লোকসভা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের নির্ধারিত সাত দফার মধ‍্যে দু  দফার ভোট গ্রহণ শেষ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো পশ্চিমবঙ্গের গর্বের সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বাম ও গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রতিনিধি প্রার্থীদের বক্তব্য ছাড়া আর কোথাও উঠে আসছে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রী নিয়োগ দুর্নীতির কারণে পঁচিশহাজারের বেশি শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মীরা চাকরি হারানোর পর দায়িত্ব অস্বীকার করে সব দোষ বিরোধী পক্ষ ও আদালতের ওপর চাপিয়ে প্রকাশ‍্যে দুর্নীতি করে চাকরি পাওয়া ব‍্যক্তিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। অন‍্যদিকে   আমরা ২০১৯ এর আগে কখনও ভাবিনি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে সম্প্রচারিত  টেলিভিশন চ‍্যানেলের সঞ্চালক সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে উসকানি দেবেন বা দাঙ্গার পক্ষে ভিন্ন সম্প্রদায়ের নারীর সম্মানহানির পক্ষে যুক্তি দেওয়া রাজনৈতিক নেতাও এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দেবেন কারণ তাঁদেরও নিজেদের “মতপ্রকাশ করার স্বাধীনতা রয়েছে “! অবশ‍্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের উদাহরণ ইদানীং প্রায় প্রতিদিনই তুলে ধরছেন। পশ্চিমবঙ্গের ভক্তকুলকেও তিনি বঞ্চিত করেন নি। বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রতিক্রিয়ায়  উল্লাস দেখে অনেকটা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রয়াত এক অভিনেতা সাংসদের ছেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার বক্তৃতার শেষে জমে ওঠা হাততালির স্মৃতি ভেসে উঠছিল।

সবটাই একুশ শতকের সামাজিক অবক্ষয়ের জ্বলন্ত প্রমাণ। নগর পুড়িলে দেবালয় এড়ায় না,তাই  ভারত জুড়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির  ঢেউ পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে এসে পড়বে না – এমনটা ঘটেনি। আপাতত কৃষিপণ‍্যের ন‍্যায‍্য মূল‍্যের জন‍্য কৃষক আন্দোলন,দ্রব‍্যমূল‍্য বৃদ্ধি,তীব্র বেকার সমস‍্যা নিয়ে বিরোধীপক্ষ বেশি হৈ চৈ বাধানোর ফলে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার পরেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি একটু ব‍্যাকফুটে, সি এ এ নিয়েও পশ্চিমবঙ্গ তেমন সরগরম হয়নি কিন্তু সুযোগ পেলেই সর্বভারতীয় নেতৃত্বের সুরেই বঙ্গভাষী বিজেপির নেতা নেত্রীরা সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা দিয়ে থাকেন সন্দেশখালির ঘটনাকেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তুরুপের তাস বানাতে তাঁরা দ্বিধা করেননি। সেখানে বিজেপি নেতাদের মুখে মহিলাদের সম্মানহানির ঘটানায় গেরুয়া নেতাদের মুখে শেখ শাহজাহানের নাম ঘুরে ফিরে এলেও শিবু হাজরা উত্তম সর্দারদের নাম আর  সেভাবে শোনা যাচ্ছেনা। অথচ শাহজাহানের এই দুই শাগরেদও গণধর্ষণের আসামী। তারাও জেলে বন্দী। সবটাই প্রবল সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব। নয়ত পার্ক স্ট্রীট কামদুনির ধর্ষণের বিচারের রায়ের পাশাপাশি   মঞ্চ বেঁধে কাঠুরিয়া থেকে হাথরস উন্নাওয়ের ধর্ষকদের পক্ষে সাফাই গাওয়া হোত না।

তবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে পা রাখার জায়গা করে দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতির রাজনীতিকরণের কৃতিত্ব অবশ্যই মমতা ব‍্যানার্জীর। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে ২০১১ সালে বিধানসভা  নির্বাচন পর্যন্ত  তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের  সাফল‍্যের পিছনে সারদা রোজভ‍্যালি সহ চিটফাণ্ড সংস্থার মানুষ ঠকানো টাকার মূলধন হিসাবে ভূমিকার কথা এখন সবাই জানেন। চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকা নিজের দলের নেতা মন্ত্রীদের হয়ে সাফাই গাইতে শোনা যায় মমতা ব‍্যানার্জীকে। নারদা সংবাদ সংস্থার ভিডিওতে ববি হাকিম,শোভন চ‍্যাটার্জী,সৌগত রায়, কাকলি ঘোষদস্তিদার,মদন মিত্র,শুভেন্দু অধিকারীদের টাকা নেওয়ার ছবি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরেও একইভাবে তাঁদের হয়ে প্রকাশ‍্যে সওয়াল করেন মমতা ব‍্যানার্জী। নারদা ভিডিও বিতর্কে যুক্ত নেতানেত্রীরা প্রায় সবাই  ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় মমতা ব‍্যানার্জী ও তৃণমূল কংগ্রেসের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। ২০২১ সালের বিধানসভা  নির্বাচনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার বামপন্থীরা একটিও আসন না পাওয়ায় সংখ‍্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে তৃতীয় বারের জন‍্য পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করা তৃণমূল কংগ্রেস যেমন ধরেই নেয় দুর্নীতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তেমন মাথা ঘামাতে চায় না। সম্ভবত সেকারণেই তারা ২০২০ সালে চিটফাণ্ড দুর্নীতিতে জেলখাটা সাংবাদিক ও সাংসদ  কুনাল ঘোষকে ফিরিয়ে এনে দলের মুখপাত্র   তেমনি ২০১৯ সালের লোকসভা  নির্বাচনে প্রথমবারের জন‍্য ১৮টি আসনে জয়ী হওয়া বিজেপি ২০২১ সালে বিধানসভায়  ৭৮টি আসনে জয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে উঠে আসায় হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি ধরে নেয় পশ্চিমবঙ্গের মত ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার চিন্তার চর্চার পীঠস্থানেও ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির আধিপত্য বিস্তার সম্ভব। তৃণমূল কংগ্রেস থেকে চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি নারদাকাণ্ডে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা ও মমতা ব‍্যানার্জীর মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী   শুভেন্দু  অধিকারী বিধানসভা নির্বাচনের কয়েকমাস আগে বিজেপিতে নাম লিখিয়ে নন্দীগ্রামে স্বয়ং মমতা ব‍্যানার্জীকে ভোটে হারিয়ে দিয়ে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হিসাবে উঠে আসেন। এর পরে দেখা যায় শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক  আক্রমণ করার সময় তৃণমূল কংগ্রেস  নারদা স্টিং অপারেশনের ভিডিওতে তাঁর হাত পেতে টাকা নেওয়ার দৃশ‍্যের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে এবং বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের শাসন কালে ঘটে যাওয়া  দুর্নীতি প্রসঙ্গে রাজনৈতিক আক্রমণ করলেও সেই দুর্নীতিতে শুভেন্দু অধিকারীর যুক্ত থাকা নিয়ে নীরব থাকছে। ২০১৯ সাল থেকে সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিল এস এস সি পরীক্ষায় অনিয়মের কারণে যোগ‍্যতা থাকা সত্ত্বেও নিয়োগপত্র না পাওয়া চাকরি প্রার্থীদের আন্দোলন এবং তাঁদের করা মামলা।  ২০২২ সালের প্রথম দিকে হাইকোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্ত এগিয়ে যাওয়ার  পরেই  স্পষ্ট হয়ে যায় টাকার বিনিময়ে যোগ‍্যতা নির্ণয়ের পরীক্ষায় পিছিয়ে থাকা প্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়েছে। অর্থাৎ অনিয়ম নয় দুর্নীতি হয়েছে। ২২ শে জুলাই পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন  শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ‍্যাটার্জী নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার হওয়ার পর বোঝা যায় মমতা ব‍্যানার্জীর জ্ঞাতসারেই এই ঘটনা ঘটেছে। কারণ শিক্ষা দপ্তর থেকে সরিয়ে দিয়ে তখন পার্থ চ‍্যাটার্জী শিল্প দপ্তরের দায়িত্বে আনা হয়েছিল এবং গ্রেফতার হওয়ার সময় তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব। একে একে শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব‍্যক্তিরা যথা মানিক ভট্টাচার্য,শান্তিপ্রসাদ সিনহা কল‍্যাণময় গাঙ্গুলি সুবীরেশ ভট্টাচার্যরা গ্রেফতার হওয়ার পরে বোঝা গেল পুরো প্রক্রিয়াই দুর্নীতির পাঁকে ডোবা। আদালতের নির্দেশে এজেন্সির তদন্ত যত গতি পেয়েছে ততই বোঝা গেছে এই নিয়োগ দুর্নীতির আর্থিক সুবিধা সুযোগ পেয়েছেন কালিঘাটের  ব‍্যানার্জী পরিবার। কিন্তু মোদি দিদির আশ্চর্য বোঝাপড়ায় অভিষেক ব‍্যানার্জী অবধি হাত পৌঁছাচ্ছে না তদন্তকারী সংস্থার। তেমনি নিয়োগ দুর্নীতিতে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রীসভার সদস্য থাকাকালীন তদন্তকারী সংস্থার পক্ষ থেকে  বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ  বিজেপির পোস্টারবয় শুভেন্দু অধিকারীর  নামও উচ্চারিত হচ্ছে না কোনও রহস‍্যজনক কারণে।

এটা ঘটনা,সামাজিক মূল‍্যবোধের অবক্ষয়ের চেহারা সবচেয়ে কদর্যভাবে উন্মোচিত হয়েছে নিয়োগ দুর্নীতির কারণে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে ২০১৬ সালে এস এস সি প‍্যানেল বাতিল হওয়ায় ২৫৭৫৩ জন চাকরি হারানোর পর। একশ্রেণীর অযোগ্য কর্মপ্রার্থী টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন স্কুলে চাকরি পেয়েছেন,  এই অনৈতিক ঘটনা সামনে আসে। এই টাকার লেনদেনের সঙ্গে শাসকদলের প্রত‍্যক্ষ যোগাযোগও স্পষ্ট। সাধারণ মানুষকে এভাবে দুর্নীতিতে সামিল করার রাজনৈতিক উদ‍্যোগ যেমন পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে বিরল। তেমনি স্কুল সার্ভিস কমিশনের কর্তাব‍্যক্তিদের অনৈতিক নিয়োগে অংশগ্রহণও নজিরবিহীন। যোগ‍্য শিক্ষকদের চাকরি যাওয়ার ফলে আরও একটি সত‍্য সামনে এসেছে যে  প্রমাণ সহ যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা মামলা চলাকালীন আদালতে পেশ করতে পারেনি এস এস সি। কেননা টাকার বিনিময়ে সফল প্রার্থীদের তালিকায় অদলবদল করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রী এই অনৈতিক বিষয়টিকেই আড়াল করছেন তাঁর বক্তব্যে কার্যত বিচার ব‍্যবস্থাকেই অপরাধীদের ভাষায় আক্রমণ করে।