ভাবনা শিকারী

গৌতম কর

সখী, ভাবনা কাহারে বলে? সখী, যাতনা কাহারে বলে? ভাবনা বন্ধক রাখলে, যাতনায় সমাপ্তি। বাড়ি, জমি, কানের দুল বন্ধক হয়। ভাবনাও কি বন্ধক দেওয়া যায়? ভাবনা যদি বন্ধক না হবে, তাহলে ভাবনা শিকারীরা ব্যবসা করছে কেমন করে? মনে করুন, প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাক। একটা দল ৫০০কোটি খরচ করে নিযুক্ত করল, নিশ্চই দলটা বেজায় আহম্মক নয়। চোখের উপর এমন একটা প্যাক লাগিয়ে দেবে, যে বৃদ্ধাকে আপনার বাংলার মেয়ে মনে হবে। যে মানুষ ‘ছেলেমেয়ে’, ‘মেয়েছেলের’ ফারাক বোঝে, সেই মানুষ মেয়ে আর মহিলারও তফাৎ জানে। কিন্তু আপনার চোখের উপর পুলটিসের নগদ মূল্য ৫০০কোটি। আপনার স্বাধীন চিন্তা ভাবনা শিকারীদের খপ্পরে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে খবরের কাগজ থেকে সন্ধ্যায় টিভির মজলিশে জমিয়ে বসছে। করোনার ভাইরাসের চেয়ে দ্রুত সংক্রামণ। অটো চালক থেকে পানওয়ালা শেখানো বুলি কবচাচ্ছে আর ততই অজান্তে মিথ্যা হজম হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার হোর্ডিংএ দন্ত বিকশিত ছবি থেকে দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়নের ফিরিস্তি শিফলী ফুলের মত ঝরে পড়ছে।

শাসক দলের কর্মীদের মস্তিষ্কে নেত্রী ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, মানুষ চোর বললেও, বুক টান করে বলুন তৃণমূল করেন। কোন চোরের বুক টান করে কথা বলার কথা নয়। পিঠ টান দেওয়া উচিৎ। কিংবা মনে করুন, বুকে প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে দাবী- “আমরা সবাই চোর।” চোর তকমাটা ঐতিহ্যের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বেকার যুবক দেখে, নিজেকে চোর প্রমাণ না করলে ক্লাবের চুল্লুভাতার বখরা নেই। ভাসানের রাতে নেতার পয়সায় আকন্ঠ গিলে রাস্তায় লুম্পেন নাচের পাসপোর্ট নেই। কেবল অভাবে নয়, স্বভাবেও যারা চৌর্যবীর স্বীকৃতি পেয়েছে, দাঁত কেলিয়ে বলে, আমরা রাজনীতিতে নেই। কাউকে ভোট দিই না। ওদের বাপমায়ের উপর শ্রদ্ধা বাড়ে। অন্ততঃ ছোটবেলায় চোর শব্দটা যে সম্মানজনক নয়, এই টুকু শিক্ষার তলানি পড়ে আছে। হিটলার জার্মানদের ব্রেনওয়াশ করেছিলেন, ওরা প্রকৃত আর্য, বিশ্বের সেরা জাতি। পল জোসেফ গোয়েবেলসের থিয়োরী, একটা মিথ্যা শতবার বললে সত্যি হয়ে যায়। তিনি এক দেবতা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন- অ্যাডলফ হিটলার। লোকটা একজন অসৎ লোকের অন্ধ অনুসারী ছিলেন মাত্র।

অপমান, নির্লজ্জতার পঙ্কে নিমজ্জিত করার পর আক্রান্ত অকুতোভয়। পরিবার পরিজন সহ বিষপানের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তি দানব। ভাবনা-শিকারীরা মানুষকে দানব বা রোবট বানায়। বিরোধী দল যতই শিক্ষায় দুর্নীতি, বালি-কয়লা-গরু-পাথর পাচারকারী বলুক অবলীলায় টেলি-জলসায় কথা বলতে পারে। সে লজ্জায় অবধ্য অমর। বিরোধী পক্ষকে অবলীলায় আক্রমণ করতে পারে। মুশকিলে প্রতিবাদী উল্টো দিকে বসা ব্যক্তির। আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ে কাদা ছিটোলে কোন ফল হবে না, কিন্তু ভুলেও যদি সাদা জামা পরা কেউ বসেন এবং সামান্য সাময়িক অপরীক্ষিত অপ্রমাণিত কাদার ছিটে লেগে যায়, তা টেলি-পর্দায় স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং মিডিয়া জুম করে দেখাবে। ভাবনা শিকারীরা মানুষের ভাবনাকে ঘুরিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করবে, যাদের আগমার্কা দুর্নীতিগ্রস্ত লেবেল দিয়েছেন, তার সাথে অপর পক্ষের ফারাক নেই। এই খানেই আপনার ভাবনা শিকার হয়ে যাবে। তারজন্য মিডিয়া কিনবে, রাস্তা ঘাটে ছবির প্রদর্শনী হবে। রবিঠাকুরের জন্মদিন থেকে ফিল্ম ফেস্টিভাল বা মোহন বাগান- ছবি সেই একটা।

বিগত জামানার চিরকুটের গল্প ভাবনা শিকারীদের পাতা ফাঁদ। বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সেই সময়ের বিতারিত দুষ্কৃতিদের হাজির করিয়ে দেওয়া। ক্ষমতা এবং অর্থের লোভ এমন যে বাপের শ্রাদ্ধ করতেও কুলাঙ্গাররা পিছপা নন। ইতিহাসে ঔরঙ্গজীবের শাহজাহানকে বন্দী করার কথা বলি। তখন কেন প্রতিবাদ করেননি? এরা উত্তর দেন না, কেবল বিবৃতি দেন। বিভিন্ন ভুতের গল্প বা কুসংস্কার এই ভাবেই ছড়ায়। কামুক কবি যাকে ছেনাল বলেন, তিনি দলের নেত্রীকে চিটফান্ডের সব চেয়ে বড় সুবিধা ভোগী বলেছিলেন। এদের সমাজে কোন যোগ্যতা বা বৈধতা নেই। এরাই সমাজবাদের ধর্মগ্রন্হে কত টাকা অবধি গাড়ি চড়ার নিদান আছে সেই বিধান দেয়। জাঙ্কফুড বিক্রী হয় বেশী। যে মন্ত্রীর তদন্ত সংস্হার নাম শুনে হাঁটুতে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, সেই কাপুরুষের হুঙ্কার বিক্রী হয়। মানুষ মজা করে শোনে, ধীরে সে শিকার হয়ে যায়। সিগারেট নেশার মত। শখে শুরু, ক্যান্সারে শেষ। সত্তর বছরের বৃদ্ধ মন্ত্রীর তরুণী ভোগ সমাজে যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, পরিণাম বহু কিশোরীর ধর্ষণ, মৃত্যুর কারিগর।

দুর্নীতির থেকে চোখ সরাতে আপনাকে যৌন আনন্দ দেবে ভাবনা শিকারীরা। কখনও তা তা থৈ থৈ নেত্য করবে মন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভেঙে তিন খান হয়ে গেল, সেদিকে না তাকিয়ে আধা-নায়িকার তিনটে ফ্ল্যাট জুড়ে এক হল, সেই গল্পে মজে যাবেন। দুর্নীতির প্রচার, প্রশাসনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যবসার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করে। যে ব্যক্তি নিজে মেধার ভিত্তিতে সরকারী চাকরি পায়নি, সরকারী চাকুরে বন্ধুদের উপর হিংসা মেটাতে সন্তানকে চাকরি কিনে দেয়। শিক্ষামন্ত্রীর ব্যতিক্রমী চাকরির ভাবনাটাই নিরাপত্তা। মুখ্যমন্ত্রীর সহানুভুতি ব্যর্থ লোকটার লোলুপতা চরিতার্থ করবে। হিটলারের কোন আদালতে বিচার হয়নি, কিন্তু ইতিহাস তাঁকে সমুচিত স্হান দিয়েছে। ভাবনা শিকারীরা তিনশ বছর পর মন্দিরের স্বপ্ন বিক্রী করলেও মীরজাফরের পু্ত্র মীরণের সারিতেই থাকবেন। ভাবনা শিকারীদের সবচেয়ে বড় সুবিধা, যারা ভাবতেই পারে না, তাদের জন্য সহজ উপায়, দুয়ারে ভিক্ষা পৌঁছে দাও। আগে দুয়ারে ভিখারী এসে মা বলে ডাক দিত, এখন দুয়ারে ভাবনার শিকারী ভূত এসে মা-মাটি বলে ভিক্ষা দেয়।

যে কোন ঘটনাক্রমে মানুষের ধারণা বা উপলব্ধি সৃষ্টি হয়। আইন বা বিজ্ঞান স্বীকৃত না হলে বাস্তব বলে গ্রাহ্য হয় না। এই দায়িত্ব বিচার ব্যবস্হা, তদন্তকারী সংস্হা বা বৈজ্ঞানিক সংস্হাগুলোর। ধারণা বা উপলব্ধি যদি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে হয়, তবে পদ্ধতি বিলম্বিত হয় কিংবা আদৌ হয় না। চিটফান্ডের ১০বছর তদন্ত বা নারদ ঘুষের ৭বছরের তদন্ত। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকার, তাহলে বিচার হবে না কেন? মনে রাখবেন, নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল শত্রু বামপন্হীরা। সেই জোটে কংগ্রেস থাকলে তাৎক্ষণিক শত্রু। নরেন্দ্র মোদী যদি জানতেন, শাসকদল আদালতে চোর প্রমাণিত হলে বিজেপি ক্ষমতায় আসবে, তাহলে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হত। রাজধর্ম বা নৈতিকতার চেয়ে অগ্রাধিকারে ক্ষমতা। এমনকি নন্দীগ্রাম গণহত্যায় সিবিআই চার্জশিট দিলে রাজ্য সরকার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেনি। ভোট প্রচার কালে মমতা শুভেন্দুকে গণহত্যায় দায়ী বলেছিলেন। শুভেন্দু বা মমতা এই বিষয়ে বিবাদ বিতন্ডা বাড়াননি। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক যদি দুর্বৃত্ত হয়, ভোট বৈতরণীতে ভাবনা শিকারীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

Indian Political Action Committee বা প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাকের মূল উদ্দেশ্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করে রাজনীতিতে অবদান রাখা। জেল যাত্রা হবে না, কিন্তু রুটি মিলবে। ২০১৯এ অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র, ২০২০তে দিল্লী, তামিলনাডুর পর ২০২১এ বিশ্ববাংলার সাফল্যের কথা বলে। ডিরেক্টরদের ঋষিরাজ IIT, Kanpur, প্রতীক জৈন IIT, Mumbai, ভিনেশ ছান্ডেল NLIU, Bhopalএর মেধাবী ছাত্র। ওদের নির্দেশে রাস্তার রাজনৈতিক কর্মীরা লড়বে। মোটা মূল্যে বিক্রয় হবে মেধা। Rediffusion Dentsu Young & Rubicam Private Ltd. বা McCann Erickson India Pvt. Ltd.এর নাম শুনেছেন? এরা বাজারজাত পণ্যের বিজ্ঞাপনের অগ্রণী সংস্হা। প্রোডাক্টের গুণ নয়, ব্যবসা বিচার্য। আইপ্যাকও তেমনই রাজনৈতিক বাজারে জনগনের ভাবনা শিকারের কারিগর। যেসব রাজনৈতিক দল বিপুল খরচ সাপেক্ষ এই সংস্হাগুলোকে নিয়োগ করে, ক্ষমতায় ফিরে উশুল করবে বলাই বাহুল্য। এবার ভেবে দেখুন, যারা বোকা বানিয়ে আপনার ভোটটা হাতিয়ে নিল, তারা তার দামটাও আপনার পকেট কেটে হাসিল করবে।

যে পঞ্চায়েতে পাঁচ বছর রাস্তার হাল বেহাল, শাসক দল হঠাৎ বিডিও অফিস ঘেরাও করে ভোটের পূর্বে আন্দোলন শুরু করে দেবে। দায়সারা গোছের লোক দেখানো কিছু কাজ করলে জনগন শাসক দলের উপর ভরসা রেখে আবার ঠকবে। অনেক ক্ষেত্রে কোন পঞ্চায়েত প্রধান সময় মত হিস্যা না দেওয়ায় দল থেকে বহিষ্কারের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করবে। নেতা সেই গ্রামে সহসা পৌঁছে গ্রামবাসীর সাথে কথা বলবেন। খুব স্বাভাবিক ভাবে সব গ্রামের লোক ক্ষোভ উগরে দেয়। নেতা তৎক্ষণাৎ পঞ্চায়েত প্রধানকে ইস্তফা দিতে বলে প্রশাসনকে দায়সারা কিছু কাজ করে দিতে বলবেন। ড্রেসিং রুমের প্রস্তুতি আগের থেকেই হাজির। মিডিয়া করিৎকর্মা নেতার কার্যকারিতা ঘোষণা করলে, সব গ্রামে তার প্রভাব পড়বে ভোটে। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। কিংবা দলনেত্রী চায়ের দোকানে চা বানাতে বসে যাবেন। হেলিকপ্টার যাপন করা মহিলাকে মনে হবে গরুর গাড়ির বড্ড আপন। একই পচা শামুকে বারবার পা কাটছে জনগন। ওরা বারবার বোকা বানিয়ে মজা পাচ্ছে, আপনি প্রতিবার বোকা হয়ে আনন্দে আছেন।

বাংলা বাংলার মেয়েকে চায়-এর প্রতারণায় এবার নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে? বাংলার মেয়ের শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি, গরু-কয়লা-পাথর-বালি পাচার চেয়েছিলেন? আপনার সন্তানের জন্য অন্ধকারময় রাজ্য রেখে যেতে চান? অথচ ডিগ্রীধারী মেধাবীরা আপনাকে বোকা বানিয়ে আপনার বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান ভোটগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে। আপনি বাংলার মেয়ের ভোটার হয়ে আপনার ছোট্ট মেয়েকে বলতে পারছেন না, চুরি করা মহাপাপ। আপনি বাপ হয়ে সেই পাপ করে ফেলেছেন। আপনার পাপে আপনার পুত্র বেকার, ভাই ডিএ পাচ্ছে না, স্বাস্হ্যসাথী কার্ড নিয়ে হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরে মা মারা গেছেন। পাপীরা চিরকুটের গল্প বলে খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করবে। কুমীর আর মানুষ একই নদীতে একসাথে বাঁচতে পারে না। হয় আপনাকে কুম্ভীরাশ্রু মুছে কুমীর হত্যা করতে হবে, নয়ত মরতে হবে। আমি রাজনীতিতে নেই, ভুলেও বলবেন না, কারণ আইপ্যাক সরাসরি রাজনীতিতে না থেকে আপনাকে লুন্ঠন করছে। তাই প্রাত্যহিক রাজনীতিতে থেকেই বলতে হবে, চোরমুক্ত বাংলা চাই।