জনজীবনে প্রভাব রয়েছে এমন যে কোন সামাজিক সংগঠনে নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেওয়াই আর এস এস সহ হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য। জাতীয়তাবাদের মোড়কে এই আগ্রাসন প্রক্রিয়া  নরমে গরমে চলতে থাকে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট হয়ে ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের দিকেও মোহন ভাগবত, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের বাড়ানো হাত বজ্র মুষ্টিতে পরিণত হতে দেরি হয়না। বিসিসিআইএর সভাপতি পদ থেকে বিশেষ কোন প্রস্তুতি ছাড়াই প্রাক্তন ভারতীয়  অধিনায়ক  সৌরভ গাঙ্গুলিকে সরিয়ে দেওয়ার মধ‍্যে সেই বজ্রমুষ্টির ছবি দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তিন বছর আগেও আরেক কৃতী প্রাক্তন ক্রিকেটার ব্রিজেশ প‍্যাটেলের বদলে সৌরভ গাঙ্গুলিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হস্তক্ষেপেই শেষ মুহূর্তে  বিসিসিআইএর চেয়ারম্যান করা হয়। সৌরভ গাঙ্গুলি কি জানতেন না এই  খেলার মাঠে রাজনীতি র অনুপ্রবেশের খবর? অবশ্যই জানতেন। সিএবি র সভাপতি থাকার সময়  জগমোহন ডালমিয়ার মৃত্যুর পর তৃণমূল কংগ্রেস তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া তিনি সিএবির প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না।  এবং কি আশ্চর্য আমরা তখন দেখেছিলাম প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার পুত্র অভিষেক ডালমিয়া এবং কন‍্যা বৈশালী ডালমিয়া দুজনেই মমতা ব‍্যানার্জীর প্রতি নিশ্ছিদ্র আনুগত্য দেখাচ্ছেন।

২০১৬ থেকে ২০২১ বালি বিধানসভার এম এল এ ও ছিলেন বৈশালী।  ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় বৈশালী বিজেপিতে চলে গেলেও অভিষেক ডালমিয়া বদলান নি। কিন্তু অভিষেক জাতীয় স্তরেও ক্রিকেট দল গড়া বা প্রশাসনিক কোন বিষয়ে  সংঘাতে যান নি। মহম্মদ শামির  অপমানিত হওয়া বা ঋদ্ধিমান সাহার বাদ যাওয়া নিয়ে কোন প্রতিবাদী বিবৃতিও  দেন নি। ফলে তৃণমূল বিজেপি কারুর কোপদৃষ্টিতে তিনি পড়েন নি। একইভাবে সৌরভ গাঙ্গুলিও প্রকাশ‍্যে কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করলেও প্রাক্তন ফুটবলার  সুব্রত ভট্টাচার্যের মত রাজ‍্যের সমস্ত ক্রীড়া সংস্থায় মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জীর পরিবারের সদস্য এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের সর্বোচ্চ পদে থাকা নিয়ে প্রতিবাদে কখনও  মুখর হন নি।  ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ভালো ফলাফলের প্রেক্ষাপটে সৌরভ গাঙ্গুলির মত আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রিকেটে বাঙালি খেলোয়াড়কে দেশের ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থার  সর্বোচ্চ আসনে বসানোর পিছনে নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহদের কোন রাজনৈতিক চাল ছিল বলে অনেকেই সন্দেহ করেন। তারপর থেকেই মাঝে মধ‍্যেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সৌরভ গাঙ্গুলি  বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন এমন খবরে সংবাদমাধ্যম সরগরম হয়ে উঠত।   

বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইণ্ডিয়ার সভাপতি হিসাবে  সৌরভ গাঙ্গুলির বিদায় নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়া জগতের গৈরিকিকরণ প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেল এমন কথা বলাই যায়। আপাত দৃষ্টিতে সৌরভ গাঙ্গুলি নামে একজন কৃতী  ক্রিকেটার ও প্রাক্তন  বোর্ড সভাপতি হিসাবে মেয়াদ শেষ করার পরে রজার মাইকেল হামফ্রে বিনি নামে আরেক প্রাক্তন ক্রিকেটার যাঁর কেরিয়ারে ১৯৮৩ সালে  বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস‍্য হওয়ার গৌরব রয়েছে – বড় কোন পট পরিবর্তন না হলে তিনি আগামী ১৮ অক্টোবর সভাপতি হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করবেন। কিন্তু যা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই তা হল সচিব হিসাবে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পুত্র জয় শাহের অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লাল কেল্লায় স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে যতই পরিবারতন্ত্র অবসানের কথা বলুন না কেন নিজের দলের বিশ্বস্ত নেতাদের পরিবারের ক্ষেত্রে সেই সিদ্ধান্ত  মান‍্যতা পায় না তাঁরই ইচ্ছা অনুযায়ী। কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা আই সি সি তে ভারতীয় বোর্ডের  প্রতিনিধিও জয় শাহ। নরেন্দ্র মোদী জানেন, কংগ্রেস নেতা রাজীব শুক্লার পরে  তাঁর মন্ত্রীসভার সদস‍্য অনুরাগ ঠাকুরের ভাই অরুণ সিং ধূমল আই পি এল এর চেয়ারম্যান হতে চলেছেন। কোষাধ‍্যক্ষ হিসাবে ব্রিজেশ প‍্যাটেলের পরিবর্তে আসছেন অসমের বিজেপি নেতা আশিস শেলার। এছাড়া সদস‍্য হিসাবে থাকবেন অসমের মুখ‍্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ঘনিষ্ঠ দেবজিৎ শইকিয়া। সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থা এই আই এফ এফের সচিব পদে কল‍্যাণ চৌবেকে এখন জাতীয় দলের প্রাক্তন গোলরক্ষক হিসাবে যতজন মনে রেখেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ চেনেন পশ্চিমবঙ্গের  বিজেপি নেতা হিসেবে।  বিসিসিআইতেও সম্ভবত আগামীদিন একই ছবি দেখতে চলেছি আমরা। যদিও কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী হওয়ার আগে বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর  ২০১৬ সালে এক বছরের জন‍্য বিসিসিআইয়ের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তারও আগে নরেন্দ্র মোদির প্রথমবারের  মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী   অরুণ জেটলি বিসিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ২০১৪ সালে। কিন্তু ২০২২ সালে যেভাবে বিজেপির আগ্রাসন ঘটল জাতীয় স্তরের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল ও ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থায় তা এক কথায় নজিরবিহীন। এর আগে ২০০৫ সালে কংগ্রেস এস এর মন্ত্রী   শারদ পাওয়ার এসেছিলেন বোর্ড সভাপতি হিসাবে। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী  প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীও এ আই এফ এফ সভাপতি ছিলেন১৯৮৮সাল থেকে২০০৮ সালে   কুড়ি বছর ধরে। তাঁদের ক্রিয়াকলাপ  দলীয়  রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার লক্ষ্যে ঘটেছিল এমন বলা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে মুখ‍্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও পুর নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের সঙ্গে সৌরভ গাঙ্গুলির  সুসম্পর্ক থাকলেও তা কখনও সিপিআইএমের সঙ্গে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়নি। 


সময় পাল্টে গেছে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে  বিপুল আসনে জয়ী হওয়ার পর থেকে বিজেপি কে সামনে রেখে সংঘ পরিবার রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে জাতীয় স্তরে জনগণের মধ‍্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন সামাজিক সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করার সুপির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হওয়া শুরু করেছে। বিসিসিআই য়ে রদবদল তারই অঙ্গ। ৬ ই মে ২০২২ সৌরভ গাঙ্গুলির বাড়িতে শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শুধুমাত্র সৌজন‍্যের নৈশভোজে মিলিত হয়েছিলেন এমন ভাবার মত সরল ব‍্যক্তিরাও চালাক হয়ে গেছেন সৌরভ গাঙ্গুলির সাংবাদিক সম্মেলনে ” রাজনীতি নিয়ে আমাদের মধ‍্যে কোন কথাই হয়নি “জেনে। ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের অন‍্যতম সেরা বাঁহাতি ব‍্যাটসম‍্যানের তার আগের স্ট্রোকটা অবশ‍্য আরও জব্বর ছিল। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নাকি এই নৈশভোজের “মেনু মমতা ব‍্যানার্জীর পরামর্শ মেনে”ই সাজিয়েছিলেন। মমতা ব‍্যানার্জিকে না চটিয়ে অমিত শাহের সঙ্গে নিজের বাড়িতে নৈশভোজে মিলিত হওয়ার কৌশল প্রাথমিকভাবে কাজে লাগলেও পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বিজেপির প্রভাব কমে আসা,সৌরভের বিজেপিতে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত দুটিই তাঁকে বিদায় দেওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছিল। কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল জাতীয় ক্রিকেট দল নিয়ে কিছু সৌরভ গাঙ্গুলির  কিছু  পদক্ষেপ ও বিবৃতির ফলে দেশজোড়া তাঁর জনপ্রিয়তা ধাক্কা খায়। বিশেষত বিরাট কোহলিকে নিয়ে বিতর্কের সময়,কোভিড মরশুমে মহিলা ক্রিকেটার বেদা কৃষ্ণমূর্তির মায়ের মৃত্যুর পর বোর্ড সভাপতি হিসাবে সৌরভের আচরণে সংবেদনশীলতার অভাব ছিল। শুধু তাই নয় প্রশাসক হিসাবে সর্বোচ্চ পদে থেকেও বিজ্ঞাপন,টেলিভিশন শো য়ে তাঁর পেশাদারি অংশগ্রহণ স্বার্থের সংঘাতের বিতর্ক তুলেছে। ফলে  সর্বভারতীয় ক্রিকেট মহলে সৌরভ গাঙ্গুলির ভাবমূর্তি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে আই সি সি প্রেসিডেন্ট পদের জন‍্য মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সংখ‍্যা গরিষ্ঠ রাজ‍্য সংস্থার সমর্থন পাবেন এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছেনা। কিন্তু কার্যত জেদের বশেই সিএবির সভাপতির পদে তাঁকে তৃণমূল কংগ্রেসের উদ‍্যোগে ফিরিয়ে আনতে পারে এমন খবর শোনা যাচ্ছে। কেননা কখনও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট না খেলা বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পুত্র জয় শাহকে রেখে সৌরভ গাঙ্গুলিকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত কে বাংলা ও বাঙালি বিরোধিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রচার শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র তো একধাপ এগিয়ে বলেছেন “সৌরভ তৃণমূলের সঙ্গেই আছেন!” সৌরভ গাঙ্গুলি নিজে অবশ‍্য বলেছেন “চিরকাল কেউ বোর্ড সভাপতি থাকে না। আমি আরও বড়ো জায়গায় কাজ করার অপেক্ষা করছি। ” সেই কারণে এখনো সৌরভকে ভালোবাসা অনেক  বাঙালি ক্রীড়ামোদী মানতে চাইছেন না তাঁ প্রশাসক জীবনে দাঁড়ি পড়ে গেল। 


জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রিকেট সাংবাদিকরা অনেকেই বলেছেন বিসিসিআইয়ের শেষ  সভায় সৌরভ গাঙ্গুলির অপসারণ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল উপস্থিত শ্রীনিবাসনের নেতৃত্বে  বিরোধী গোষ্ঠীর কর্মকর্তাদের একের পর এক অভিযোগের বাণের মোকাবিলা করতে না পারায়। তাঁর মত ব‍্যক্তিত্বসম্পন্ন ক্রিকেটারের বদলে স্বাভাবিকভাবেই বেছে নেওয়া হল রজার বিনির মত অপেক্ষাকৃত প্রবীণ নির্বিরোধী ক্রিকেটারকে। যিনি কতকটা বিতর্কে না জড়ানোর জন‍্যই যেন প্রাণপণে নিজের ভাবমূর্তিকে স্বচ্ছ রাখেন। তিনি যখন জাতীয় নির্বাচক,  তাঁর পুত্র স্টুয়ার্ট বিনির নাম সম্ভাব‍্য দলে আনার জন‍্য আলোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচক পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্লাইভ লয়েড কে আউট করা অলরাউন্ডার। সৌরভের থেকে তিনি অনেক বেশি নিরাপদ সন্দেহ নেই।