মানসিকতা দিয়ে একজন নেতাকে চেনা যায়। ঠিক যেমন শ্যামাপ্রসাদের শ্রেণি চরিত্রও আপাত বিভিন্ন সত্য ঘটনার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন আদ্যন্ত সামন্ত মানসিকতার প্রতিনিধি ও ধনী বুর্জোয়াদের সেবাদাস।


১৯৪৩ সালের অবিভক্ত বাংলার ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের সময় সামান্য একটু ফ্যানের জন্য লাখো মানুষ হত্যে দিচ্ছেন কলকাতায়। মারা যাচ্ছেন হাজারে হাজারে একটু খাবার না পেয়ে। ঠিক তখন, ঠিক তখনই হুগলির জিরাটে, বহু বিজ্ঞাপিত ‘পশ্চিমবঙ্গের জনক’ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রাসাদ নির্মাণ শুধু অশ্লীল নয় অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং অসংবেদী মনের পরিচয়।
জিরাট, যেখানে এই বিজেপি আইকন দুর্ভিক্ষের বাজারে পেল্লায় প্রাসাদ হাঁকিয়েছিলেন তার কাছাকাছি এমন একজনকেও খুঁজে পাবেন না যিনি ওই ‘মহান’ পুরুষের সুখ্যাতি করছেন। বরং তাঁর দেখনদারি, বড়লোকি চালচলন, দাম্ভিক স্বভাব ও স্বজনপোষণের কারণে এলাকার প্রত্যেকটি লোক শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে তিতিবিরক্ত হয়ে ছিলেন। চিত্তপ্রসাদের বিখ্যাত বই ‘ক্ষুধার্ত বাংলা’-য় বিস্তারিত বলা হয়েছে কীভাবে মানুষের অভাব যন্ত্রণাকে পুঁজি করে শ্যামাপ্রসাদ ও সে সময়ের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারবারিরা সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করেছিল গ্রামে গ্রামে। শুধু তাই নয় এই বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী চিত্তপ্রসাদ ক্ষুব্ধ হয়ে তা নিয়ে পাতার পর পাতা লিখেছেন তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির ইংরেজি পত্রিকা পিপলস ওয়ারে। বস্তুত তখনকার বিভাজনের রাজনীতির বীজই মহীরুহ হয়ে একদিন বাংলা ভাগ করেছিল। এবং আরো দৃঢ় ভাবে তৃণমূল সরকারের হাত ধরে সেই বিষবৃক্ষ ডালপালা বিস্তৃত করে পশ্চিমবঙ্গকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে।


১৯৪৭ সালের আগে যেমন নেহেরু ও কংগ্রেস  এবং মহম্মদ আলি জিন্নাহ ও মুসলিম লিগ ভারত ভাগের জন্য দায়ী ঠিক তেমনই ব্রিটিশদের তাবেদার বিজেপির গুরু সাভারকারও সমান দোষেদুষ্ট। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের ঢের আগে বিড়লা ও শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক গুরু সাভারকর দেশভাগের দাবি তুলেছিলেন। সাভারকর ভাগের কথা স্পষ্ট না করলেও দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন তিনিই। তার অনুপ্রেরণাতেই পরবর্তী সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ভারত ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ করতেই হবে।
 ভারতীয় জনতা পার্টি এখন নতুন করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে মূল্যায়নের সাথে সাথে ‘পশ্চিমবঙ্গের জনক’ বলে তাঁকে উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায়।কিন্তু মুশকিল কি জানেন ইতিহাস বড় নির্মম। তা খুঁড়লে তো যাবতীয় কুকীর্তি ঠিক বেড়িয়েই পড়বে। তাকে কোনও প্রবলশক্তিও ইচ্ছে মতো চালিত করতে পারে না। 


একটা জিনিস আজ আরও পরিষ্কার যে, হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, সেদিন ও আজ মিলিয়ে যে বিপুল সঙ্ঘ পরিবার তার রাজনৈতিক লক্ষ্য কিন্তু অতীতেও যা ছিলো, বর্তমানে ঠিক একি। তা হলো হিন্দু ভারত নির্মাণ। পুরাকালের রাজাদের অশ্বমেধ ঘোড়া যেভাবে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করত ঠিক সেইভাবেই একমাত্রিক আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির জয় ঘোষণা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির রণনীতি। যেখানে মুসলিম, দলিত আদিবাসী, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ কারও কোনও স্থান নেই।


 এর আগেও বলতে শোনা গেছে আরএসএস সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতকে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক বিচারধারা ও মোহন ভাগবতের চিন্তাভাবনা এক ও অভিন্ন। তার ধোঁয়া আরো সুকৌশলে ধুমায়িত হচ্ছে ২০১১ সালের পর থেকে। শুধু পশ্চিমবাংলায় নয় সারা দেশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই। 
দেশভাগের পিছনে, ভারত উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পিছনে সুস্পষ্টভাবেই মনুবাদী বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর হাত আছে তা নিয়ে বিতর্কের জায়গা নেই। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজনীতি, বাংলা বিভাজন, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাত গণহত্যা, আজকের সঙ্ঘপরিবারের উত্থান, এ রাজ্যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ক্রমবিকাশ, কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা বিলোপ, এনআরসি, সি এএ রাজনীতি কোনটাইও কিন্তু  আলাদা নয়। এ হলো এক বিকল্প ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক নির্মাণ। 


আজকের সঙ্ঘপরিবার মহানব্যক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পুনর্মূল্যায়ন করার নামে তাদের যাবতীয় ইতিবাচক ভূমিকাকে নস্যাৎ করে জনমনে তাদের খাটো করে অন্যদিকে ভারতবাসীর মননে আইকন হিসেবে চরম প্রতিক্রিয়াশীল প্যাটেল ও শ্যামাপ্রসাদের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় সতত সক্রিয়।অদ্ভূত বিষয় হলো অনেক প্রগতিশীল মানুষ জন দক্ষিণপন্থী রাজনীতির চতুর কৌশলের শিকার হচ্ছেন   ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক বিচার না করে। 


শ্যামাপ্রসাদ থেকে আজকের মোদি, বিজয় বর্গী, অমিত শাহের রাজনৈতিক ধরন যদি অনুধাবন করেন দেখবেন অদ্ভুত সাদৃশ্য টের পাবেন। এমনকি প্রচারের ধরনও মোটের ওপর একই।
চিত্তপ্রসাদ মন্বন্তরের মেদিনীপুর নিয়ে লিখতে বসে এমন কয়েকটি কথা লিখেছেন যা সময় না বলে দিলেও শ্যামাপ্রসাদেরর মেরুকরণের রাজনীতির স্পষ্টবার্তা টের পাওয়া যায়।


একদিন চিত্তপ্রসাদ ঘুরতে ঘুরতে একটি অফিসে এলেন। মেদিনীপুর শহরে যেটা কিছুদিন আগে ছিলো কংগ্রেসের দখলে সেটা রাতারাতি সাইনবোর্ড বদলে হিন্দু মহাসভার দপ্তর হয়ে গেছে। মেদিনীপুর শহরে সমস্ত ত্রাণ সমিতি একত্রিত হয়ে বঙ্গীয় ত্রাণ সমিতি নামে এক স্বেচ্ছাসবী সংগঠন গড়ে তার মধ্যে দিয়ে যাবতীয় রিলিফের কাজ চালাচ্ছিলেন। যার যেটুকু সামর্থ্য সে তাই দিয়ে সমিতিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অবাক বিষয়শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়  কোনও এক রহস্যজনক কারণে ত্রাণের জন্য প্রচুর পরিমাণে চাল সংগ্রহ করে সমিতিকে না দিয়ে তা পুরোটাই পাঠিয়ে দিলেন হিন্দু মহাসভার সদস্য এক ব্যবসায়ীকে। তমলুকেও সর্বদলীয় ত্রাণ সমিতিকে উপেক্ষা করে শ্যামাপ্রসাদ সাহায্য পাঠালেন নিজের অনুগত আর্য সমাজ নিয়ন্ত্রিত মহেন্দ্র সঙ্ঘের কাছে। শুধু এতটুকুতেই ক্ষান্ত হন নি। একবার তাঁর গ্রামের না খেতে পাওয়া গরিব কৃষকেরা দল বেঁধে শ্যামাপ্রসাদের কাছে এসে হত্যে দিয়ে বলেছিলো না খেতে পেয়ে ছেলেমেয়ে পরিবার নিয়ে মরতে বসেছি হুজুর বাঁচান। শ্যামাপ্রসাদ জবাবে বলেছিলেন, বিনা মজুরিতে আমার জমি চাষ করে দে, তখন ভেবে তোদের কথা। সেদিন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল গ্রামীণ সর্বহারারা।


এদিকে ইউনিয়ন বোর্ড শ্যামাপ্রসাদের হাতে ১৫টি থান কাপড় দিয়ে অনুরোধ করেছিল তা গ্রামের সবচেয়ে দুঃস্থ ৮৩টি পরিবারের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দেওয়ার জন্য। বাংলার ব্যাঘ্রশাবক তার পুরোটাই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের উপহার হিসেবে দান করে দেন। 
‘ক্ষুধার্ত বাংলা’ বইটির পাতায় পাতায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া আছে গ্রামীণ অর্থনীতির মুল চালিকাশক্তি গ্রামীণ হাটকে ধ্বংস করে ওই একই জায়গায় আর একটি হাট বসিয়ে শ্যামাপ্রসাদ তাঁর অনুগামীদের, হিন্দু মহাসভার নেতা কর্মীদের কীভাবে মুনাফার বিকল্প কালোবাজারির পথ দেখিয়েছিলেন।

বাংলার ইতিহাসে ব্রিটিশের দান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দৌলতে যে নব্য জমিদার বা সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল সারা বাংলায়, তাদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্গের হিন্দু। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পিছনে ছিলো অর্থনীতি ও শোষণ। নানা কৌশলে হাজার রকমের কর আদায় থেকে এমন কোনও দুষ্কর্ম ছিলো না, যা সেকালে জমিদারেরা করতেন না। একটা সময় বিক্ষুব্ধ কৃষকদের এক বড় অংশ বাধ্য হয়েই মুসলিম লিগের রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলো। আদতে ভূস্বামী না হয়েও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন মননে ও যাপনে ছিলেন উচ্চবর্গের জমিদারতন্ত্রের উপযুক্ত প্রতিনিধি।


শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় শ্রেণির প্রতি ঘৃণা ধীরে ধীরে চরম হয়ে উঠেছিলো পাশাপাশি মুসলিমবিদ্বেষ পরিণত হয়েছিলো মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধিতে।আপনাদের দৃষ্টিতে ব্যাধি বলুন আর নাই বলুন, নামগুলো বদলে গেছে। যেমন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, মোহন ভাগবত, নরেন্দ্র মোদি, কৈলাশ বিজয়বর্গী, অমিত শাহ। তবে তা কিন্তু নতুন করে এই উত্তরসূরিদের হাত ধরে প্রবল ক্ষমতা নিয়ে ফিরে এসেছে।আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই   ১৯৪৬-৪৭-এর অখণ্ড বাংলায় ২০ ফেব্রুয়ারি  প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ঘোষণা করলেন ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে তারা ভারত ছেড়ে চলে যাবেন। ক্ষমতা কাকে দেওয়া হবে তা নির্দিষ্টভাবে না বলে, বরং একটু ধোঁয়াশা রেখে জানালেন যে ক্ষমতা কোনও কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের হাতে দেওয়া হবে অথবা তৃতীয় কোনও উপায়ও খোঁজা হবে। এই অস্পষ্ট সিদ্ধান্ত সব রাজনীতির লোকজনের মধ্যে একই সঙ্গে হতাশা ও লোভ জাগিয়ে তুলে কালনেমির লঙ্কা ভাগের লড়াইয়ে পরস্পর গোষ্ঠী, সম্প্রদায়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। এই লঙ্কাভাগে শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভার ভূমিকাও চরম ছিলো ঠিক তেমন ভাবেই  এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক কূনাট্য একদম দেশভাগের আগের ছবি ফিরিয়ে আনছে।

তথ্য সংগৃহীত