প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার ।বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী শাহরিয়ার কবীর বলবেন এবং তাঁর তৈরি করা  সুফি সম্পর্কে একটি ফিল্ম সেটি দেখানো হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী উদ্বোধনী সংগীত গাইলেন। ‘ ‘ ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী’,  দেখেই গাইছিলেন তাঁরা গানগুলি। তবু ভুল করছিলেন। প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে উঠলেন বাংলাদেশ উপ দূতাবাসের উপ কমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস পার্থ  অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে, অথচ বিনয়ী বাচনভঙ্গিতে তিনি বললেন;  সুচিত্রা মিত্রের প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার রবীন্দ্রনাথের গান মুখস্ত ছিল।  যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে মানানসই সেই সব গানগুলি তিনি কোনো রকম বই খাতা না দেখেই পরিবেশন করতেন।  

 

         উপ-হাইকমিশনার পার্থ  সম্ভবত ব্যক্তি সুচিত্রাকে খুব বেশি কাছ থেকে জানবার সুযোগ পাননি বয়স জনিত কারণে। তা সত্ত্বেও সুচিত্রাকে ঘিরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুত্রের এই অনবদ্য মূল্যায়নের ভেতর দিয়েই বুঝতে পারা গেল, কিভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সুচিত্রা মিত্র তাঁর রবীন্দ্র বোধ কে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। অর্থনীতির ছাত্র পার্থ। স্বদেশ বাংলাদেশকে, তাঁর পিতৃপুরুষের এক অপূর্ব বিশ্ব মানব হওয়ার’ হাউসে’  ( এই শব্দটি উচ্চারণ করা হল   পার্থে পিতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মাস্টারপিস’ খোয়াবনামা’ থেকে শব্দ ধার করে। এটি পার্থের  পিতৃভূমি বগুড়া অঞ্চলের খুব প্রচলিত একটু লব্জ) সেই গুরুসদয় দত্তের ,’  বিশ্ব মানব হবি যদি, শাশ্বত বাঙালি হ’  এই লব্জকে যেন মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছে। আর তখনই মনে হয়েছিল ,আজকে রবীন্দ্রনাথের গানের নামে ‘fusion’  ‘উল্লাহ উল্লাহ’  জুড়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের ষষ্ঠী পুজো করার পাশাপাশি কোথায় বেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে, মৃত্যুর এতকাল পরেও মৃত্যুহীন প্রাণ হিসেবে বাঙালি জীবনের  সর্বান্তরীন সত্ত্বায় চির ভাস্বর  হয়ে রয়েছেন সুচিত্রা মিত্র।সুচিত্রা নিজে কপিরাইট উঠে যাওয়ার কালে গুরুদেবের গানের বিকতি ঘিরে বলেছিলেন, ‘ তেমন হলে , তোদের নিয়ে এই বয়সে আমি পথে নামব।’ ।                 

তাঁর সামনে কোন গান যদি গীতবিতান খুলে গাইবার চেষ্টা করা যেত উনি অত্যন্ত রেগে যেতেন। কেন সেই গানটিকে আত্মস্থ করে তার মর্ম কে হৃদয় ধারণ করে  স্মৃতিতে তাকে ধারণ করে  গাইছি না– এটা হয়ে উঠতো সুচিত্রার রাগ বিরক্তি এবং ক্ষোভের কারণ।               

আসলে সুচিত্রা ছিলেন সর্বতোভাবে একজন ভনিতা বিহীন মানুষ ।সেলিব্রেটি বলে কোন রকম ভনিতার  আবরণে নিজেকে আবৃত করে রেখে ,মানুষের কাছে তিনি যা নন ,সেই রকম ভাবে নিজেকে ‘ভালো ‘ প্রতিপন্ন করতে হবে এই পাঠশালার ছাত্রী কিন্তু সুচিত্রা মিত্র কোনদিন ছিলেন না ।তাই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন পর শান্তিনিকেতনে গিয়ে সংগীত ভবনের ছাত্রী হয়ে যখন তিনি একদিকে লুকিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকার’ নিউ এজ’  বিক্রি করছেন ,তখনই কিন্তু কলকাতা মহানগরীর বুকে কমিউনিস্ট পার্টি করবার তথাকথিত ‘অপরাধে’ তাঁর পিঠে পুলিশের লাঠির দাগ আছে।              

এই যে পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করেছিলেন সুচিত্রা ,সেই আত্মস্থতার ভাব থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কখনো বিচ্যুত হননি। সেই কারণেই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি যখন নেহরুর সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্র ঘিরে উচ্ছ্বাসে গদগদ,  হীরেন মুখোপাধ্যায় লিখছেন , ‘ জেন্টল কলোসাস’,  নেহরু ঘিরে  উচ্ছ্বাসে নাকের জলে চোখের জলে হচ্ছেন, এমন সময় কন্যা ইন্দিরা পরামর্শে ‘গণতন্ত্রের পূজারী’  নেহরু কেরালায় ই এম এস নামুদ্রিপাদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট মন্ত্রিসভা ভাঙবার  ঠিক পরের দিনই কলকাতা সফরে এলেন  আর তখন রেডিওতে লাইভ ব্রডকাস্টিং এর একটা সুযোগ ছিল। ঘটনাচক্রে সেদিনই অনুষ্ঠান ছিল সুচিত্রার। তিনি গাইলেন ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ র একটি পংক্তি ;” কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন ,ভাগের বেলায় আসেন আগে দাদা !এত বড় আস্পর্দা তোদের ,মোরে নিয়ে একি  হাসি তামাশা !এখনই মুন্ড করিব খন্ড, খবরদার যে খবরদার !”             

এই গান প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কত্তাব্যক্তিদের ধারণা হল যে, নেহরুকে ব্যঙ্গ করেই সুচিত্রা রেডিওতে এই সমস্ত গেয়েছেন। আর যায় কোথায়!  সঙ্গে সঙ্গে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন রেডিওতে সুচিত্রা মিত্র।               

এই যে সাহস, এই যে সংগ্রামী মানসিকতা ,রবীন্দ্রনাথের গানে দেশ কালের সীমা অস্বীকার করে সুচিত্রার মত মেরুদন্ড সম্পন্ন শিল্পী হিশেবে  আর মাত্র একজনের নাম উচ্চারিত হয় রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে , তিনি হলেন ভারত -বাংলাদেশ,  দুটি দেশের স্বাধীনতার মহান যোদ্ধা ,আত্ম নিবেদিত বামপন্থী কর্মী কলিম শরাফি।               

সুচিত্রা কখনো তাঁর ভালোলাগা, মন্দলাগাকে অস্পষ্টভাবে, তার ভাষায়,’ আদো আদো’  করে উচ্চারণ করতেন না। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে এক প্রখ্যাত তথা কিংবদন্তি তুল্য, সুচিত্রারই সমসাময়িক শিল্পীর কথা মনোজ মুরলী নায়ার  দক্ষিণী সম্মান  পেয়েছেন। সম্মানটি নিতে কলকাতায় আসার আগে শান্তিনিকেতনে সেই কিংবদন্তি শিল্পীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। কিংবদন্তি শিল্পী উচ্ছাস প্রকাশ করলেন ।তাঁর এক গৃহপোষ্য  তাঁবেদার  আরো  উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন মনোজের পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে। কিন্তু মনোজের প্রস্থানের পরই সেই গৃহপোষ্য  তাঁবেদারটি শিল্পী কে বললেন;  ও যাচ্ছে যাক। পুরস্কার কিন্তু ওর পাওয়া হবে না। কারণ,  দক্ষিণী র  নিয়ম হচ্ছে ; কোনো ক্যাসেট প্রকাশিত হয়ে গেলে, সেই শিল্পী আর পুরস্কার পান না। মনোজের ক্যাসেট প্রকাশিত হয়ে গেছে। সুতরাং সে আর পুরস্কার পাবে না।                       

কিংবদন্তি শিল্পী প্রায় তাঁর নাতির বয়সী মনোজের আসন্ন হেনস্থা নিয়ে মিটমিটে মজা করলেন,  কিন্তু একটি বাইরের জন্য সন্তান প্রতিম মনোজকে সতর্ক করে দিলেন না ।এই যে চরিত্রের দ্বৈততা,  এই জিনিসটি কিন্তু কখনো সুচিত্রা মিত্রের মধ্যে ছিল না। আপাত  বিনয়ের আবরণে নিজেকে আবৃত রেখে, একটি অভিনয় পটু, পরশ্রীকাতর কোন মানসিকতাকে তিনি নিজের মনে কখনো , কোনোভাবে পোষন করেননি ।                   

সুচিত্রার সমসাময়িক যুগে এভাবে সত্যি কথাকে, সেটি রাজনৈতিক হোক ,সামাজিক হোক, সাংস্কৃতিক হোক– যে কোন অঙ্গনের ই বিষয় হোক, পরিষ্কার মুখের উপর বলবার মতো সাহস সুচিত্রা ভিন্ন অন্য কোনো শিল্পীর ভারতে ছিল কিনা তা সন্দেহের বিষয়। ব্যক্তি সুচিত্রাকে আমরা যারা কাছ থেকে দেখেছি, একরকম ভাবে দেখেছি ।যাঁরা কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পাননি, তাঁরা তাঁর আপাত গাম্ভীর্যকে দেখে অনেক সময়, অনেক রকম স্বপোষিত ধারণা তৈরি করে নিয়েছেন ।’দেশ’  পত্রিকার মতো বহুল প্রচলিত, প্রচারিত পত্রিকা তাঁকে একটা সময় ‘বাগান বিলাসিনী বোগেনভিলা’,  বলে উপহাস করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। কিন্তু সেই সুচিত্রাই মানুষ হিসেবে বাইরের আবরণের ভেতরে কতখানি সংবেদনশীল ছিলেন, কতখানি মানবতা বোধসম্পন্ন ছিলেন, তা যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পাননি ,তাঁরা ছাড়া খুব বেশি মানুষ বোধ হয় জানেন না।                 

সুচিত্রা জীবনসঙ্গী ধ্রুব মিত্র কে ঘিরে সুচিত্রার জীবন ছিল যন্ত্রণাময়। তাঁর সার্বিক শিল্পী সত্তার বিকাশ যেন রুদ্ধ হয়ে যেতে বসেছিল ধ্রুব মিত্র র যাপন চিত্রের দৌলতে। ধ্রুবের  সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সুচিত্রার এক এবং একক লড়াই ,সেটা তাঁর ব্যক্তি সত্ত্বা, শিল্পী সত্ত্বা, সর্বোপরি মানব সত্ত্বার এক অনুপম দৃষ্টান্ত। যে ধ্রুব মিত্রের জন্য একটা সময় ব্যক্তি সুচিত্রার জীবনটা তছনছ হয়ে গিয়েছিল ,সেই ধ্রুব মিত্রই শেষ জীবনে যখন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, চিকিৎসার তেমন সামর্থ্য নেই, আড়াল থেকে  ব্যয়বহুল চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা কিন্তু সুচিত্রা বহন করেছিলেন। এ কাজ তিনি করেছিলেন কিন্তু অত্যন্ত সংগোপনে। কোনরকম প্রচারের বিভীষিকায় নিজেকে বিভীষিত না করে।                

এটাই ছিলেন সুচিত্রা। এটাই তাঁর জীবনগহীনে লুকিয়ে সার্বিক মানবসত্তার অনুপম বিন্যাস ।এই সুচিত্রাকে চেনা জানার সুযোগ খুব বেশি মানুষের হয়নি। না হওয়ার কারণ হয়তো সুচিত্রা নিজেই ।কারণ তাকে ঘিরে ব্যক্তি প্রচার এটাকে কার্যত ঘেন্না করতেন।