ঝলমলে আলোর শহরে হঠাৎ সাদা কাপড়ের বৈধব্য! কোটি টাকার কার্নিভালের রোশনাইয়ের মাঝেও খানিক আঁধার ইরেজ না করতে পারলে ‘পাবলিক পারসেপশন’ কন্ট্রোল করবে কি করে! এ তো গুন্ডা বা পুলিশ নয়, যে তখতের জোরেই কন্ট্রোলড্ থাকবে! অগত্যা, সাদা কাপড়ে ঢেকে ফেলা হলো বাংলার মাটিতে সবথেকে বড়ো দুর্নীতির ভিক্টিমদের। 


হ্যাঁ, সেই ভিক্টিমরা যারা পাস করেছে সরকারি চাকরির পরীক্ষা, যারা স্বপ্ন দেখেছে এই সমাজটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার, যারা দিনরাত এক করে পরিশ্রম করেছে নিজেদের স্বপ্নটাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য, যারা গত এগারোটা বছর ধরে স্রেফ বেইমানির শিকার হয়ে গেছে ক্রমাগত, যারা মেরিটোরিয়াস হয়েও হার মেনেছে এ রাজ্যের সুপার মেরিটোরিয়াস চোরদের কাছে, যারা চোখের সামনে নিজেদের ভবিষ্যত তছনছ করে দেওয়া নোটের বান্ডিলগুলো দেখেছে টিভির পর্দায়, যারা আজ রাস্তায় বসে পোস্টার নয়, স্কুলে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে প্রজন্ম গড়তে পারতো, তারা! সেই তারাই গত প্রায় ৬০০ দিন ধরে বসে আছে শহীদ মিনারের আশপাশে একাধিক জায়গায়। দাবি একটাই- নিয়োগ চাই, স্বচ্ছ নিয়োগ চাই।


সেই তাঁদেরই মুখগুলোকে ঢেকে দিতে সাদা কাপড়ের পাঁচিল! প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি, এসএলএসটি, এসএসসি, এমএসসি- নানা নামের দুর্নীতির আখড়া! হ্যাঁ গোটা শিক্ষা দপ্তরটাই আপাতত জেলের ওপারে। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা নিচ্ছেন জেলযাপনের, লাইন দিয়ে ক্লাসে যোগ দিচ্ছে শাগরেদরা। একদম প্রান্তিক এলাকা থেকে শহুরে পাড়া, শিক্ষায় কাটমানির শিল্পকে পিকাসোর ক্যানভাসের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে তৃণমূলের সরকার। কোটি কোটি টাকার টার্নওভার। এত্তো টাকা, এত্তো সম্পত্তি, এত্তো বৈভব ঢাকার মতো কাপড় কোথায় ম্যাডাম?
মন্ত্রীদের, বিধায়কদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে রাজ্যের প্রতিটা প্রান্তে বেকার সমস্যা। লুটেপুটে খাওয়ার তাড়নায় চাকরি হয়েছে সাদা খাতা জমা দিয়েও! মাস্টারশিট চুরি করেছে খোদ পর্ষদ সভাপতি। লিস্টের পর লিস্ট গেছে এলাকার ব্লক সভাপতির চিঠির সাথে মন্ত্রকের অ্যান্টি চেম্বারে! সেমিফাইনাল লিস্ট প্রস্তুত হয়েছে কোনো না কোনো বাগানবাড়িতে৷ আর ফাইনাল? পঁচাত্তর শতাংশের কালীঘাট!
অনুপ্রেরণার ছড়াছড়িতে লাটে উঠেছে রাজ্যের সার্বিক নিয়োগ ব্যবস্থাটাই। জানা যাচ্ছে শুধু প্রাইমারিতেই ৫৮০০০ বেআইনি নিয়োগ! যা সম্পদ চোখের সামনে তবে তো তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। অতলান্ত গভীর এই দুর্নীতির সূত্র। সেই গভীরতা ঢাকতেই কখনো সাদা কাপড়ের আড়াল, কখনো দিল্লীর দ্রুত ফ্লাইট! কখনো তৃণমূলের এমপি’র আনাগোনা বিজেপি নেতাদের বাড়ি!


অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে পরীক্ষায় পাস করা ক্যান্ডিডেটরা! পরীক্ষায় পাস করে গেছে বছর আটেক আগে। চাকরি আজো অধরা। বাড়িঘর ছেড়ে তাই রাস্তাই ঠিকানা।লড়াইয়ের রাস্তাই ঠিকানা! সেই ঠিকানার লক্ষ্য নির্দিষ্ট – চাকরিচোর সরকারটাকে জেলের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া আর নিজেদের স্কুলের ঠিকানাটা জেনে নেওয়া। যেন লাখো স্বপ্নের বধ্যভূমিতে ফের রক্তগোলাপের আভা! 
সেই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়েই সবাই শপথ নিচ্ছে। যারা এই বাংলার ভবিষ্যতের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে, যারা নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়তে তছনছ করেছে বাংলার মানবসম্পদ, যারা নির্লজ্জের মতো আজো স্রেফ কয়েকটা টাকার জন্য নিজেদের হাতে ভেঙে ফেলছে  নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের শিরদাঁড়াটুকু, যারা নীরবতার অছিলায় ধ্বংস করে ফেলছে গণতন্ত্রের সন্ধানকে, যারা তদন্তটুকু স্লো ডাউন করার চেষ্টা চালাচ্ছে ক্রমাগত, তাদের কারোর নিস্তার নেই।


আজ বেঁচে থাকলে সত্যজিত রায় নিজের ডাকনামটা লজ্জায় বদলের নিতেন কিনা জানি না, তবে এই চোর, ভাঁওতাবাজ সরকারটাকে বদলাতেই হবে! সাদা কাপড়ের ওপর জ্বলজ্বল করছে স্লোগান- চোর ধরো, জেল ভরো, স্বচ্ছ নিয়োগ চালু করো।