আমাদের বাড়ির পূবের পাড়াটার নাম দিঘিপাড়া। ভূইমালিদের পাড়া। উত্তরে কয়েকশ’ বিঘে খেত জমি, তার মধ্যে কয়েকটা পুকুর, তার চৌহদ্দি পার হলে বড়পাড়া। উঁরাও আদিবাসীদের গ্রাম। পশ্চিমে বোষ্টমকুড়ি, মুসলমাদের গ্রাম মূলত।

দু’একজন ছাড়া সবাই তখন ছিল হতদরিদ্র।

আজ থেকে ৬৫/৬৬ বৎসর আগে যখন আমার ৭/৮ বছর বয়স, তখন থেকে  আরও এক দশকেরও বেশি সময় জুড়ে ঐ গ্রামগুলির অভাব আর অন্নকষ্ট দেখেছি। পরে জেনেছি সারা রাজ্যেরই ছিল একই রকম দুর্দশা।

তখন হতো একটামাত্র ফসল। হেমত ধান। তা উঠবার পরে একটু পেটভরা খাওয়া জুটতো। ২/৩ মাস পর থেকেই হাঁই হাঁই ক্ষিধে।

পুকুরে জংলি শাপলা লতায় বড় বড় ফুলের মাঝে, কালচে শ্যাওলা রংয়ের ফল। ঢ্যাপ। তা কেটে শাঁসালো থকথকে বীজগুলো বা সেটা কেটে বীজ শুকিয়ে ভেজে খৈ বের করে খেতো। পুকুরে হতো সিঙর আর কেশুর গাছ। সিঙর ফল আর কেশুরের শিকড়ের ছোট ছোট কন্দ,  তালের মরসুমে পাকা তাল কুড়িয়ে আঁশ তুলে রান্না না করেই খেতে থাকতো। পুকুরের ঝিনুক, গুগলি বা টাকোয়া ডুব দিয়ে উঠিয়ে তার থেকে মাংসল অংশটা বের করে একটু সাঁতলিয়ে খেতো মানুষ।

কচু, বুনো ওল- তার চকরা বকরা ডাঁটা কেটে কোন রকমে সেদ্ধ করে খেত। আরও কত কী ! যেমন তেলাকুচার পাতা, সজনে পাতা-এই সব। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মহিলারা কুটুম বাড়িতে যেতে অবধারিতভাবে ‘সাজন’এর মধ্যে নিতো ঐ ওলের ডাঁটা।

ধানের গাছ হতো তখন বড় বড় লম্বা। শালি ধান। অনেক রকম নাম সেসবের। গাছ লম্বা হয়েছে। ধানের শিষে দুধ এসেছে। আর জমিতে ছোট ছোট কৈ, ল্যাটা, শোলের বাচ্চা, পুঁটি, ড্যাঁড়কা, পাঁচচোখা এসব মাছ ঘুরে বেড়াতো। তাদের নানা কায়দায় ধরা হতো। খাওয়া হতো।

অনাহার অর্ধাহার গরিব মানুষের নিত্য দিনের সঙ্গী। এরকম ভাবে দিন গুজরান করতে গিয়ে আর মাথা গোঁজার একধরনের অস্বাস্থ্যকর ঘরে থাকতে থাকতে জ্বরজারি, পেটের অসুখ, ম্যালেরিয়া, পাঁচড়া, দাদ, কালাজ্বর হতো নিত্য সঙ্গী। পুরুষ মেয়ে শিশু অল্পবয়সেই কতজন মারা যেত তার ইয়ত্তা নেই। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মা বা সন্তানটি মারা যেতো হরহামেসাই।

এসব নিত্যদিনের ব্যাপার। তার মধ্যে খরা বা বন্যা হলে তো কথাই নেই!

আমরা সেদিনগুলোর একটু আভাস দিলাম। এসব নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায়।

বুনিয়াদপুরে আমাদের ৮৫ বৎসর বয়েসী নেতা অশোক আতলুকদারে সঙ্গে দেখা হলো কয়েকদিন আগে। তিনিই কথাটা তুললেন -আমাদের বাংলার এবং সারাদেশের অনেকগুলো রাজ্যে যে অবস্থা, তাতে খরা অবধারিত।

অশোকদা বলতে থাকলেন, খরা হতেই পারে। সরকার যদি এগিয়ে আসে সব কষ্ট না মিটলেও, একটু সুরাহা হয় মানুষের। কিন্তু কেন্দ্র বলো, রাজ্য বলো – যে চণ্ড সরকার, তারা কী আর এগিয়ে আসবে!। এর আগে সতেরো সালের বানের সময় তো দেখলাম!

একটা পুরোনো গল্প বলি শোন, বলে তিনি আবার কথা আরম্ভ করলেন। ১৯৫৭ সালে আমাদের পরিবার রেওয়াজ বদল মানে এক্সচেঞ্জ করে হিলি থাকার ডাঙাপাড়া গ্রামে এসেছি। এপারে পেয়েছি ১২০ বিঘা জমি। কিন্তু প্রচণ্ড খরায় সেবার মোট জমি থেকে ধান উঠল মাত্র ৫৯ মন। কী কষ্ট !

আমি তখন সদ্য যুবক।  মাঝে মাঝে ত্রিমোহিণী গঞ্জে যাই।

একদিন সুবেশ নধর সুন্দর গ্রামীন জোতদার ও ডক্তারাবাবু এবং কংগ্রেসী ভদ্রলোক এক সঙ্গীর সঙ্গে গল্পগাছা করছিলেন। সে সময়, মলিন লুঙ্গি ও গেঞ্জি পড়া একজন মানুষ, দেখে বোঝা গেল মুসলমান সম্প্রদায়ের, তিনি এসে বললেন – ডাক্তার বাবু, আমি দুদিন ধরে কিছু খাই নি। আমাকে কটা পয়সা দাও।

ডাক্তারবাবুর সঙ্গী খ্যাক খ্যাক করে হেসে বললো – আপনি তো ডাক্তারবাবু, পরীক্ষা করে দেখেন তো দুদিন ধরে এ না খেয়ে আছে কি না !

ডাক্তারবাবু সেই অভূক্ত মানুষটাকে জ্ঞান দিতে শুরু করলেন – তোমার যা অবস্থা, তার থেকে উদ্ধার পাবার জন্য আল্লাহকে ডাক, হিন্দুরা ভগবানকে ডাকুক।

অশোকদা লোকটাকে ডেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে দুটো পয়সা দিয়ে ভাবতে ভাবতে বাড়ি এলেন – এরা কী মানুষ!

দল হিসাবে কংগ্রেস তখন রাজত্ব চালায়।  হ্যাঁ, তারা এমনই নিষ্ঠুর অমানুষ ছিল।

না হলে ১৯৫৯ সালের ৩১শে আগস্ট ঐ ঘটনা ঘটে!

সে বছরের আগের কয়েক বছর থেকেই তো খাদ্য সংকট চরম। ১৯৫৮ সালেও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ আন্দোলন করেছেন। দু’টি ঘটনার কথা লিখি। আদিবাসী নারী বাহিনী টেষ্ট রিলিফের গম ভর্তি গোরুর গাড়ি আটকে, তা গ্রামের মানুষের মধ্যে বিলি করার উদ্যোগ নিতেই, পাশের বর্ডার আউট পোস্ট থেকে পুলিশ এসে গুলি করে এখনকার উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের মুদাফত কৈপুকুরের রাঁধুনি হেম্রমকে হত্যা করে। ইনিই খাদ্য আন্দোলনের প্রথম শহীদ। আর কালিয়াগঞ্জ শহরে ট্রেনের বগি ভেঙে মূলত নারী বাহিনী চাল বের করে ফেলেন। কয়েকটা গ্রামের গরিব মানুষের কয়েকদিনের অন্ন সংস্থান হয় তাতে।   

খাদ্যসংকট ১৯৫৯ সালে চরমতম হয়ে উঠলো। মজুদদার-কালোবাজারী,পাইকার, আড়তদারদের রমরমা। চাল, গম, উধাও করে দিলো তারা। রাজ্যে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হলো। খাদ্যের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলেন, শহর গ্রামের মেহনতি মানুষ।

‘মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’ ৩রা ফেব্রুয়ারি থেকে পর্বে পর্বে বিভিন্ন ধারার আন্দোলন করেও যখন বধির সরকারের ঘুম ভাঙাতে পারলো না, তখন ৩১শে আগস্ট কলকাতায় শহীদ মিনার ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত ও মিছিলের ডাক দিলেন। দাবি খাদ্যমন্ত্রীর অপসারণ, সবার জন্য খাদ্য চাই, পুলিশী দমন পীড়ন চলবে না।

সরকার সদম্ভে ঘোষণা করলো, ৩১ আগস্ট কোনো মিছিল কলকাতায় ঢুকতে দেওয়া হবে না।

কে শোনে সে কথা ! মরিয়া ক্ষুধাতুর মানুষ বিভিন্ন ভাবে কলকাতায় পৌঁছে গেলেন। কলকাতার গণতান্ত্রিক মানুষ তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। মিছিলে সঙ্গ দিলেন।

আন্দাজ সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটের দিকে বারোজন শোভাযাত্রী পুলিশের বেষ্টনীর ফাঁক দিয়ে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসেন। এই সুযোগে পুলিশ কর্ডনের ভিতরে যেখানে সাংবাদিকরা ছিলেন, সেখান থেকে লাঠি উঁচিয়ে, অপেক্ষমান মানুষ যাঁরা আইন অমান্য করবেন – তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জনতাকে তারা হটিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো। ঐ বাহিনীর পেছনে জালের মুখোশ পড়া লাঠিধারি পুলিশ বাহিনী প্রবলভাবে লাঠি চালাতে চালাতে এগিয়ে যেতে থাকলো। এ যেন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড। কত মানুষ যে শহীদ হলেন ও হলেন নিঁখোজ, তা ঐ রাত্রীই শুধু জানে !

এতো হিংস্রতা কেন ? শ্রেণী স্বার্থ মূল কারণ। এবং তা থেকে উৎপন্ন শ্রেণী ঘৃণা। আবার সেই শ্রেণী ঘৃণা থেকে উৎপন্ন উৎকট হিংস্রতা, অমানবিকতা।  

শান্তিপূর্ণ  সত্যাগহীদেরদের ওপর এই অমানুষিক আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ১লা সেপ্টেম্বর ছাত্ররা ধর্মঘট ডাকলেন। সেদিনও আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ ও গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করলো  সরকার।  ৩রা সেপ্টেম্বর হলো সাধারন ধর্মঘট।  ৮ই সেপ্টেম্বর ছাত্ররা কালোব্যাজ ধারন করলেন।  ১০ ই ও ১৩ই সেপ্টেম্বর মৌন মিছিল হলো। ২৬শে সেপ্টেম্বর সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে স্থায়ী শহীদবেদী নির্মিত হলো।

স্বাধীনতা পত্রিকার সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের ঝুঁকিপূর্ণ প্রচেষ্টায় এই মহান খাদ্য আন্দোলনের কতগুলি তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তা এরকম – মোট গ্রেপ্তার – ২১,০০০ জন, মোট আহত – ৩,০০০ জন, মোট নিহত – ৮০ জন, মোট নিখোঁজ – ১০০ জন।

ঐ কংগ্রেসী সরকারের আমলে শুধু ১৯৫০’এর দশকই নয়, ১৯৬০’এর দশকের প্রায় তিনভাগ জুড়ে ঐ একই রকম অবস্থা বিরাজ করেছে। ১৯৬৬’তে আবার খাদ্য আন্দোলন, তার সঙ্গে ছাত্রদের পড়ার কেরোসিনের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে নুরুল ইসলাম, আনন্দ হাইত প্রমুখ ১৮ জন সাথি শহীদ হয়েছেন। দুই দশক ব্যাপী এই আন্দোলন ও আত্মবলিদানের শীর্ষে স্থাপিত হয় ১৯৬৭’এর যুক্তফ্রন্ট সরকার। 

কৃষক আন্দোলনের চাপে কংগ্রেসী সরকার নামকে ওয়াস্তে ১৯৫৩ তে জমিদারি অধিগ্রহণ আইন আর ১৯৫৫ তে ভূমি সংস্কার আইন তৈরি করেই, তাদেরকে দেরাজ বন্দি করে রেখেছিল।

সেই অর্গল কবে খুলল ?  ১৯৬৭ ও ১৯৬৯’এর স্বল্পস্থায়ী দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে কছুটা, আর ১৯৭৭’এ বামফ্রন্ট সরকার হবার পরে অনেকটা।

গরিবদেরকে ভূমি উদ্ধারের আন্দোলনে সহযোগীতা করে, বর্গাদারদের জন্য লাগসই আইন তৈরি করে, পঞ্চায়েতের বাস্তুঘুঘুর বাসা ভেঙে দিয়ে জনতার পঞ্চায়েত তৈরি করে, কৃষির বিকাশে সহায়তা করে – মানুষকে মুখ্যমণি করে হাজারটা কাজের মধ্যবর্তিতায় গ্রাম বাংলার চেহারাই পালটে গিয়েছিল বাম সরকারের আমলে। এক ফসলি জমি ৩ ফসলি, কোথাও ৪ ফসলি হলো, জমির উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বাড়লো, খাদ্যশস্যে, সবজীতে দেশের মধ্যে সেরার শিরোপা পেল রাজ্য। সমস্ত সূচকেই এগিয়ে গেল বাংলা।

কিন্তু ধনীকদের তা সইবে কেন? এক পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদতে এই সরকার হটিয়ে দেবার চক্রান্তে তা হটে যেতে বাধ্য হলো। যে চক্রান্তের কিছু কিছু এখন জানা গিয়েছে। আগামী দিনে আরও জানা যাবে।

প্রায় এক দশক ধরে কেন্দ্রে এবং এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজ্যে এমন সরকার চলছে, যার দুর্গন্ধ চরাচরে ছড়িয়ে পরে রাজ্যের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আমরা এখানে কৃষক ও চাষ বাস নিয়ে যা হচ্ছে তার কিছু কথা বলবো।

কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট মানুষ খুব নিরাপত্তাহীন হয়ে গিয়েছেন। বীজ, সার, ডিজেল, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, এক কথায় বাড়ছে, চাষের খরচ। অন্যদিকে ফসল কেনার কেউ নেই। এই যেমন এখন খরার মধ্যে পাট জাঁক দিয়ে আঁশ বের করে তা শুকিয়ে বাজারে নিয়ে যাওয়াই বিরাট সমস্যা। লক্ষ লক্ষ আফাল পাট  শুকিয়ে গেল। যেটুকু উদ্ধার হলো, সেই এতো কষ্টের কৃষি সামগ্রী কে কিনবে ? জে সি আই দিল্লির। তারা হাত গুটিয়ে বসে আছে। রাজ্যের কোন হেল দোল নেই।  এরকম আলুর দামে রাজ্যের বিস্তৃত এলাকার চাষি মার খাচ্ছেন প্রতি বছর। ধানের দামে কী যে হয়, তা সবার জানা ! সরকারী সহায়ক মূল্য তো এমনিতেই কম। কিন্তু তৃণমূল পোষিত আড়ৎদার, ফড়িয়া, মিল মালিক, সমবায় সমিতি তার থেকেও অন্তত এক হাজার টাকা কম দামে ব্যাবাক ধান কিনে নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার তো এখনও মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস ( নূন্যতম সহায়ক মূল্য) ঘোষনাই করলো না। সরকারগুলো আসীন শুধু চুরি-ডাকাতি, খুন–সন্ত্রাস, সংখ্যালঘু ও দলিত নিধন, সাম্প্রদায়িকতা, ভেদাভেদবাদিতা, ভোট লুট, গণতন্ত্রকে বীভৎস পন্থায় ধ্বংস করার জন্য। 

বিপরীত দিকে জনতার আন্দোলন হচ্ছে জবরদস্ত। তার গতিবেগ, তেজ অনেক বাড়াতে হবে। এবার খাদ্য আন্দোলন সহ সকল শহিদদের স্মৃতি তর্পণের দিন এই ৩১শে আগস্ট আমাদের কাছে একটা বড় কর্তব্য নিয়ে হাজির হয়েছে, তা হলো আন্দোলনের বিপুল জল প্লাবনে দুরাচারী তৃণমূল ও বিজেপিকে সরকার থেকে হটিয়ে দিতে হবে।