স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার।সেই সময়েই দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ছুঁয়ে ফেলল ১০৩ বছর।দেশের মানুষকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। বারবার সংগ্রামী চেতনাকে বিভ্রান্ত করতে হাজির হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা — নানা রূপে। আর কমিউনিস্ট পার্টি সেই প্রসঙ্গে কী বলেছিল?‘‘শোষণের বন্ধনে আবদ্ধ ৯৮ শতাংশ মানুষের সাম্প্রদায়িক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই।’’ সিপিআই তাদের ইশ্‌তেহারে ব্যাখ্যা করল। ১৯২৬-এ, কংগ্রেসের গুয়াহাটি অধিবেসনে। কী করতে হবে তাহলে? সিপিআই অধিবেশনে কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানালো,‘‘তাঁদের অর্থনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে তাঁদের সাহায্য করুন, অভিন্ন শত্রু শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহসী নেতৃত্ব দিন, সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধানোর প্ররোচনামূলক নীতির ভিত্তিই ধসে যাবে। এটা ঠিক যে রাতারাতি তা করা যাবে না।’’কিন্তু এটা কেন করতে হবে?সিপিআই কংগ্রেসের গুয়াহাটি অধিবেসনে পেশ করা ইশ্‌তেহারে আরও লিখল,‘‘ কিন্তু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জীবনীশক্তি ক্ষয় করা সাম্প্রদায়িকতার দুষ্টক্ষতের মোকাবিলার অন্য কোনো উপায় নেই।’’দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি কমিউনিস্টরাই সর্বপ্রথম উত্থাপন করেছিলেন।

সিপিআই-র বয়স তখন এক। জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদের সেই  অধিবেশনে (১৯২১) মওলানা হসরত মোহানি ও স্বামী কুমারানন্দ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি পেশ করেন। সেই প্রস্তাব এবং অধিবেশনে বন্টিত প্রচারপত্রে ভারতের জনগণের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলি উত্থাপিত হয়। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমবেত সংগ্রামের কথাই উচ্চারিত হয় সেই প্রস্তাবে। কমিউনিস্টরা গয়া কংগ্রেসেও একই দাবি উত্থাপন করে। একদিকে শ্রমজীবী মানুষের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সাম্রাজ্যবাদের শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার সংগ্রামকে তাঁরা একসূত্রেই গ্রথিত করেছিলেন। যদিও জাতীয় কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজের দাবি প্রস্তাব হিসাবে প্রথম গ্রহণ করে ১৯২৯-এ, পুনা অধিবেশনে।ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের দাবি? তাও সোচ্চারে, সংগঠিত ভাবে উত্থাপন করার কৃতিত্ব কমিউনিস্টদেরই।১৯২০-তে সিপিআই গঠিত হল। তার পরপরই দেশ দাঙ্গার মুখোমুখি হল। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২০-র পার্টির তরফে মানবেন্দ্রনাথ রায় লিখেছিলেন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের একমাত্র প্রতিষেধক হল সমস্ত জাত-সম্প্রদায়ের শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণি ঐক্য। অর্থাৎ সৃষ্টির গোড়াতেই কমিউনিস্ট পার্টি বুঝিয়ে দিয়েছিল তাদের পথ। পূর্ণ স্বরাজ চাই। দরকার শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য। শত্রু তাই সাম্প্রদায়িকতা।

সীতারাম ইয়েচুরির কথায়,‘‘কমিউনিস্টদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র রক্ষা শুধুমাত্র ভারতের সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয় সংবিধানকে রক্ষার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সমতার সাংবিধানিক নিশ্চয়তাকে বাস্তবায়নের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এসবই গণতন্ত্রের মর্মবস্তু। কিন্তু এই সঙ্গেই সবচেয়ে শোষিত শ্রেণিগুলির শ্রেণি ঐক্য জোরদার করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে যা জরুরী। সাম্প্রদায়িকতা এই ঐক্যকেই বিপর্যস্ত করে, ভারতের ইতিহাসকে পশ্চাদমুখী, পশ্চাদপদতার অভিমুখে টেনে নিয়ে যায়।’’তাই ১৯২৬-এ কংগ্রেসের অধিবেসনে কমিউনিস্ট পার্টি স্পষ্ট করল তাদের অবস্থান।১৯২১ থেকে কংগ্রেসের প্রতিটি অধিবেসনে সিপিআই ইশ্‌তেহার পেশ করত। ১৯২৬-এও তাই করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল,‘‘গত কয়েক বছর দেশে যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত চলছে তাতে অনেকে নিশ্চয়ই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। সত্যই তা হতাশাজনক ঘটনা। কিন্তু এখানে জনগণের পার্টি সমাধান খুঁজে পাবে। উচ্চবিত্ত শ্রেণি অধিকার ও সুযোগসুবিধার জন্য লড়াই করছে, তখন উভয় সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিন্নতা রয়েছে। তা হল শোষণ।’’কেমন শোষণ? সিপিআই লিখল,‘‘হিন্দু ও মুসলিম শ্রমিকরা একই কারখানায় ঘাম ঝরায়। হিন্দু ও মুসলিম কৃষক পাশাপাশি জমিতে শ্রম দেয়, জমিদার, মহাজন, সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা তা চুরি করে। মুসলিম মালিক মুসলিম শ্রমিককে বেশি মজুরি দেয় না। হিন্দু জমিদার মুসলিম কৃষকের তুলনায় হিন্দু কৃষকের কাছ থেকে কম খাজনা নেয় না।’’এই অধিবেসনের কিছু মাস আগে, ১৯২৫-র বিজয়াদশমীর দিন নাগপুরে একটি ঘটনা ঘটে গেছে। যা দেশের পরবর্তী ইতিহাসকে নানাভাবে ক্লেদাক্ত করবে। তৈরি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ(আরএসএস)।

১৯২৫-র ৯ই আগস্ট রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকুল্লা খান, চন্দ্রশেখর আজাদ, রাজেন্দ্র লাহিড়ী, শচীন্দ্র বক্‌সী, কেশব চক্রবর্তী, রোশন সিংরা যখন কাকোরির কাছে ট্রেনে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বার্থে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে সরকারী টাকা কেড়ে নিচ্ছেন, ঠিক তখন হেডগেওয়ার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই থেকে দূরে সরে একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের গোড়াপত্তনের পরিকল্পনা করছেন।তাদের লক্ষ্য — হিন্দু রাষ্ট্র। কিন্তু সংগঠনের সামনে রাষ্ট্রিয় শব্দটি কেন? কেন হিন্দু নয়? এর জবাব হেডগেওয়ার এবং তাঁর শিষ্যরা বারবার দিয়েছেন। তাঁদের মতে — রাষ্ট্র এবং ‘হিন্দুত্ব’ একই! ফলে সংগঠনের নামের গোড়ায় ‘হিন্দু’ শব্দটির দরকার নেই। কমিউনিস্ট পার্টি যখন বলছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, ব্রিটিশদের এবং অন্য সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করে সঙ্ঘ বলছে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’র কথা। তাই গঠিত হওয়ার সময়কাল থেকেই কমিউনিস্ট পার্টিকে সঙ্ঘ এবং তার দর্শনের বিরুদ্ধে আদর্শের লড়াই চালাতে হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার ৭৬ বছরে এসে আমরা দেখছি একটি নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা এক মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন যে, আরএসএস আগে ভালো ছিল। তিনি বিশ্বাস করেন আজও আরএসএস ভালো আছে। মুখ্যমন্ত্রীর নাম মমতা ব্যানার্জি। গঠিত হওয়ার ১০৩ বছর পরে তাই কমিউনিস্টদের লড়তে হচ্ছে সঙ্ঘের বিরুদ্ধে এবং তাঁর মত ‘ধর্মনিরপেক্ষ সেজে থাকা’ সঙ্ঘের সহযোগীদের বিরুদ্ধেও। লড়াই বহুমাত্রিক হয়েছে।