ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব আমরা সবাই বুঝি। এর জন্য দরকার  সর্বজনীন শিক্ষা ও শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ। শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থে সর্বজনীন ও গণতান্ত্রিক করে তুলতে হলে তার কাঠামো ও  বিষয়বস্তু উভয় দিকেই নজর দেওয়া দরকার। কেবলমাত্র শিক্ষার অধিকার সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াই এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। ভারতের প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম আবশ্যিক শর্ত ধর্মনিরপেক্ষতা। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের প্রাকশর্ত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা। রাষ্ট্র ও শিক্ষার ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝায়  এই দুইই ধর্ম থেকে বিযুক্ত হবে। কিন্তু চরম উদ্বেগের বিষয় যে, RSS-এর মতাদর্শপুষ্ট সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতাসীন থাকা হেতু সেই দিকটির ওপর চরম আঘাত নেমে আসছে।        সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্রাথমিক লক্ষ্য সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস পদ্ধতির প্রসার। এই কারণেই সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রশাসনিক ক্ষমতা পেলে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করতে চায়, তার ওপর আক্রমণ হানতে চায়। কারণ ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ ও বিশ্বাসের মূল ভিত্তি। পাশাপাশি আর একটি কাজ তারা করে—পাঠক্রমের সাম্প্রদায়িকীকরণ। যাতে ভবিষ্যতের নাগরিকরা উর্বর সাম্প্রদায়িক মনোভূমি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। একাজ তারা করে প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সরকারি পাঠক্রমের ঢালাও পরিবর্তন সাধন করে এবং নিজস্ব  সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক (যেমন RSS-এর নেটওয়ার্ক )ব্যবহার করে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য RSS পরিচালিত এ রকম অসংখ্য স্কুলের কথা যেগুলি সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে এবং শিশুমনকে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন করে তোলার কাজে সতত ক্রিয়াশীল রয়েছে।        স্বাধীন ভারতে শিক্ষার সংস্কার কর্মসূচি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। আসলে ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি ঘটলেও মানসিক মুক্তি এখনো সবক্ষেত্রে ঘটেনি। বিশেষ করে নীতি প্রনয়ণকারী ও রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানকারীদের মধ্যে এই মুক্তিসাধন সেভাবে ঘটেনি। তাই আয়োজনের ত্রুটি না থাকলেও প্রয়োজন মেটেনি। সকলের কাছে শিক্ষাকে এখনো পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই অসম্ভবপরতা আরো জাঁকিয়ে বসেছে বিশ্বায়ন ও উদারবাদী অর্থ ব্যবস্থার কল্যাণে। কারণ ওই ব্যবস্থায় সমাজকল্যাণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন কথাগুলির কোনো মূল্য নেই। এক এবং একমাত্র মূল্যবান কথা মুনাফা ও বাজার। বাজার সর্বস্ব ব্যবস্থায় শিক্ষাও বাজারের একটি মহার্ঘ পণ্য। সর্বসাধারণের সেথায় প্রবেশ নিষেধ। ফলে গণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজটি আজ দুটি নির্দিষ্ট দিক থেকে আক্রান্ত—সাম্প্রদায়িকতা ও নয়া উদারবাদী অর্থনীতি।        সাম্প্রতিক কালে নয়া উদারবাদী নীতির মধ্যে কোভিড পরিস্থিতিতে  শিক্ষার সুযোগ আরো সঙ্কুচিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে সাক্ষরতা ও বিকল্প পাঠশালার গুরুত্ব। মনে রাখতে হবে নিরক্ষরতার শ্রেণিভিত্তি আছে। যে সমাজে শিক্ষা মহার্ঘ পণ্য সে সমাজে নিরক্ষরতা থাকবে। দরিদ্র, নিরন্ন মানুষের মধ্যেই নিরক্ষরতার বাস। তাই নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রেণিশোষণের  মর্মবস্তু উপলব্ধি করা এবং শ্রেণিচেতনায় দিশাপ্রাপ্ত হওয়া খুবই প্রয়োজন। সাক্ষরতা আন্দোলন কেবলমাত্র অক্ষরকেন্দ্রিক আন্দোলন নয়। অর্থাৎ অক্ষর ও সংখ্যা চেনার মধ্যেই সাক্ষরতার কাজ সীমাবদ্ধ রাখার কাজ নয়। এক্ষেত্রে সমাজ চেতনা ও জীবনের বর্ণপরিচয়ের মাধ্যমেই অক্ষর ও সংখ্যা চেতনা গড়ে তুলতে হবে। বর্ণপরিচয় থেকেই ঘটবে বিশ্বপরিচয়।       বর্তমান সময়ে বহুমাত্রিক সাক্ষরতার কাজে  যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যচেতনা, বাল্যবিবাহ-বধূনির্যাতন-নারী নির্যাতনের মতো সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধে জনচেতনা ও স্বনির্ভরতা-স্বয়ম্ভরতার চেতনা প্রসারের কাজগুলি। এককথায় সাক্ষরতা আন্দোলন হল শ্রেণিচেতনা ও সমাজচেতনা ভিত্তিক আন্দোলন। ব্যাপক মানুষের গণ ঐক্যে নির্মিত আন্দোলন। যার সাথে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তথা জাত-পাতের রাজনীতির বৈরী সম্পর্ক রয়েছে। এগুলি মানুষের শ্রেণিচেতনা ও সমাজবদ্ধতার মনোভাবকে ধ্বংস করে। জাত-বর্ণ-ধর্ম-সম্প্রদায়-ভাষার ভিত্তিতে মানুষকে ভেঙে ফেলে। মানুষকে ছোটো ছোটো গন্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলে। বিপরীতে সাক্ষরতা আন্দোলন হল জীবন চেনার আন্দোলন—জীবনে জীবন মেলাবার আন্দোলন।          ‘সাক্ষর মানুষ জানবে অতীত, চিনবে বর্তমান, গড়বে ভবিষ্যৎ’। মানুষের তৈরি এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে আমাদের পূর্বসূরিদের ঘাম, রক্ত, অশ্রু আর মেহনতে। ঘটেছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতির বিকাশ। ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে এই সভ্যতা আগামী ভবিষ্যতে আরো অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে। এগিয়ে যাবে মানুষের মিলিত শ্রমশক্তির মধ্য দিয়ে। কিন্তু ইতিহাসের এ অগ্রগতিও থমকে দাঁড়াবে—থমকে দাঁড়ায় যখন ধর্মের নামে, ভাষার নামে, জাতপাতের নামে , বর্ণ ও সম্প্রদায়ের নামে ভেঙে ফেলা হয়  মানুষকে, মানুষের মিলিত শ্রমশক্তিকে।মানুষের শ্রমশক্তিতেই বহমান থাকে উৎপাদন প্রক্রিয়া। শ্রমশক্তির বিভাজন উৎপাদনের অধোগতিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।                    আমরা জানি, ধর্ম ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা সমাজকেন্দ্রিক। সমাজের অভ্যন্তরে বিষ ছড়ায়। সংহতি ও সম্প্রীতির আদর্শে বলীয়ান হয়ে রণে সামিল হতে হবে প্রতিটি সম্প্রীতিকামী মানুষকে। সংহতি রক্ষার রণাঙ্গনেই হবে অগ্নিপরীক্ষা।
  ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো   এ অভাগা দেশে    জ্ঞানের আলোক আনো’