‘ ৯০-এর দশকে বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় লুটের ক্ষেত্র অনেকটাই প্রসারিত হল। সমাজতান্ত্রিক বির্যয়ের ফলে কয়েকটা দেশে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শুধু প্রসারিতই হয়নি, বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে সমাজতন্ত্রের শক্তিশালী অস্তিত্ব বজায় থাকল না।ফলে পুঁজিবাদী লুটের কোন পরিমিতি থাকল না। চলতে থাকল গোগ্রাসে গলাধকরণ। কিন্তু একটি দশক পার হতেই অনিবার্যভাবে নেমে সর্বব্যাপী সংকট। সংকট ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে। প্রায় ১০০ বছর পর আবার এমন সংকট। আজও তা চলছে, সমাধানের কোন সম্ভাবনারও হদিস মেলেনি।


‘৮০ দশকে পুঁজির মুনাফা ছিলো সাধারণভাবে ২০ শতাংশ। বর্তমানে এই হার দাঁড়িয়েছে ৫০/৬০ শতাংশ। লুটের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের জীবন যাত্রায় মানের অবনতি অনিবার্য।গোগ্রাসে গলাধকরণের অর্থ মুনাফা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। ফলে এই পর্যায়টিকে ধান্দার ধনতন্ত্র নামেও চিহ্নিত করা হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়েই অস্বাভাবিক মুনাফা বৃদ্ধির পথ প্রস্তুত করে নিতে হয়েছে। প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ট্যাক্স রেহাই, শ্রমিক-কর্মীদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা বা বাড়তি পরিশ্রমে বাধ্য করা হয়। ব্যাঙ্কের জনগণের সঞ্চিত টাকা লোপাটে সহায়তাও করা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং পুঁজিপতিদের সাথে করে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লার বরাত বা ফ্রান্সে বিমানের বরাত পাইয়ে দেবার মত নির্লজ কার্যকলাপ চলছে। দেশের কর্তাব্যক্তিদের এহেন কার্যকলাপ বিচ্ছিন্ন বা আকষ্মিক নয়।
আমাদের রাজ্যের গন্ডায়-গন্ডায় নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক দূর্নীতির দায়ে নিয়মিত হাত জড়ো করে কাঠগোড়ায় দাঁড়াছে। ঘটনার তদন্ত নিয়ে আবার কেন্দ্র–রাজ্য কৌশলী তর্জায় ব্যস্ত। বহু রাজ্যেই এমন দূর্নীতির ঘটনা নিয়মিত বিষয়। কিন্তু পশ্চিমবাংলা এমন কলঙ্কে দেশের শীর্ষস্থান দখল করেছে।


প্রখ্যাত সাহিত্যক বুদ্ধদেব গুহ বলেছিলেন, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্য মিশ্রদের ” আপনি অসৎ বলতে পারবেন না। এরা কেউ বাড়ি,গাড়ি বা টাকার জন্য জন্য রাজনীতি করতে আসেনি। অন্য পেশায় অনেক সফল পারতেন। সব হাতছানি ছেড়ে এসেছেন। জ্যোতি বসু এদের নেতা। এদের দেখেই বোঝা যায় জ্যোতি বসু কেমন ছিলেন। ” সৎ মানুষের মধ্যমণিরা যেমন অসৎ হয়না, তেমনই অসৎদের ঘিরে যারা থাকে, তারা সৎ হতে পারে না। যারা প্রায়শ কাঠগড়ায় হাত জোড় করে দাঁড়ায়, তাদের পার্শ্বচররা কখনই সৎ হতে পারে না। শোষক শ্রেণির শীর্ষ কর্তারা যেমন নানা অপকর্মে অভিযুক্ত তাদের অনুগামীদের কাছে,অন্য আচরণ আশা করা যায় না। লুন্ঠনের প্রকল্প কার্যকর করতে নীচু স্তর পর্যন্ত বাহিনী সাজাতে হয়। এ বাহিনী নিশ্চই নিশ্পাপ দেবশিশু হবে না। তাদেরকে যুক্ত থাকতে হবে লুন্ঠন বৃত্তিতে। সর্বনিম্ন স্তরে গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য থেকে শুরু করে তাদের অনুগামীসহ সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত কোথাও লুটের ভাগ পৌঁছাতে হয়, কোথাওবা আশীর্বাদ ধন্য–লুট চালাবার লাইসেন্স প্রাপ্ত! বগটুইতে পঞ্চায়েত সদস্যদের সাথে অনুগামীদের শত্রুতামূলক সর্ম্পক তৈরি হয়, ভাগে একমত না হওয়ায়। আবার স্বার্থসিদ্ধির জন্য বা শত্রুতার কারণে মানুষ খুনের ঘটনা দেখতে আমরা অভ্যস্ত। গণ সংগ্রামের মোকাবিলায় গণহত্যার দৃষ্টান্তও কম নয়। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গাঁমায়ও গণহত্যা হয়ে থাকে।


কিন্তু লুন্ঠিত অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা করতে গিয়ে গণহত্যা হতে পারে, এমন ঘটনা এতাবৎকাল অজানা ছিল। সে অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতাও রাজ্যের মানুষ অর্জন করল। সন্তোষজনক লুটের ভাগ না মেলায় গণহত্যা হল বীরভূম জেলার বগটুই গ্রামে। প্রথমে পঞ্চায়েত সদস্য ভাদু শেখ খুন। সাথে সাথেই ভাদু শেখের অনুগামীদের দ্বারা গণহত্যার ঘরনাটি সংগঠিত হল ২১ শে মার্চ,২০২২ দিনটিতে। ভাগ নিয়ে বিবাদ- সংঘর্ষের ঘটনা এখানে সেখানে মাঝে মধ্যেই হয়ে থাকে। কিন্তু সর্বত্র মানুষের মধ্যে তা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতির পার্থক্য দেখা দিচ্ছে। বগটুইয়ের ঘটনার তিনমাস পর হতেই পঞ্চায়েত সদস্যসহ ক্যানিং থানার গোপালপুরে তিনজন খুন হন। বীরভূমের গণহত্যা যেমন পঞ্চায়েত সদস্য ভাদু শেখের খুনের প্রতিক্রিয়া, এখানেও তেমনটাই। কিছুদিন আগে গোপালপুর পঞ্চায়েতের কচুয়া বাগদী পাড়ায় খুন হয়েছে পঞ্চায়েত সদস্য বাদল নস্কর। তার অনুগামীরাই বর্তমান পঞ্চায়েত সদস্য স্বদস্য স্বপন মাঝির ৭ ই জুলাই খুনে অভিযুক্ত । দু’পক্ষ শক্তিধর নেতৃত্বের অনুগামী হিসাবে এলাকায় পরিচিত।
উভয় ঘটনায় কেন্দ্রবিন্দুই পঞ্চায়েতর কার্যকলাপ। মধু ভান্ডকে কেন্দ্র করেই মৌমাছিদের বিচরণ। বীরভূমে যেমন প্রবল পরাক্রান্ত নেতৃত্ব আছে মৌমাছিদের পেছনে, ক্যানিং এলাকাতে এমন প্রতাপশালী, রাজ্যজুড়ে প্রচারিত নাম না হলেও স্বকীয় ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট ক্ষমতাবান। ২০০৮ সালেই তারা পঞ্চায়েতের দখল নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে মধু বন্টনে বিবাদ শুরু হয়, গড়ায় সংঘর্ষ পর্যন্ত। শক্তি সমাবেশের গঠন-পুনগঠনও বিভিন্ন সময়ে হয়েছে মধুভান্ডারের খবরদারীকে কেন্দ্র করে। শাসকদল বিরোধী কারও পক্ষে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিষিদ্ধ। সারা রাজ্যেই এমন অবস্থা। জনগণের মতামত দেবার ক্ষমতা না থাকায়। পঞ্চায়েতের আসন দখল করে যথেচ্ছ লুট চলছে রাজ্যজুড়ে। বিরোধী শক্তিকে উৎখাত করার পর মধু ভান্ডের দখলদারী নিয়ে নিজেদের মধ্যেই রক্ত ঝড়ছে — তাজা প্রাণ। স্বায়ত্ব শাসন ব্যবস্থার অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে চালু করা হয়েছিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। এমনকি, কোন বিরোধী রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণও নিষিদ্ধ।


বর্তমানে ১৫ তম অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত বছরে ১ থেকে ১-১/২ কোটি টাকা পেয়ে থাকে। ঠিকাদারদের মাধ্যমেই এ অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। স্বভাববতাই ঠিকাদার এবং পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষের রফার ভিত্তিতেই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়। অতীতে কন্ট্র্যাক্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে পঞ্চায়েতের কাজ ছিলো যথেষ্ট সীমিত। কিন্তু বর্তমানে যথেষ্ট প্রসারিত। কন্ট্র্যাক্ট ব্যবস্থা এবং তার কাজ নিয়ে নানা বিরূপ সমালোচনা বা, বিদ্রুপ শোনা যেত। বর্তমানে তাদের থেকে অনেক বেশি অর্থ যায় কর্তা ব্যক্তিদের পকেটে। ফলে কাজের মান কি হতে পারে তা তা অতি সহজবোধ্য।


ক্রমহ্রাসমান হলেও আছে এম এন রেগার কাজ। প্রকল্পের নিয়ম রক্ষার জন্য, যাদের কাজ করার কথা, তাদের স্বাক্ষর করানো হয়। কিন্তু কাজ যেটুকু হয়, কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমেই সাধারণত হয়ে থাকে। এমনকি কাজ আদৌ না করেও টাকা বিলি প্রায় নিয়মে পরিণতি হচ্ছে। আদৌও কোন কাজ না করেও কিছু মানুষ প্রকল্পের টাকার ভাগ পাচ্ছে। বরাদ্দ অর্থের অধিকাংশ প্রবাহই অন্ধকার পথে।


গৃহ নির্মাণ বা বিভিন্ন ভাতার প্রাপকদের নাম স্থির করে পঞ্চায়েত। গৃহ নির্মাণের জন্য পায় প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার টাকা,। কিন্তু বাস্তবে প্রায় কারুর হাতে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্তও পৌছায় না। অধিকাংশ ভোক্তা অর্ধেকের কমই পেয়ে থাকে। তাছাড়া ডোবা খনন বা বাগান চাষের জন্য সহায়তা প্রকল্প আছে। পঞ্চায়েতগুলির মাধ্যমে কার্যকর হয়। প্রতি পঞ্চায়েত গৃহনির্মাণের জন্য বছরে অন্তত ৪০/৫০ সুযোগ পায়। তাছাড়াও আছে নানা ভাতার প্রাপক। সে নামও গ্রাম পঞ্চায়েত স্থির করে। বয়স ৬০ পার হলে পাবে বার্ধক্য ভাতা। সমস্ত অর্থের বিলি বন্টনের কাজ প্রায় একি ধারায় সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলে লুটের বহরটি যে নিতান্তই অবহেলার যোগ্য নয়, তা সহজেই বোঝা যায়। নির্বাচনের অনুপস্থিতে, মানুষের তদারকির অভাবে লুটের তৎপরতা চলছে। যতদিন যাচ্ছে, ভাগের অতৃপ্তির কারণে সংঘাত-সংঘর্ষ-খুন, যা এখন গণহত্যা পর্যন্ত প্রসারিত।


দেশের সর্বোচ্চ স্তরেরের আদানীদের মতো প্রজাতির সম্পদ বৃদ্ধি যেমন অভূতপূর্ব, তেমনই তার নীচের স্তরের যারা এ ব্যবস্থায় ম্যানেজারীতে নিযুক্ত, যারা এ ব্যবস্থার সৈন্য- সামন্তের কাজের দায়িত্বে নিযুক্ত, তাদের সকলের উপার্জনের স্ফীতি সামগ্রিক বৃহত্তর সংকটের জন্ম দিচ্ছে। সমূলে এ ব্যবস্থার উৎপাটনই সমস্যা সমাধানের পথ উন্মুক্ত করবে। নানা সংঘাতের মধ্য দিয়ে সে দিকেই এগোবে পৃথিবী -এগোবে আমাদের দেশ।