প্রিয় বোনেরা, সাথীরা, আপনাদের জানা আছে যে আমি আসছি ক্যারিবিয়ান সাগরের এমন একটি দ্বীপরাষ্ট্র থেকে যেখানে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী এবং আগ্রাসী পূঁজিবাদী সাম্রাজ্যের মাত্র কয়েক মাইল দূরে সমাজবাদী বিপ্লবের লাগাতার প্রক্রিয়াকে ধরে রাখা হয়েছে।

আমার সংস্কৃতি ক্যারিবিয়ান সংস্কৃতি যা কৃষ্ণাঙ্গের সঙ্গে স্পেনীয়দের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার আদিবাসিন্দাদের সংস্কৃতি ও চীনা জীবনধারার কিছু উপাদানও। স্পেনীয় বোডেগাগুলিহল সেইসব দোকান যেখান থেকে আমরা খাবার কিনি, চীনার সেইসব ধোপাখানার মালিক যেখানে আমাদের কাপড় ধোলাই হয়, আর তার সঙ্গে সেই কৃষ্ণাঙ্গরা, যারা একেবারেই নিঃস্ব হয়ে এসেছিল এরা সবাই মিলে গড়ে তুলেছে আমাদের জন সংস্কৃতি। এই মিশ্র সংস্কৃতি এদের প্রত্যেকের আদ্যিকালের চিন্তাভাবনার কিছু না কিছু অবদান রয়েছে।  প্রত্যেকের ভিতরে পুরুষতন্ত্রের যে বহমান ধারা রয়েছে মেয়েরা বহু শতাব্দীর ধরে তার ভুক্তভোগী।

কিউবার বিপ্লবের প্রক্রিয়াই এই সমাজের মধ্যে আরেক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে,  যার লক্ষ্য কিউবার মেয়েদের মুক্তি। ১৯৬০ সালের অগাস্টে তৈরি হয়েছিল ফেডারেশন অফ কিউবান উইমেন ; তা কাজ করে সারা দেশ জুড়ে প্রায় পঁয়তাল্লিশ লক্ষ নারীকে সংগঠিত করে, ১৪ বছরের বেশী বয়সের কিউবান মেয়েদের ৯২% ভাগেরও বেশি অংশের প্রতিনিধিত্ব করে তারা।

এই সংগঠনের অন্যতম অগ্রাধিকার মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসা এবং তাদের পরিচালনার কাজের স্তরে উন্নীত করা, যার মধ্যে দিয়ে আমাদের মেয়েরা ক্রমশ আরো অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বর্নিভরতা লাভ করতে পারে।

এই অগ্রগতির একটি হিসাব আমি তথ্য দিয়ে আপনাদের কাছে পেশ করছি।

এই অর্থনীতিতে মোট কর্মরত মানুষের সংখ্যা ৪০,৬৪৩,০৮ যার মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ১০,৮২৪,০৯ যার মানে শতকরা ৩৯.৩%।  কর্মরত মেয়েদের মধ্যে  শিক্ষার হারও বাড়ছেঃ শতকরা ৫৩.১% উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে, আর বিশ্ববিদ্যালয়স্তরে পৌঁছেছে শতকরা ৩৪.২%।

বেশির ভাগ ধরনের কাজের মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়তির দিকে; পরিচালনার স্তরে মোট সংখ্যার ৩৮.৬% মেয়েরা; প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে এহার ৬৬.৬%; প্রশাসনিক পযার্য়ে ৬৯% ভাগই মেয়েরা; পরিষেবায় নিযুক্তদের মধ্যে ৪৫.৪% এবং শ্রমিকদের মধ্যে তাঁদের অংশ ১৬.৭%।

জনস্বাস্থ্য ও সহায়তা প্রকল্পগুলি থেকে যাঁরা উপকৃত হন তাঁদের ৭০.৯৫%-ই নারী; শিক্ষায় আমাদের অংশ ৬৮.৯% ; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পৌঁছয় যাঁদের কাছে তাঁদের ৪৩.৬%।

কৃষিক্ষেত্রে কাজ করছেন ২১৯,৭৭২ মেয়ে যা মোট সংখ্যার ২৫%; সরাসরি উৎপাদনের সাথে যুক্ত রয়েছেন তার মধ্যে ১৩%।  কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিকাশ যাঁরা ঘটান তার মধ্যে শতকরা ৪২% নারী। শহর, মফস্বল এবং পারিবারিক কৃষি মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থানের একটি বড়ো ক্ষেত্র,  এখানে শতকরা ৪৩% মেয়ে। বিপ্লবের ৬০ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ঘোষিত ৫০০,০০০ ‘প্রাঙ্গণে কৃষিকাজ’ প্রসারিত করার কাজ চলছে, গৃহপ্রাঙ্গণ বা দাওয়া বা ছাদের মতো গার্হস্থ্য পরিসরে খাদ্য-উৎপাদনের অভিজ্ঞতাকে উৎসাহিত করে। খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার লক্ষ্যে পুষ্টি ও খাদ্যগ্রহণের সংস্কৃতির উন্নতিসাধনেও নানা মেলা ও উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে যার উউদ্দ্যেশ রন্ধনশিল্পে পরিক্ষানিরীক্ষা ও খাদ্যবৈচিত্র‍্য বাড়ানো।

এফ এম সি চায় গার্হস্থ্য দায়দায়িত্বের সুষ্ঠু সমাধান। তাই তৈরি হয়েছিল দৈনন্দিন দেখভালের কেন্দ্র, কিন্ডারগার্টেন, শিশুগৃহ দাদুঠাকুমাদের জন্য গৃগ, শৈশব ও বার্ধ্যকের সরক্ষণে, কর্মরত মায়েদের অবলম্বন হিসাবে এবং অসুস্থ বয়স্ক মানুষ যাঁদের পক্ষে একা বাড়িতে থাকা সম্ভব নয় তাঁদের পরিষেবা জোগাতে এগুলো করা হয়েছিল। এছাড়াও নানাবিধ গৃহকর্মে সহায়তা,  তৈরি-করা খাদ্যের জোগান দেওয়া এবং কর্মরত মেয়েদের রোজকার কেনাকাটার সুবিধার জন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিতে কাজের ঘন্টায় সামঞ্জস্যবিধান করা ইত্যাদি উপায়ে তাঁদের ভার লাঘব করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কিউবার মেয়েরা দেশের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে থাকেন। ন্যাশানাল এসেম্বলি অফ পিপলস পাওয়ার, যা আমাদের সর্বোচ্চ সংসদ, তার ৫২.৩% সদস্য মেয়ে;৷ রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলেও ৫৩.৩% সদস্যই নারী।

আমাদের ৪ জন মহিলা গভর্নর হয়েছেন, যারা ২৬.৭% মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব করেন, আর ভাইস-গভর্নরদের মধ্যে মহিলা ১২ জন যাঁরা ৮০% মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আমাদের মিউনিসিপ্যাল এসেম্বলিগুলিতে ৮৮ জন মহিলা সভাপতি রয়েছেন, ৫২.৭% মেয়েদের দ্বারা নির্বাচিত আর মেয়েদের মধ্যেও আছেন ৫৮ জন নারী যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন মেয়েদের ৩৫.৪% শতাংশের।

আমরা সক্রিয় থাকি গৃহে ও গৃহের বাইরে অধিকার ও দায়িত্বের সমবন্টনে; অন্যদিকে নিজেরা উদাহরণ স্থাপন করে যাতে আগামী প্রজন্মকে যাতে সমতার শিক্ষা দিতে পারি এবং গণমাধ্যমগুলিতে গান, নাটক ও গণসংযোগের ভাষা বা দৃশ্যকল্পে যাতে পুরুষ প্রধান দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো বেশি করে ভাঙতে পারি সে বিষয়ে সর্বদা সচেষ্ট থাকি।

এক্ষেত্রে নারী ও পরিবারের জন্য স্থাপিত পরামর্শ কেন্দ্রগুলি খুব জরুরী দায়িত্ব পালন করে থাকে। সব নগরনিগমগুলিতে এধরনের কেন্দ্র রয়েছে এবং তারা কাজ করে যেসব বিশেষজ্ঞরা নানাধরনের বিজ্ঞান চর্চায় যুক্ত রয়েছেন তাদের সাহায্যে; মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো এবং সমাজে যাদের প্রয়োজন তাদের সহায়তা করাই এগুলির কাজ। এলাকার মানুষের প্রয়োজন বুঝে মেয়েদের বিভিন্ন বৃত্তি প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও এই কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে চলে। এবছর এরকম ৮৪১ টি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল যার অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন ৫০,০০০ -এর বেশি তরুণী।

আমাদের কাছে লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার মোকাবিলা করতে এবং অবসান ঘটাতে আমরা কাজ করে চলেছি; এলাকায় এলাকায় পরামর্শকেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ; বর্তমানে এমন ১৫৬ টি কেন্দ্র সারাদেশে রয়েছে।  হোসে মার্তি, যিনি আৃাদের বিপ্লবের দীক্ষাগুরু, বলেছিলেনঃ কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে আঘাত করবে না, এমনকি গোলাপের পাপড়ি দিয়েও নয়। আমরা আমাদের সন্তানদের সেই শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টাই করি।

আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান এখনো বাকি, আমাদের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।  তার মধ্যে একটি হলো আমাদের পারিবারিক আইন দেশের ৬৬.৮৭% মানুষের সম্মতি নিয়ে দেশের সম্প্রতি যা গৃহীত হল। একে কার্যকরী করার জন্য দেশের আইনি ব্যবস্থাকে আরো মজবুত করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের জন্ম হারের স্থিতিশীলতাকে রক্ষা ও তাতে উৎসাহ জোগানো দেশে বার্ধ্যকের বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে খুবই জরুরি।  এছাড়াও এমন অনকে কিছু আছে যা কঠোর প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছে বলেই সর্তক দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে তা আমাদের হাতছাড়া হয়ে না যায়,  বরং দিনে দিনে আরো উন্নততর পযার্য়ে যায়। কারণ, সাথীরা, কোনোকিছুই নিখুঁত হতে পারে না এবং আমাদের সচেষ্ট থাকতেই হবে যাতে আমাদের কন্যারা এবং নাতনিরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সুবিচারসম্পন্ন এক দুনিয়ার বাসিন্দা হতে পারে। সেখানে মেয়েদের পূর্ণ সমানাধিকার থাকা আবশ্যিক, তাদের উপযুক্ত সম্মান ও আদর থাকাটা জরুরী,  কেন না আমরাই সেই কারখানা যার পরিসরে জীবন সৃষ্টি হয়।

আমাদের সর্বাধিনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৬৫ সালে বলেছিলেন, ‘ …. মেয়েদের সমরশক্তিকে অতিতে খাটোচোখে হয়েছে,  বাস্তবক্ষেত্রে তার সঠিক পরিমাপ করা হয়নি; বিপ্লবের প্রত্যক্ষ শিক্ষা থেকে আমরা ক্রমেই আরো বুঝতে পারছি মেয়েদের কাজের ক্ষেত্রে যুক্ত করার সামাজিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব কতখানি’।

কথাটি খুবই সত্যি যে কোনো উদ্যোগকে স্থায়ী হতে হয়, তার ক্রমবিকাশ যদি ঘটাতে হয় তাহলে মেয়েদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অনিবার্য, কারণ আমরা যে কেবল আমাদের অধিকার,  আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সত্তাকে রক্ষা করতে চাই তাই নয়, আমাদের গর্ভজাত প্রজন্মের জন্য এগুলিকে সুনিশ্চিত করতে আমরা প্রাণপণ লড়াইয়ে নিযুক্ত আর সেটাই আমাদের জোগায় অতিরিক্ত সংগ্রামী শক্তি।

এগিয়ে চলো সাথী, দুনিয়াকে মানুষের বাসযোগ্য করার স্বার্থে আর এক নতুন দিনের অভিমুখে, চলো অবিরল বিজয়ের পথে, ‘ হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিয়েম্প্রে’!

থিরুবন্তপুরম,৬ জানুয়ারি, ২০২৩

[ ডঃ আলেইদা গ্যেভারা বিপ্লবী চে গ্যেভারার কন্যা। তিনি কিউবার একজন প্রখ্যাত শিশু-চিকিৎসক। কিউবার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সেখানকার সমাজবাদী ব্যবস্থার একজন প্রধান প্রবক্তা হিসাবে কিউবার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী অপপ্রচারের জবাব দিতে তিনি ভারতে ও অন্যান্য দেশে স্বদেশের দূত হয়ে ভ্রমণ করছেন। এই ভাষণটি তিনি দিয়েছিলেন সারাভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির তেরোতম সর্বভারতীয় সন্মেলনকে উদ্দেশ্য করে। সেই ভাষণ এখানে বাংলায় তর্জমা করে দেওয়া হলো। ‘হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিয়েম্প্রে’ এই স্লোগানটি চে’র মুখ থেকেই বিপ্লবের বার্তা নিয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়েছিল। ]