স্বাধীন দেশে আন্দোলনের অধিকার প্রত্যেকটি মানুষের আছে। রাষ্ট্র কখনো সেই আন্দোলনের অধিকার নাগরিকের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে না ।রাষ্ট্র যদি নাগরিকের কাছ থেকে আন্দোলনের অধিকার কেড়ে নেয় ,তাহলে বুঝতে হবে, সেই রাষ্ট্রে আদৌ কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই।


ভারতীয় সংবিধানে যে জরুরি অবস্থার বিধিবিধান রয়েছে, সাতের দশকে যে জরুরি অবস্থার প্রয়োগ আমরা দেখেছিলাম, অঘোষিতভাবে সেই জরুরি অবস্থা এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নগ্নভাবে শাসক দেখাতে শুরু করেছে।আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ছাত্র আনিস খানের উপর গতকাল রাতে যে পুলিশের বীভৎসতা ঘটে গেল, তাতে এই প্রশ্ন আমাদের সামনে সবার আগে উঠে আসে যে ,উত্তরপ্রদেশ ,গুজরাটের মতোই কি আমাদের এই রাজ্যে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে ?
বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন থেকে শুরু করে ছাত্র সমাজের নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ,যারা রাজনৈতিক দর্শনের বাম এবং গণতান্ত্রিক শিবিরের কাছেকাছি, দীর্ঘদিন ধরে তারা আন্দোলন করে চলছে। সেই আন্দোলনের প্রতি শাসক কখনো এতোটুকু নি মানবিক আচরণ আজ পর্যন্ত দেখায়নি। শাসকের কাছ থেকে মানবিক আচরণ নাগরিক সমাজ সব সময় আশা করেনা। কারন, শাসক চলে তার নিজের শ্রেণী স্বার্থে। তাই বলে শাসক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সুসভ্য গুন্ডা বাহিনী ,পুলিশ দিয়ে অত্যাচার করবে, আর আন্দোলনরত ছাত্রকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করবে, এই বীভৎসতা আমরা আগে কখনো পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র আন্দোলন তো দূরের কথা, গণতান্ত্রিক যে কোন আন্দোলনে দেখিনি ।
অকল্পনীয় ঘটনাটি ঘটে গেল আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত গণতান্ত্রিক ছাত্র কর্মী আনিসকে যেভাবে রাজ্যের শাসক নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশ, কেবলমাত্র শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার অপরাধে তিনতলার ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করলো, তাকে ধিক্কার জানানোর ভাষা বোধহয় গোটা অভিধান খুঁজলেও পাওয়া যাবে না ।এখন নারকীয়তার চরম সীমায় এসে আমরা উপনীত হয়েছি । মানুষের যে আন্দোলনের গণতান্ত্রিক অধিকার, রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণ-নিপীড়নের প্রতিবাদে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার সংবিধান প্রদত্ত অধিকার, এই অধিকার থেকে নাগরিক সমাজকে বঞ্চিত করবার জন্য তাদের সুশৃংখল গুন্ডা বাহিনী ,পুলিশ কে লেলিয়ে দিয়ে সরাসরি হত্যায় মেতে উঠবে রাষ্ট্র, এটা আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনা।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আনিস খান


এই রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, তারা বারবার নিজেদের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে দাবি করে থাকেন ,খাতায়-কলমে সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি নানা ধরনের দান-খয়রাতের বর্ণনা দিয়ে, দাক্ষিণ্যের বিবরণ দিয়ে ভোট বৈতরণী পার হতে চান। এই রাজ্যের শাসক শিবিরের প্রধান ব্যক্তিত্ব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিজাব পরিহিত ,মোনাজাতরত ফটোসেশন দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।


সেই’ হাজিবিবি’র চরিত্রে অভিনয় করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কর্ণাটক সরকার যখন হিজাব পড়বার অধিকার থেকে সেই রাজ্যের মুসলমান ছাত্রীদের ,সংবিধান প্রদত্ত অধিকার খর্ব করে, তখন একটি শব্দ ও আমরা মমতার মুখ থেকে শুনতে পাই না। সংখ্যালঘুদের ই টাকায় ,সংখ্যালঘুদের দু-চারটি দান-খয়রাত করলেই কখনো সংখ্যালঘু উন্নয়ন হয় না। বস্তুত ,ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকার শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রদত্ত সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট সরকারি জমিতে ,সংখ্যালঘুদের আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে যে সমস্ত কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন, তারই একটি অংশ হলো কিন্তু আলিয়া মাদ্রাসার আজকের রূপান্তর আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।


এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত শিক্ষাতে আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যাতে শিক্ষিত হয়ে উঠে পেশাজীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ,তার জন্য নানা ধরনের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল ।এই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যে কেবলমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাই পড়াশুনা করেন ,এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই ।এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার জন্য ধর্ম পরিচয় আদৌ বাধ্যতামূলক নয়।

এই রকম একটি প্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠনে দীর্ঘদিন ধরে একটা অরাজকতার পরিবেশ চলছে ।সরকার থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে সমস্ত অর্থ বরাদ্দ হয়েছে সেই অর্থ ঠিকমতো বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে এসে পৌঁছয় না। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পঠন-পাঠন চালানোর জন্য পরিকাঠামো আরও সময় উপযোগী করার জন্য যে আর্থিক বনিয়াদ দরকার ,সেই বনিয়াদ কে মজবুত করার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার আর্থিক সাহায্য প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে।


স্বাধীনতার আগে অখন্ড বাংলার প্রিমিয়ার হিসেবে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যে জমি নির্দিষ্ট করেছিলেন সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্যে , মহম্মদ সেলিম সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী থাকাকালীন সেই জমিগুলি যাতে সংখ্যালঘু মুসলমান দেল জন্য সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় ,তাদের আধুনিক শিক্ষা ,প্রযুক্তি বিদ্যায় কুশলী হয়ে উঠতে সাহায্য করে ,সেই লক্ষ্যে যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
সেই উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে তিনি সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম কেও অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছিলেন ।সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিগমের সেইসময়ের কাজকর্মগুলো কিন্তু ডঃ মনমোহন সিংয়ের সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী সংসদে অত্যন্ত প্রশংসা করেছিলেন ।সেই পরিকাঠামো বর্তমান রাজ্য সরকার ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। সময়োপযোগী আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষার জন্য আরও বরাদ্দ তো দূরের কথা, প্রাপ্য টাকা ই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পাচ্ছেনা ।শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। ছাত্রদের গবেষণার জন্য আধুনিক ল্যাবরেটরির ক্ষেত্রেও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে ।


এই পরিকাঠামোর উন্নয়নের দাবিতে প্রণয়নের দাবিতে ,আর্থিক বঞ্চনার প্রতিবাদে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোটা রাজ্যের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত মানুষ নানাভাবে আন্দোলন করছেন ।মূলত বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে বামপন্থী ছাত্র কর্মীরা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের টম বি এ এর ছাত্র আনিস খানের বাড়িতে ঢুকে, সিভিক পুলিশদের দ্বারা তাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে ।ঘটনাটির রাজনৈতিক গুরুত্ব আমাদের পর্যালোচনা করা দরকার। আনিস রাজ্যের শাসক দলের সমর্থক নয়। বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট ,দুজনেরই সঙ্গে তার সখ্যতার সম্পর্ক ছিল।গত বিধানসভা নির্বাচনে আনিস ,বাম-আই এসএ ফের যে নির্বাচনী সমঝোতার ছিল ,তার পক্ষেই প্রচারকার্য অংশগ্রহণ করেছিল সক্রিয়ভাবে। নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতিতে আই এস এফের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা দিন দিন বাড়ছিল। আবার বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ও তার একটা ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল।
মূলত কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসকের বিরুদ্ধে যুব সম্প্রদায়ের এক উজ্জ্বল মুখ হিসেবে স্থানীয় অঞ্চলের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল আনিসের।সংখ্যালঘু সমাজের উন্নয়নে রাজ্যের শাসক যে ধরনের সংকীর্ণ রাজনীতি করে ,তার প্রতিবাদে মানুষকে সঠিক রাজনৈতিক দিশা দেওয়ার ক্ষেত্রে ,ভাঙ্গড় সন্নিহিত অঞ্চলে আনিসের ভূমিকা ক্রমশ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছিল ।সংখ্যালঘু সমাজ যে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে সমন্বয়বাদী, চিরকালীন ভারতের ভাব প্রবাহের মধ্যে একটা সংঘাতের বাতাবরণে ভুগছে ,এই কথাটাও সংখ্যালঘু সমাজের সবাইকে বোঝানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছিল আনিস।


সংখ্যালঘু সমাজকে কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসক ,নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে ,এ কথা সংখ্যালঘু সমাজকে বোঝানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলছিল আনিস। তাই কি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে আরিফের উপর নামিয়ে আনা হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস? অভিযোগ উঠেছে দুই জন সিভিক ভলেন্টিয়ার আনিসের বাড়িতে গিয়েছিল ।তাদের গোটা প্রক্রিয়া টি সম্পাদন করার জন্য একজন পুলিশ অফিসার নাকি আনিসের বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছিল।এই অভিযোগ ও উঠেছে, হত্যাকাণ্ডটি সম্পাদন করে আনিসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ,দুই সিভিক ভলান্টিয়ার নাকি উপস্থিত পুলিশ অফিসারকে ,ঠিক মত হয়ে গেছে — এই বার্তাও দেয়।


প্রশ্ন হল ,কার নির্দেশে আনিসের বাড়িতে বিনা ওয়ারেন্টে পুলিশ গিয়েছিল? পুলিশের পোশাক পড়ে শাসকদলের কেউ এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে ? গোটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর প্রায় ২৪ ঘন্টা অতিক্রান্ত। এখনো পর্যন্ত রাজ্যের সংখ্যালঘু দরদী বলে নিজেকে দাবী করা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য আমরা শুনতে পাওয়া যায় নি।