করা বুকে প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে ঘুরছেন- “আমরা সবাই চোর।” অভিযুক্তরা বলছেন, সমস্ত নথি বাজেয়াপ্ত করেছে SIT, এবং মূল অপরাধীদের আড়াল করতে লোপাট হচ্ছে। CBI বিধাননগর কমিশনারেটের সেই মাথাগুলোকে চিনত। সাপের গর্তের সামনে দাঁড়ালেই কালনাগিনী ফোঁস করে ধর্মতলায় ধর্নায় বসেছেন। এমনকি CBI-র গোয়েন্দাদের রাজ্য পুলিশকে দিয়ে গ্রেপ্তার করাবার ভয় দেখিয়েছেন। CBI কয়েক বছর মদন মিত্রের প্যানিক অ্যাটাকের পেছনে দৌঁড়াল। পরে শোনা গেল, উডবার্নে ওনার হাঁটুতে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এখনও CBI মদন মিত্রের হাঁটুতে হার্ট খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিন্দু থেকে সিন্ধু হলে হাঁটুতে হার্ট হবে না কেন? সৃঞ্জয় বসু কয়েকদিন ভ্রমণ সেরে ফিরলেন। অথচ ব্যবসায়ীদের কালাধন সাদা করতে নোটবন্দীর ম্যাজিকে নরেন্দ্র মোদী তৎপর। এমনকি তালি-থালি বাজিয়ে তিনি করোনা তাড়িয়ে দিতেও পারঙ্গম।

তাহলে মানেটা কী দাঁড়াল? নরেন্দ্র মোদী ১০০% ব্যর্থ। জয়প্রকাশ মজুমদার বিজেপির দপ্তর থেকে নারদার ঘুষখোর তৃণমূলীদের ছবি দেখালেন। সেই জয়প্রকাশ পশ্চাৎদেশে লাথি খেয়ে তৃণমূলে। যে কুণাল ঘোষকে রাজ্যের SIT গ্রেপ্তার করেছিল, তিনিও তৃণমূলের মুখপত্র। সারদার টাকায় তাঁর প্রিয় অনুষ্ঠান ছিল চ্যানেল-টেনে “এক ফোনে এক লাখ।” তাঁরা জেনে গেছেন, কটা ফোনে সব সেটিং হয়ে যায়, ফলে নরেন্দ্র মোদী বা CBIকে সারদা বা নারদ কান্ডে ভয় পাবার কোন কারণ নেই। রোজভ্যালিতে সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ভুবনেশ্বরের হাসপাতালে শুয়ে কালো চুল সাদা করে ফিরলেন, তাপস পাল গান স্যালুট নিয়ে চলে গেলেন। নারদার ১৩জনের সুলতান আহমেদ আর সুব্রত মুখোপাধ্যায় বিচারের সীমানা পেরিয়ে প্যাভিলিয়ানে। লোকে বলছে, নরেন্দ্র মোদী বাঁচলে বাকি ১১জন এই পথে চলে যাবেন, কিন্তু লালসাকৃষ্ণ আদবানির এথিক্স কমিটির মিটিং বসবে না। যে দলটার এথিক্স নেই, সেই দলের এথিক্স কমিটি বলে কিছু হতে পারে? লেনদেন সারদা-নারদে নয়, দুর্বৃত্তের দুর্নীতির পরিধি অনেক বড়।

আপনি এসব প্রশ্ন করতেই ভয় পাবেন, কারণ তখনই জানবেন হিন্দুত্ব খতরা মে। আমাদের দেশে মুসলমান রাষ্ট্রপতি ছিলেন, শিখ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন হিন্দুদের বিপদ হয়নি। আসলে কোন জাতির মানুষ চেয়ারে বসেছেন সেটা মুখ্য নয়, তিনি বসার যোগ্য কিনা সেটা বিচার্য। কেউ আব্দুল কালাম আজাদ বা মনমোহন সিংএর কোট নিয়ে কথা বলতেন না, কারণ তাঁদের বক্তব্য নিয়ে ভাবার অবসর ছিল। এখন মানুষ নরেন্দ্র মোদীর নিত্য নাটক নিয়ে কথা বলেন। কারণ এনটায়ার পলিটিকাল সায়েন্স নিয়ে মানুষের কোন আগ্রহ নেই। আপনার নিরাপত্তা বাহিনীর বিনিদ্র রাত্রিতে জীবন উপভোগ করছেন, কখনও চিতার পেছনে ছুটছেন, কখনও হিমালয়ে ফটোগ্রাফার নিয়ে ধ্যান করছেন। আর যে অভিযুক্তরা বিনা বিচারে দশ বছর কারান্তরালে জীবনের দশটা বছর কাটিয়ে দিলেন, তাদের বেলা? অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তি পাক, কিন্তু প্রমাণের কোন চেষ্টাই তো হল না। এই লোকটা ধর্মের কথা বলেন, রাম-মন্দির নির্মাণ করেন, বারাণসীতে গঙ্গারতি করেন। সনাতন ধর্মবোধ ও দুর্বৃত্তের ধর্ম কৌশল এক নয়।

শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত অবশ্যই ভারতীয় প্রেক্ষিতে ব্যতিক্রমী। মাননীয় বিচাপরতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ বসু, রাজাশেখর মান্হা মহাশয়রা নিপীড়িত জনগনের পূজ্য। ভারতবাসী দেখেছে রামমন্দির বিচারের রায়ের বিনিময়ে কীভাবে প্রাক্তন বিচারক সাংসদ হয়ে পুরষ্কার পান। কলকাতা হাইকোর্টে প্রতিদিন CBI/ED তদন্তে শ্লথ গতির জন্য ভর্ৎসিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্হার ব্যর্থতা প্রশাসনিক প্রধানের ব্যর্থতা। কোন দিন নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমা চাইতে শুনেছেন। তিনি তদন্তকারী সংস্হাগুলোকে প্রশংসা করছেন। তাহলে ৯ বছরে সারদা কান্ডে, ৭ বছরে নারদের তদন্ত শেষ হল না কেন? এই প্রশ্নটা কোন সাংবাদিক করতে পারবেন না, দ্বিতীয়তঃ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবার সাহস নরেন্দ্র মোদীর নেই। কয়লা, গরু পাচারের মামলাও শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপে শ্লথ হয়ে যায়। ব্রাক্ষ্মণ ধর্ষককে রেহাই দেওয়া যত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেই তুলনায় কর্মচারীদের মহার্ঘ বেতনের মামলায় তারিখ পে তারিখ। অথচ সারদা চিটফান্ডের মামলা সুপ্রীমকোর্টের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে ও কয়েক যুগ ধরে চলবে।

সারদা চিটফান্ড তদন্তের চেয়ে বেশী প্রয়োজন তদন্ত হল না কেন সেই চক্রান্তের তদন্ত করা। ২০২১এ বিজেপি কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্বাচনী প্রচার করেছিল। রোজ দিল্লী থেকে বিমান নামত, আর দরজা ফুঁড়ে হাত জোড় করে পুতুল বেরিয়ে আসত। মিডিয়া কোটি কোটি টাকার প্রচার করে বুঝেছিল, বঙ্গদেশে মোদীর ইমেজে ভোটের বৈতরণী পার করা যাবে না। সেটিং-তত্ত্ব বঙ্গবাসীর হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে গেছে। তখন খুঁজে পেতে চটজলদি একটা জলঢোঁড়াকে বাংলার মুখ করে তোলার প্রচেষ্টা। সেই জলঢোঁড়ার মুখেও সারদার ছাপ তা খেয়াল করেননি। ফলে গুটিয়ে গেছেন। ভারতবাসী মূলতঃ বঙালীরা মীরজাফরকে খুব ঘৃণা করে। ইদানিং শুভেন্দু অমিত শাহের সাথে মমতার গোপন সখ্যতার অভিযোগ আনতেই মুখ্যমন্ত্রীকে নবান্ন থেকে সাংবাদি সম্মেলন করতে হল। তার কার‍ণ, এই নয় যে অমিত শাহ বিজেপি করেন, মূল কারণ ওরা ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতক। বাঙালী বিশ্বাসঘাতকদের স্হান দেবে না। সে কথা নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীও জানেন। তাই তৃণমূলের পাশে থেকে যতটা সম্ভব ফায়দা আদায় করা।

২০১৪ সালে একাংশ বলেছিলেন, মোদী-মমতা সেটিংএ সারদা চিটফান্ডের তদন্ত শেষ হবে না। যত দিন গেছে, ততই এই সন্দেহকারীদের সংখ্যা বেড়েছে এবং আজ প্রমাণিত সত্য। নরেন্দ্র মোদী ব্যর্থ, পরাজিত, মুখে চূণকালি লাগানো প্রধানমন্ত্রী। যিনি দেশের ভিতর সাহস করে তদন্ত করতে পারেন না, তিনি বৈদিশিক আক্রমণ থেকেও দেশবাসীকে বাঁচাতে পারবেন না। ফলে জলপাই রঙের উর্দি চাপিয়ে নরেন্দ্র মোদী বা রাজনাথ সিং কী বলেন, তা নিয়ে জনগন চিন্তিত নন। মানুষের এথিক্স থাকলে তিনি যে দলে থাকবেন, তার এথিক্স থাকবে বা দলনেতার এথিক্স না থাকলে দলেও এথিক্স থাকবে না। এথিক্সহারা বৃদ্ধ লালাসাকৃষ্ণ আদবানি আসলে নরেন্দ্র মোদীর কঙ্কাল। সুদীপ্ত সেন অপরাধী। বাঁচার তাগিদে রাজ্য সরকার কারাগারে বসে ওনাকে যা করতে বলছে, তাই করতে বাধ্য হচ্ছেন। বরঞ্চ দেবযানী মুখার্জীর মা এই চাপের প্রতিবাদ করেছেন। আপনি ধার্মিক মুখোশ পরে মানুষের প্রতি দিন পল হত্যা করছেন, অথচ জনগনের সামনে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারছেন না।

রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ করার সময়ে বিচার ব্যবস্হা তৎপর। মাননীয় বিচাপরতিরা আক্রান্ত হলে রাজ্য পুলিশ দুর্বৃত্তদের খুঁজে পায় না, অথচ অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেপ্তার করতে উৎসাহী। ইংরাজ আমলের শাসনের সাথে ফারাক কোথায়? সাভারকরের বুলবুল কি রাণীর শাসন মাহাত্ম কীর্তন করত? আর অনেক কথার প্রয়োজন নেই। নরেন্দ্র মোদীকে বলতে হবে, কত দিনে সারদা চিটফান্ড তদন্ত শেষ হবে। তা পঞ্চাশ বছর হতে পারে, আরো দশ বছর কিংবা পাঁচ বছর। সেই দিনের পর নরেন্দ্র মোদীকে নত মস্তকে বেরিয়ে যেতে হবে। নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণা শুনে জনগন সিদ্ধান্ত নিক, এমন মানুষের হাতে দেশের জনগনের নিরাপত্তা আদৌ আছে কিনা। রাম-রাবণ-হনুমান অনেক হয়েছে, এবার মানুষের কথা বলুন। যিনি ঘুষ দিয়েছেন, তিনি অপরাধী বটেই, তবে ঘুষখোর আরো বড় অপরাধী। তাই পার্থ-মাণিক কারাগারে, ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া প্রতাকরা কর্মচ্যুত। সারদা চিটফান্ড মামলায় নরেন্দ্র মোদীকে পার্থ মাণিক সুবীরেশ কল্যাণময়ের চেয়ে আলাদা করে কিছু দেখতে চাই না। নিকৃষ্ট সেটিং পর্ব নিপাত যাক।

মানুষ সারদা চিটফান্ড, নারদ তদন্ত যেমন দেখেছে, তেমনই নিয়োগ দুর্নীতিতে কলকাতা হাইকোর্টের মানবদরদী বিচারকদের ইতিবাচক দ্রুত পদক্ষেপ দেখেছে। কালো মোদীর পাশে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মোদীকে কৃষ্ণতর বংশীধারী করেছে। মাননীয় বিচারপতিদের রায়ে বরখাস্ত অর্থের বিনিময়ে চাকরি প্রাপকরা চাইছে শীর্ষ আদালতে বিচার হোক। মোদীর ঘেরাটোপে থাকলে বিচার ব্যবস্হা শ্লথ ও নিয়ন্ত্রণাধীন হবার সুযোগ থাকে। এই ভাবমূর্তি সৃষ্টি করতে নরেন্দ্র মোদীকে ৯ বছরের ব্যর্থতার ইমারাত বানাতে হয়েছে। অপরাধী শাস্তি পাক, কিন্তু মূল কুচক্রীদের আড়াল করতে কিছু মানুষের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা সংবিধান বিরোধিতা। সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়রা শাস্তি পেয়েছেন, বাকি থাকলে বাকিটাও ভোগ করুন। কিন্তু ডেলো পাহাড়ে যাকে প্রধানমন্ত্রী করতে এই জাল রচনা করেছিলেন, তাঁদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যেন রাজনৈতিক ফায়দায় কদর্য ব্যবহার না করেন। নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি নিয়ে আমরা আদপেই চিন্তিত নই, দেশের বিচারব্যবস্হার ভাবমূর্তি যেন চিরকাল অমলিন থাকে।