আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিআই(এম)-র অফিসে প্রথম টেলিভিশন সেট এসেছিল ২১মার্চ, ১৯৭৭!

পার্টি কেনেনি। এক ঘনিষ্ট দরদী দিয়েছিলেন।

এটা একটি ঘটনা। কেন ওই সময়ে — সেটিই বিচার্য।

কমরেড জ্যোতি বসুকে ওই ঘনিষ্ট দরদী বলেছিলেন,‘‘আকাশবানীর প্রচারের অভিযোগ করে প্রমোদবাবু খুব ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু টেলিভিশন যে ইন্দিরা-কংগ্রেসের হয়ে আরও নগ্ন প্রচার চালাচ্ছে সে সম্পর্কে প্রমোদবাবু অভিযোগ করলেন না কেন?’’ জ্যোতি বসু তাঁকে জানান,‘‘প্রমোদবাবু রেডিও-তে যা শুনেছেন তা থেকেই অভিযোগ করেছেন। তিনি তো টেলিভিশন দেখতে পান না।’’ সেই পার্টিদরদী তখন বলেন, ‘‘প্রমোদবাবুর টেলিভিশন নেই? তাঁকে বলবেন আজই আমি তাঁর কাছে একটি টেলিভিশন সেট পাঠিয়ে দিচ্ছি।’’

টেলিভিশন সেটটি আসে। সেদিনই। সিপিআই(এম)-র তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত সেই টেলিভিশন সেটটি পার্টির রাজ্য দপ্তরের হলঘরে রাখার ব্যবস্থা করেন। সবাই দেখতে পারবেন — তাই সেই সিদ্ধান্ত।

দরদীদের ভালোবাসার চিহ্ন বয়ে কমিউনিস্টরা এতটা পথ হেঁটেছে, এখনও এগোচ্ছে। সেখানে একটি টেলিভিশন সেট সংক্রান্ত এমন একটি বিবরণের কী গুরুত্ব? গুরুত্ব সাদা কালো যন্ত্রটির নয় — উত্তাল, উজ্বল সেই সময়কালের। এখন সোস্যাল মিডিয়া নবতম মাধ্যম হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। ৪৫ বছর আগে ছিল টেলিভিশন — দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যম। তখন বেসরকারি চ্যানেল আসেনি। টুইটার, ফেসবুক তো অনেক দূরের কথা। সরকারি সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের স্বার্থে নানা কৌশলে ব্যবহার করা ছিল স্বৈরতন্ত্রর প্রবণতা। আর কমিউনিস্টদের এর বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে।

কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত রেডিও-তে শাসক দলের পক্ষে নির্লজ্জ প্রচারের প্রতিবাদ করেছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে লাগাতার সংবাদপত্র, সংবাদমাধ্যমের বড় অংশ কুৎসা করেছে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে। প্রতিটি সভায় কমরেড জ্যোতি বসু সংবাদপত্রের অপপ্রচার সম্পর্কে সচেতন করেছেন, প্রায় নিয়ম করে। কিন্তু সরকার অথবা পার্টি, ফ্রন্ট কখনও সংবাদপত্র, সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক পথ নেয়নি।

আর এখন?

‘মুকুল ভ্যানিস’ — এমন একটি পোস্ট আর একজনকে পাঠানোর অভিযোগে এক অধ্যাপককে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ্যে সরকারের অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছেন— ‘‘কাগজের কপিতে দেখে নেবেন, পজিটিভ করছে না, নেগেটিভ করছে। পজিটিভ দেখলেই তাকে (সংবাদপত্র) বিজ্ঞাপন দেবেন।’’ অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে লিখলে প্রাপ্য হলেও বেসরকারি সংবাদপত্র, মাধ্যমে কোনও বিজ্ঞাপন মিলবে না।

পশ্চিমবঙ্গ এখন এখানে আছি।

————————————————–

ফিরে আসা যাক ২১ মার্চ, ১৯৭৭-এ। সেদিন কী হয়েছিল?

দুনিয়া সেদিন জেনেছিল হেরে গেছেন ইন্দিরা গান্ধী। ৫৫,০০০ ভোটে — রায়বেরিলিতে। স্বৈরতন্ত্র বিধ্বস্ত। গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নির্বাচনী সংগ্রামে লোকসভায় সিপিআই(এম) মোট ২২টি আসনে জিতেছিল — পশ্চিমবঙ্গে ১৭টি, মহারাষ্ট্রে ৩টি, ওড়িশায় ১ এবং পাঞ্জাবে ১টি। দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি রাজ্য ছাড়া সারা দেশে স্বৈরশাসনের সেদিনের ধারকরা দাঁড়াতে পারেনি।

বেকারী, মূল্যবৃদ্ধি ছিল সঙ্কট। গ্রামে গরিবী মারাত্মক। বন্ধ অনেক কারখানা। এমন ছিল পশ্চিমবঙ্গ। সঙ্গে ছিল হৃত গনতন্ত্র উদ্ধারের গন-আকুতি।

বিধানসভা নির্বাচনে ফল মিলল। ১৯৭৭-র জুনে। ১৭ জুন থেকে ফলাফল প্রকাশ শুরু হল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল বামপন্থী ফ্রন্ট (তখন তাই বলা হত)। সেবার সর্বোচ্চ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু — সাতগাছিয়ায়। ২১জুন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন তিনি।

ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য হল জাতীয় রাজনীতির সরসারি প্রভাব থাকে পশ্চিমবঙ্গে। আবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক ওঠাপড়ার প্রভাব পড়ে জাতীয় রাজনীতিতে। জাতীয় রাজনীতি এবং পশ্চিমবঙ্গ সম্পৃক্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কালে তাই। স্বাধীনোত্তর ভারতেও তাই। ২০০৮ থেকে ভারতের রাজনীতি সুস্পষ্টভাবে দক্ষিণপন্থী পথে বাঁক নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের সাময়িক পিছু হঠার প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়েছে। দেশে বামপন্থী, গনতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি দুর্বল হয়েছে। আর ৭০ দশকে পশ্চিমবঙ্গের সেই সব দিনের লড়াই জাতীয় ক্ষেত্রে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আবার লোকসভার নির্বাচনের ফল বাংলায় বামপন্থীদের অগ্রগতির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। বামফ্রন্ট সরকার দেশে ধর্মনিরপেক্ষ, গনতান্ত্রিক পরিসরকে শক্তিশালী করেছে — বরাবর।

আজ পশ্চিমবঙ্গ যেখানে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে ১৯৭৭-র মিল খোঁজা অর্থহীন। পরিস্থিতি আলাদা। কেন্দ্রে বিজেপি-র সরকার। ভারতে প্রথমবার রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে রাষ্ট্রিয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। রাজ্যে সরকার তৃণমূলের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির। তিনি নিজেকে প্রবল বিজেপি-বিরোধী হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

‘মমতাকে ছাড়া বিজেপি বিরোধী লড়াই হয় না’ — এমন নিদারুণ ভাবনায় মথিত কিছু মানুষ এখনো এরাজ্যে বাস করেন। কিন্তু বিজেপি যখন কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার খর্ব করে, ৩৭০নং ধারা প্রত্যাহার হয়, তখন সেই ইস্যুতে মমতা ব্যানার্জি চুপ করে থাকেন। ২০২০-র ১৮জুন দেশের ৪১টি কয়লা ক্ষেত্রের নিলামের দিন তৃণমূলের সাংসদরা বোবা হয়ে গেছিলেন। ২ থেকে ৪ জুলাই — টানা তিন দিন ধর্মঘটের ডাক এলো। ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকরা। প্রতিটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে শামিল হতে বাধ্য হলো বিএমএস’ও! ছিল না কে? মমতা ব্যানার্জিতে অনুপ্রাণিত তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন। শুধু তাই নয়। তৃণমূল রাজ্যে কয়লা শ্রমিকদের ধর্মঘট ভাঙতে গেল। বিরোধিতা করলো মোদী-সরকারের বেসরকারিকরণের নীতির বিরুদ্ধে দেশজোড়া ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক ধর্মঘটের।

রাজ্যে ধর্মঘট ভাঙতে মমতা ব্যানার্জি পুলিশ, দলের মারমুখী কর্মীদের পাঠান। এই প্রশ্নে বিজেপি-র নীতিও তাই — বিরোধীদের প্রতিবাদ বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস কর। আর বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে? মমতা ব্যানার্জিই ১৯৯৮ থেকে ২০১১ রাজ্যে ১৩টি বন্‌ধ ডেকেছেন।

শ্রমিকদের আন্দোলন সম্পর্কে বামফ্রন্ট সরকারের মনোভাব কী ছিল? ১৯৯৪। ৯ নভেম্বর। যাদবপুরের এক সভায় কমরেড জ্যোতি বসুকে বলতে শোনা গেল,‘‘…কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন আপনারা তো শ্রেণী সংগ্রামের পথ ছেড়ে দিয়েছেন, আমি বলি, শ্রেণী সংগ্রাম করছি বলেই ১৭বছর ক্ষমতায় আছি। শ্রেণী সংগ্রাম করছি বলেই শ্রমিকদের অনেক দাবি মালিকদের মেনে নিতে হয়।…শ্রমিকদের বলি দাসখত দেবেন না, ন্যায্য দাবি দাওয়ার জন্য আন্দোলন করবেন। আমরা বলি ধর্মঘটের অধিকার অবশ্যই থাকা উচিত।…শ্রমিকরা যদি নিজেদের অধিকার ছেড়ে দেন তাহলে তো তারা শ্রমিক হওয়ার উপযুক্তই নন।’’

আজকের পশ্চিমবঙ্গে এই মনোভাব অকল্পনিয়। মমতা ব্যানার্জি দাবি করেন, তিনি ‘ধর্মঘট-শূণ্য’ রাজ্য বানিয়েছেন। কিন্তু লকআউট? তাঁর কোনও কথা নেই। বারাকপুর, হলদিয়া অথবা দূর্গাপুর — মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতায় সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ নেই। বরং মদত আছে। আসলে তৃণমূল-বিজেপি-র নীতি এক। উদাহরণ? ঢালাও চুক্তিতে নিয়োগ রাজ্য দেখেছে মমতা-শাসনেই। চুক্তিতে পুলিশ, চুক্তিতে গ্রুপ ডি স্টাফ, চুক্তিতে চিকিৎসক — সব ক্ষেত্রে মোদীর নীতি রাজ্যে।

—————————————————-

তৃণমূল গড়েই উঠেছে সঙ্ঘের গেমপ্ল্যানে। ২০১১-তে রাজ্যে তথাকথিত ‘পরিবর্তন’ প্রসঙ্গে তাই মমতা ব্যানার্জির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা দেখা গেছিল আরএসএস-র মুখপত্রে।

১৯৯৭-র ১৬ই ডিসেম্বর। তাঁর আগামী রাজনীতির কৌশল সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জি সাংবাদিকদের বলেছিলেন,‘‘বিজেপি অচ্ছুৎ নয়। এত লোক ওদের ভোট দিচ্ছে।’’

এই দল সরকারে থাকলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।

রাজ্যে আরএসএস-র শাখা ১১ বছরে ৪৩০ থেকে ১৬০০-র বেশি হয়েছে। দু’ ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তিই প্ররোচনা পেয়েছে। বেড়েছে সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুল। যা বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে কল্পনাই করা যেত না। ১৯৯২, ৬ডিসেম্বর। দেশের নানা জায়গায় দাঙ্গা। বাবরি ভেঙে ফেলেছে উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদীরা। পশ্চিমবঙ্গে দাঁত ফোটানোর সুযোগ পায়নি স্বয়ংসেবকরা। ৩৪ বছরে ‘দাঙ্গা’ — পশ্চিমবঙ্গে প্রায় মুছে যাওয়া একটি শব্দ ছিল।

আর এখন?

শুধু ২০১৪ থেকে ২০২০ — পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে ১৫৪ টি। বছরে গড়ে প্রায় ১৯টি। এই তথ্য রাজ্য সরকারের রিপোর্টের ভিত্তিতেই। এনসিআরবি-র ২০২১-র রিপোর্ট প্রকাশিত হলে রাজ্যের এই ভয়াবহ অবস্থা আরও কিছুটা বোঝা যাবে।

সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাঙায় মদত দিচ্ছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। প্রমাণ? অনেক। একটা দেওয়া যাক। ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের পরে নবান্নের সাংবাদিক সম্মেলনে সংখ্যালঘুদের ‘দুধ দেওয়া গোরু’ বলতে পিছপা হননি মমতা ব্যানার্জি। ২০২০-র ১৫ ডিসেম্বর। তাঁর সভা কোচবিহারে। সেখানকার দুটি মন্দিরের জন্য ৬ কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা করে আসাউদ্দিন ওয়াইসির দলের প্রসঙ্গে তৃণমূল নেত্রী বললেন,‘‘বিজেপি হিন্দুদের ভোটটা নেবে। আর ওরা মুসলিমদের। আর আমি কি কাঁচকলা খাবো?’’

রামনবমীর মিছিলে অস্ত্র হাতে তৃণমূলের বিধায়ক, নেতারা নাচবেন। আর হিন্দুত্ববাদ বসে থাকবে? বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে অভাবনীয় ছিল।

কমরেড জ্যোতি বসু বলতেন,‘সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না।’ তৃণমূল তা ১১ বছরে প্রমাণ করেছে।

বামফ্রন্টের সময়ে ‘শূদ্র জাগরণ’ হলে, মমতা-শাসনে ধর্মীয় বিভাজনের উস্কানিই সরকারি উদ্যোগ।

————————————————–

‘শূদ্র জাগরণ’ কথাটি কোথা থেকে এলো?

বামফ্রন্ট সরকারে থাকাকালীন ৩৪ বছরে কী পরিবর্তন এনেছিল, তা নিয়ে অনেক লেখা আছে। অনেক তথ্যও আছে। ফলে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন এখানে নেই। তবু তৃণমূল সরকারের পত্রিকাতে প্রকাশিত প্রবন্ধের উল্লেখ এই ক্ষেত্রে করতে হবে।

২০১২-র এপ্রিল। রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের মুখপত্র ‘পঞ্চায়েতী রাজ’ পত্রিকার সেই সংখ্যায় ছাপা হয় প্রবন্ধটি। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল — ‘গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগন’। তার ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে লেখা হয়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নেতৃত্বে আছে গরিব মানুষের প্রতিনিধি। এদিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভারতবর্ষে নজিরবিহীন। ফলে এ রাজ্যে ঘটেছে অবদমিত মনুষত্বের বিকাশ। সম্ভবত এ এক ধরনের ‘শূদ্র জাগরণ’।’’

প্রশ্ন হল ‘অবদমিত মনুষত্বের বিকাশ’ কিংবা ‘শূদ্র জাগরণ’ মানে কী?

রাজ্যের প্রায় ৭৩% মানুষ তথাকথিত ‘শূদ্র।’ অর্থাৎ সামাজিক, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা। ক্ষমতা তাঁদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল বামফ্রন্ট। প্রথমে ভূমিসংস্কার — গ্রামের আর্থিক ব্যবস্থার বিপুল পরিবর্তন। তার সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চায়েত — গরিবের সরকার, গ্রামের সরকার।

অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস বলছে, রাজনৈতিক, সামাজিক আধিপত্য ভোগ করেছে সম্পন্ন, উঁচু জাতের বর্ণ হিন্দুরা। সেই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল বামফ্রন্টের ভূমিসংস্কার, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত কর্মসূচী।

মমতা-শাসনে? এই ১১ বছরে গ্রামে জমি কুক্ষিগত হচ্ছে একাংশের হাতে — ছলে, বলে এবং কৌশলে। পাশাপাশি পঞ্চায়েত, পৌরসভাগুলির ক্ষমতার অনেকটাই এখন মানুষের থেকে কেড়ে আমলাদের হাতে। এই নীতি দেশের শাসকদের। মমতা ব্যানার্জি সেই নীতির অনুসারী।

লুটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে পঞ্চায়েত, পৌরসভা। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের উদাহরণ যথেষ্ট হবে। সেই বছর রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ— তিনটি স্তরে ৫৮,৬৯২ আসনের মধ্যে ২০,০৭৬টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। বিরোধীদের মেরে, মহিলাদের শ্লীলতাহানি করে, মানুষকে ভয় দেখিয়ে পঞ্চায়েত দখল করেছিল মমতা ব্যানার্জির দল। যে কটি আসনে ভোট হয়েছিল, তারও বেশিরভাগ বুথ দখল করে ‘জিতেছে’ মুখ্যমন্ত্রীর দল।

পৌরসভাগুলির ক্ষেত্রেও এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে। বিধানসভা, লোকসভা নির্বাচনেও বুথ দখল না করে, লুট না করে থামেনি তৃণমূল। নির্বাচনে জোর করে দখল কেন? পঞ্চায়েত, পৌরসভার টাকার ডাকাতি করার জন্য নির্বাচনে দখল জরুরী। স্বৈরতন্ত্র অবধারিতভাবে দুর্নীতির আধার হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে।

প্রতিটি ক্ষেত্রে দখল কায়েম করাই মমতা ব্যানার্জির লক্ষ্য। এমনকি মানবাধিকার কমিশন, বাংলা আকাদেমী — কিছু বাদ যাবে না। তাঁর শাসনে এটিই দস্তুর। আর এই ক্ষেত্রে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পরোক্ষ মদত পেয়েছে তারা। দুর্নীতির তদন্তগুলিতে সিবিআই-র অগ্রগতি প্রায় নেই। পঞ্চায়েতে, পৌরসভায় টাকা চুরি আটকাতে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ দেখা যায়নি গত ১১ বছরে। এখন দেখছি, যাঁরা প্রবল হিন্দুত্ববাদী ছিলেন, তেমন লোকদের সাদরে বরণ করে নিচ্ছে তৃণমূল।

আর গনতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া, প্রতিবাদীর মুখ রক্তের বন্যায় রুদ্ধ করায় মোদী জমানা কতটা বেপরোয়া তা আমাদের জানিয়েছে উত্তরপ্রদেশ-দিল্লির বুলডোজার-কান্ড, সিএএ-এনআরসি-র প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে মামলা দায়ের কিংবা দেশের অর্থ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রীর উদ্ধত উচ্চারণ — ‘দেশকো গদ্দারো কো/গোলি মারো শালো কো।’

গনতন্ত্রের প্রতি বিপজ্জনক দুটি দলই।

দুটি দলকেই পরাস্ত করা আজকের দায়িত্ব। বিজেপিকে হঠাতে হবে। তবে রাজ্যে তৃণমূলকে পরাজিত করার পরিবেশকে আরও অনুকূল করে তোলা যাবে।

হাতিয়ার — সেই লাগাতার গন আন্দোলন।

চন্দন দাস