সামাজিক মাধ্যমঃ ‘আমি’ থেকে আমরা

সান্ত্বন চট্টোপাধ্যায়

গণমাধ্যমের চৌহদ্দিতে আছেন অথচ সামাজিক মাধ্যমের অলিন্দে ঘোরাফেরা করেননা এমন মানুষের খোঁজ পাওয়া সত্যিই কঠিন। একথা আরও বেশি সত্যি তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রে। তাদের কাছে এযেন বহির্দুনিয়ার খবরাখবর সংগ্রহের সিংহদুয়ার। সামাজিক মাধ্যমের জানলা খুলেই তারা উঁকিঝুঁকি দেয় চারপাশের ঘটমানতার প্রতি। নানা ধরণের সামাজিক মাধ্যম তাই জনপ্রিয়তার নিরিখে বেড়ে চলেছে আর সেই সব ধরণের উপস্থিতির ধারক রূপে সামাজিক মাধ্যম একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম বা পরিসরে পরিণত হয়েছে। এই পরিসর একদিকে যেমন বিপুল তথ্য বিনিময়ের মাধ্যম, অন্যদিকে এর ব্যবহার তথা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথেই তা হয়ে উঠছে এক অশেষ সম্ভাবনার বাজার।

সামাজিক মাধ্যম আসলে ইন্টারনেটের সন্ততি। ইন্টারনেট চালিত গণমাধ্যম অন-লাইন মাধ্যম নামে পরিচিত। সামাজিক মাধ্যমও তাই। কিন্তু সব অন-লাইন মিডিয়াই সামাজিক মাধ্যম নয়। আসলে সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা প্রচারযোগ্য তথ্য তৈরি ও বিনিময় করতে পারেন। যা প্রথাগত পরিভাষায় ‘ইউসার জেনারেটেড কনটেন্ট’ হিসেবে পরিচিত। এই মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ আর প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলেই ব্যবহারকারীর জন্য খুলে যায় তথ্য ও বিনোদনের বিপুল পসরা। ব্যক্তি মানুষের পছন্দ, ভালোলাগার নিরিখে নির্মাণ হয় এক অন্য জগতের। ভার্চুয়াল সেই জগত গড়ে ওঠে ব্যক্তির ‘আমিত্বের’ উপকরণে। সেই নিরিখে সামাজিক মাধ্যমের অন্তর্নিহিত চরিত্রের মধ্যেই ব্যবহারকারীর ‘আমি’ পরিচয়ের ওপর বহুল গুরুত্ব আরোপিত আছে। এই পরিসরে ব্যবহারকারীরা কেবল নিজেদের পূর্ব-পরিচিত মহলেই সংযোগ রক্ষা করতে পারে না, খুঁজে পেতে পারে নতুন বন্ধুও। পরস্পর-যুক্ত জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই সংযোগ। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এটি কার্যত একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। এই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ব্যক্তির ‘আমি’র পছন্দ, ভালোলাগা মুখ্য ভুমিকা নেয়। ভাবুন না, সামাজিক মাধ্যমে কমিউনিটি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনসমষ্টি নয়, বরং ভুবনগ্রামের যে কোন প্রান্তের সমমনস্ক মানুষের ভার্চুয়াল গোষ্ঠী।

সামাজিক মাধ্যমের কতগুলি নির্দিষ্ট চরিত্রাবলী আছে। এই পরিসরে সবচেয়ে জরুরি বিষয় তাৎক্ষণিকতা। যে কোন ঘটনা ঘটার পর যত দ্রুত তা এই পরিসরে দৃষ্টিগোচর করা যায় এবং তার সম্পর্কে আলোচনা বা মতামত ব্যক্ত করা যায় ততই তা প্রাসঙ্গিক হয়। সেই নিরিখে সামাজিক মাধ্যম যে কোন ঘটনায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া দাবি করে। এই দাবি পক্ষান্তরে সামাজিক মাধ্যমে পরিসরে ব্যবহারকারীর সজাগ অংশগ্রহণের পরিপূরক। এই পরিসরের আর এক অবিচ্ছেদ্য চরিত্র হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। সামাজিক মাধ্যমের পরিসরে তাই ‘আমার’ দেওয়াল, ‘আমার’ পেজ বা ‘আমার’ একাউন্ট জাতীয় অভিব্যক্তি ‘আমিত্বের’ অবিচ্ছেদ্য স্বাক্ষর। সামাজিক মাধ্যমে তথ্য সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপনা করতে পারলে লক্ষ্য দর্শকের মনে তার অনুরণন থেকে যায়। এই পরিসরে তথ্যের বিপুল সমাহার অবিরাম প্রবাহিত হয় এবং তাদের প্রবাহের ধারা একটি তথ্য থেকে অন্য তথ্যে অধিক্রমন করে যাকে ইংরাজিতে ওভারল্যাপিং বলে। এর ফলে মানুষের মনোযোগের সময় হ্রাস পাচ্ছে আবার পক্ষান্তরে অনেক তথ্যের মাঝে ব্যক্তি মানুষের পছন্দের অগ্রাধিকার সব তথ্যকে মনে রাখার মতো বলেই মনে করে না। উভয়ক্ষেত্রেই সংক্ষিপ্ততা কার্যকরী সমাধানসূত্র। তথ্য বা বার্তার প্রসারযোগ্যতা এই পরিসরের আর এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অনেকের কাছে একযোগে তথ্য বা বার্তা খুব অল্প সময়ে একই পরিশ্রমে ছড়িয়ে দেওয়া এই মাধ্যমের  শক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। প্রযুক্তির সম্পর্কে বোঝাপড়া থাকলে এবং বিশেষ সামাজিক মাধ্যমের নির্দিষ্ট চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলে এই পরিসরে তথ্য জোগাড় করা সহজ। এই সহজলভ্যতা সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয়তার এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এই পরিসরের আর এক বিশেষ চরিত্র হল তথ্য বা বার্তার ব্যবহারযোগ্যতা। খুব সহজেই এই পরিসরে পাওয়া তথ্য বা বার্তার পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব। এই পরিসরে আর এক জরুরি গুণ হল নমনীয়তা। ঘটনাবলির ওপর ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ যেমন সম্ভব নয়, সেই কারণে এই পরিসরে ব্যবহারকারীর অংশগ্রহণ সর্বদা পূর্বপরিকল্পিত ধাঁচে হয়না। নমনীয়তাই সেক্ষেত্রে টিকে থাকার এবং হতাশা অতিক্রমের সহায়ক হতে পারে।

এই সব চরিত্র বা গুণাবলি সমন্বয়ে সামাজিক মাধ্যমের মূল বৈশিষ্ট্য সামাজিকীকরণ। এই পরিসরকে মনে হয় বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি আপাত মুক্ত পরিসর। এই পরিসরে ব্যবহারকারীর ব্যক্তি-পরিচয় তথা ব্যক্তিমত প্রকাশিত হয়। ব্যক্তির স্বাধীন পরিসর হিসেবে তার ‘আমি’র প্রকাশেই ব্যবহারকারীর কাছে এর গুরুত্ব সর্বাধিক। কিন্তু ব্যবহারকারীরা কেউই এই সামাজিক মাধ্যম সংস্থাগুলির মালিক নন। এগুলি আসলে এক-একটি বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা। বরং ব্যবহারকারীরাই সংস্থারগুলির সম্পদ। ব্যবহারকারীদের সমস্ত তথ্যভাণ্ডার রক্ষিত হয় সংস্থাগুলির কাছে। বলাই বাহুল্য, সে এক বিশাল বাজার। এই বাজারে পণ্য বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপনের পসরা সাজিয়ে হাজির হয় কত সংস্থা। সুতরাং ব্যবহারকারীদের সমন্বয়ে তৈরি বাজার আসলে সামাজিক মাধ্যম সংস্থারগুলির মালিকদের রাজস্বের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। সেই কারণেই সামাজিক মাধ্যম এখন বিজ্ঞাপন তথা প্রোমোশনের আকর্ষণীয় মাধ্যম। এই পরিসরের জনপ্রিয়তার সঙ্গে এর মালিকের মুনাফা অর্জনের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত — বিষয়টি অনেক সময়েই চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু এই বিষয়টি দৃষ্টির অগোচরে থেকে গেলে অনুধাবনে মরীচিকা সদৃশ বিভ্রম ঘটবে।

সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা প্রাথমিকভাবে এই মাধ্যম ব্যবহার করেন ব্যক্তি হিসেবে। সেখানে ব্যক্তির ছবি, মতামত, শেয়ার সবকিছু মিলিয়ে ওই পরিসরে নির্মিত হয় তার ভাবমূর্তি। কিন্তু মূলত ব্যক্তিগত এই পরিসরে যাদের ভাবমূর্তি ভাল লাগে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে চান আরো মানুষ। আসলে আদান-প্রদানের সুযোগ থাকায় অচেনা মানুষকেও খানিক দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ থাকে এই পরিসরে। আর এই পছন্দ যখন সমমনস্কতার রূপান্তরিত হয় তখন অনেক মানুষ নির্দিষ্ট বিষয়ে গ্রুপ বা কমিউনিটি তৈরি করেন। এই কমিউনিটির অস্তিত্ব বিশ্বজোড়া। এইভাবে সামাজিক মাধ্যমের তথ্যপ্রবাহে বহুমুখী প্রবণতা যুক্ত হচ্ছে। বহুত্ববাদের দৃষ্টিতে বিষয়টি অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক। অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমের ঊর্ধ্বমুখী জনপ্রিয়তার কারণে তথ্যপ্রবাহে নমনীয়তা ও তাৎক্ষণিকতার গুরুত্ব বেড়ে গেছে বেশ খানিক। অকুস্থল থেকেই সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা সামাজিক মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আপডেট তুলে দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে সেটি তথ্যের প্রথম উৎসরূপেও গৃহীত হচ্ছে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও এই সুযোগে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের কাজকর্মের হাতে গরম ছবি দিচ্ছেন। বহু ক্ষেত্রেই সংবাদপত্র, টেলিভিশনের মতো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমকেও সেই সূত্র স্বীকার করতে হচ্ছে।

ব্যবহারকারীর তৈরি করা বার্তা বা ‘ইউসার জেনারেটেড কনটেন্ট’ চরিত্রগতভাবে খবরের কাগজ, রেডিও বা টেলিভিশনের দর্শকদের থেকে সামাজিক মাধ্যমের  ব্যবহারকারীদের পৃথক করে। ওখানে যারা গ্রহীতার ভূমিকায়, এখানে তারা নির্মাতা। এখানে সংবাদপত্র, রেডিও বা টেলিভিশনের মতো কোন আরোপিত সম্পাদকীয় নীতি নেই। ফলত স্বাধীনতা ও বহুত্বের উপাদান এই পরিসরে পর্যাপ্ত। অতএব এক ধরনের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনাও এই পরিসরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। এই পরিসরের ব্যবহারকারীদের কাছে নিজের মত প্রকাশ করা, তার পক্ষে বিতর্ক করা, বিপক্ষ যুক্তি খণ্ডন করা ছাড়া অন্য কোন দায় নেই। যেখানে সংবাদপত্র, রেডিও বা টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমে পাঠক, শ্রোতা বা দর্শকের বক্তব্য খণ্ডাংশ আকারেই প্রচারিত হতে পারে এবং তার প্রকাশও নির্ভর করে সেই গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতির ওপর সেখানে সামাজিক মাধ্যমে তথাকথিত কম প্রভাবশালী মানুষও তার নিজের কথা সপাটে বলে অনেককে জানিয়ে দিতে পারছেন — ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে এর গুরুত্বও কিছু কম নয়। সামাজিকীকরণের প্রেক্ষিতে এই পরিসরের এই চরিত্রের কথাও নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য।

 গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহান যেমন বলেছিলেন, ‘মিডিয়াম ইস দ্য মেসেজ’ অর্থাৎ ‘মাধ্যমই বার্তা’, তাতে মনে হতে পারে প্রযুক্তিই নিয়ামক। একথা সত্যি হলে তো মালিকানার প্রকৃতি, সম্পাদকীয় নীতি, রাজনীতি, পুঁজির নিয়ন্ত্রণ, শ্রেণী-লিঙ্গবৈষম্য সবই অপ্রাসঙ্গিক এবং স্বাভাবিকভাবেই তা স্থিতাবস্থা বজায়ের পক্ষেই ঝুঁকে থাকে। অতএব স্থিতাবস্থার বদলে যারা ব্রতী তাদের মনে রাখা জরুরি সামাজিক মাধ্যম প্রযুক্তিগতভাবে যথেষ্ট সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করলেও, তার বাস্তবায়ন অনেকগুলি আনুষঙ্গিক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু খবরের কাগজ, টেলিভিশন থেকেও তথ্য সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়, সুতরাং সেখানে আধিপত্য বজায় থাকলে তার প্রভাব সামাজিক মাধ্যমেও পড়ে। এছাড়া কোনটা তথ্য আর কোনটা তথ্য নয়, তার ধারণাটাও মোটেই প্রযুক্তি তৈরি করে না। আজকের দিনে ভুয়ো খবর বা ফেক নিউস কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সবিস্তারে সে এক পৃথক আলোচনার বিষয়।অর্থের মাধ্যমেও সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রম সৃষ্টি করে বা ক্যামোফ্লেজ করে মানুষকে ভুল বোঝানো যায়। অর্থের বিনিময়ে ‘লাইক’ পাওয়া যায় এমনই এক উদাহরণ। মূলস্রোতের গণমাধ্যমগুলি কীভাবে ক্ষমতার স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে জনমানসে ‘সম্মতির নির্মাণ’ করে তা নোয়াম চমস্কি এবং এডওয়ার্ড হারম্যান তত্ত্বায়িত করেছেন। সম্মতির নির্মাণের এই ঘেরাটোপ থেকে সামাজিক মাধ্যমও মুক্ত নেই একথা বলাই বাহুল্য।

অতএব সমাজে আধিপত্যবাদের বিপ্রতীপে যারা কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান তাদের প্রচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সম্মতির বিনির্মাণ। সামাজিক মাধ্যমের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যদি বিকল্পের কথা, আধিপত্য ভাঙার কথা, যূথবদ্ধ সমানাধিকারের ভাবনার কথা বলতে চান তবে সর্বপ্রথম এই পরিসরের আনুষঙ্গিক আত্মমুখিনতার ভাবনাকে বিনির্মাণ করা জরুরি। সমমনস্কদের খুঁজে বার করে তাদের মনের কথা মনোগ্রাহী উপস্থাপনায় তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে ভৌগলিক সীমারেখাকে অতিক্রম করে যন্তর-মন্তর ঘর ভাঙার কাজ জরুরি, এতে কোন সন্দেহ নেই। কতিপয়ের আধিপত্য ভেঙে ‘আমি’ থেকে আমরার বৃহৎ প্রেক্ষাপটে উত্তরণের জন্য সামাজিক মাধ্যমে বিকল্প ভাষ্যের চর্চা ও প্রসার জরুরি। আত্মমুগ্ধতার মোহজাল ছিঁড়ে তবেই বলা সম্ভব – “সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়, সেথায় আপন আমারও”।