“শিক্ষা আনে চেতনা ,আর চেতনাই আনে বিপ্লব “–সমাজকে শিক্ষিত করবার এই মহান ব্রত  যুগ -যুগান্তর ধরে পালন করে আসছেন আমাদের শিক্ষকেরা।আমরা আমাদের শিক্ষকদের সম্মান করি শ্রদ্ধা করি।আজ এই বাংলার শিক্ষক সমাজের প্রতি এক অশ্রদ্ধার বাতাবরন তৈরি হয়েছে।বিশেষত ২০১১সালের পরবর্তী সময় এই রাজ্যের সরকারের সময় যে সমস্ত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ থেকে এবং আদালতে চলতে থাকা সওয়াল জবাব থেকে শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কে নিত্য নতুন যেসব তথ্য আসছে তা থেকে এ রাজ্যের শিক্ষকদের সম্পর্কে(২০১১পরবর্তী সময়ে নিয়োগ পাওয়া)এক অশ্রদ্ধার মনোভাব দেখা যাচ্ছে।      যে শিক্ষকদের দায়িত্ব শিক্ষকদের সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত করে একজন  সহনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।সেই শিক্ষকেরা ই নিজেদের চাকরি পেয়েছেন ভুয়ো নিয়োগের মধ্য দিয়ে,চাকরির পরীক্ষায় পাশ না করেও ঘুষের বিনিময়ে অথবা তৃণমূল দলের সঙ্গে সম্পর্কের  কারনে প্রকৃত পাশ করা  শিক্ষক পদপ্রার্থীদের বঞ্চিত করে নিজেদের চাকরি নিশ্চিত করেছে।এই ভুয়ো নিয়োগ পাওয়ার শিক্ষক এবং তাদের নিয়োগ দেওয়া তৃণমূল সরকারের কারনে শিক্ষকতার মতো এক সম্মানজনক পেশা আজ এ রাজ্যের মানুষের কাছে অসম্মানের বিষয় হয়ে উঠছে।তারা বলছেন যে নিজেরাই  অকৃতকার্য হয়ে পিছনের দরজা দিয়ে চাকরি পেয়েছে তারা কী শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন বাংলার ছাত্র সমাজকে।       

কিন্ত চিরদিন কী বাংলার শিক্ষক সমাজের এই ঘুষখাইয়ে চাকরি পাওয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হতো নাকি মানুষ গড়ার প্রকৃত এই কারিগরেরা সমাজের সামনে অন্য কোনও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন।ঘুষের বিনিময়ে চাকরি পাওয়া এটাই  বাংলার শিক্ষক সমাজের ইতিহাস  নয় নিজেদের হক আদায়ের জন্য জানকবুল লড়াই সংগ্রাম সংগঠিত করাটাই বাংলার শিক্ষকদের প্রকৃত ইতিহাস।      

১৯৫৪ সালে দোদর্ন্ডপ্রতাপ কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের এমনই এক উজ্জ্বল বীরগাথা রচনা করেছিলেন সত্যপ্রিয় রায় ,অনীলা দেবীর নেতৃত্বে বাংলার শিক্ষক সমাজ।আর এই আন্দোলনে তাদের সঙ্গে ছিলেন সেই সময়কার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ,ফরওয়ার্ড ব্লক ,এস ইউ সি প্রভৃতি রাজনৈতিক দল।যে সমস্ত প্রধান দাবিতে সেদিন নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি আন্দোলনে নেমেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী ৩৫টাকা মহার্ঘ্য ভাতা দিতে হবে এবং বেতন ৭৫টাকা ১৮০টা করতে হবে।সেই সময় একজন মাস্টার মশাইয়ের বেতন মহাকরণের একজন পিওনের থেকেও কম ছিল। 
সরকার শিক্ষকদের দাবি না মানায় ১৯৫৪-র ১০ই ফেব্রুয়ারি তারা আন্দোলনে নামেন। ওইদিন গোটা বাংলা জুড়ে মাধ্যমিক শিক্ষকদের ঐতিহাসিক ধর্মঘট শুরু হয় আর শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিকে নিয়ে তৈরি হওয়ার সর্বদলীয় কমিটি ১২ই ফেব্রুয়ারি সারা বাংলা হরতালের ডাক দেয়।


শিক্ষক আন্দোলন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ এই আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। এ রাজ্যের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক নেতা  সত্যপ্রিয় রায় সেদিন এক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছিলেন”শিক্ষকই হোন আর শ্রমজীবীই হোন  সর্বস্তরে বঞ্চিত মানুষের বাঁচার লড়াই একটি সূত্রে গাঁথা”। সরকার এই আন্দোলন দমনের জন্য চিরাচরিত দমন পীড়নের রাস্তায় হাটে।শিক্ষক আন্দোলন দমন করতে গণ-আন্দোলনের অন্তত চারশো নেতা ও কর্মীকে বিধান রায়ের পুলিশ গ্রেপ্তার করে।কমরেড জ্যোতি বসুকে গ্রেপ্তার করে সরকার শিক্ষা আন্দোলনের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। গ্রেপ্তার এড়িয়ে গণ-আন্দোলনের কর্মীদের উপর ব্যাপক আক্রমণের ঘটনা বিধানসভায় তোলার জন্য সাতদিন বিধানসভাতেই থেকে নজির গড়েন জ্যোতি বসু। পরে উদ্দেশ্য সফল হলে পার্টির সিদ্ধান্তে বেরিয়ে আসেন। আবার গ্রেপ্তার হন। দিন সাতেক বিনা বিচারে বন্দী থাকেন।  দমন পীড়ন গ্রেফতার কোনও ব্যবস্থাই শিক্ষকদের এই আন্দোলন কে ধ্বংস করতে পারেনি।১৬ই ফেব্রুয়ারি১৯৫৪ শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ বিধানসভা অভিযানের উপর পুলিশ নারকিয় হামলা চালায় ।প্রথমে গ্রেফতার করা হয় মিছিলের  সামনের সারিতে থাকা নেতৃত্ব কে।তারপর মিছিলের উপর চলে লাঠি গুলি।পুলিশী এই হামলার মুখে ও অহিংস এই মিছিল থেকে তাঁরা স্লোগান তুলেছিলেন”পুলিশ তুমি যতই মারো,মাইনে তোমার একশো বারো।বর্বর পুলিশের গুলিচালনায় সেদিন শহীদ হন ৬হন আহত হন ২০০জনের মতো ।পরের দিনও গোটা কলকাতা রনক্ষেত্রে পরিনত হয়।শিক্ষকদের এই আন্দোলন ২১শে ফেব্রুয়ারি শেষ হয় বিধান চন্দ্র রায় শিক্ষকদের দাবি দাওয়ার অনেক গুলি মেনে নিলে।মুক্তি দেওয়া হয় সমস্ত শিক্ষকদের এবং সত্যাগ্রহীদের।    জেল ,চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভবনা ,একটানা সত্যাগ্রহের কারনে মৃত্যুর সম্ভবনা ,মুখোমুখি পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে লাঠি গুলির সম্মুখীন হওয়া সমস্ত কিছুর মোকাবিলা করেই সেদিন আন্দোলনে নেমেছিলেন বাংলার শিক্ষক সমাজ।আর আদায় করে নিয়েছিলেন নিজেদের হক।আর সেদিন শিক্ষক সমাজের এই ঐতিহাসিক আন্দোলনে তাদের পাশে  ছিল কমিউনিস্ট পার্টি ।