প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৈচিত্র্যে ভরা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বড়ো বদ্বীপ আমাদের সুন্দরবন। অসংখ্য নদীনালায় বেষ্টিত সম্পদশালী সুন্দরবনে রয়েছে অনেক সমস্যাও। প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক সবদিক থেকেই। তবে বর্তমান নিবন্ধে বিবিধ প্রাকৃতিক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত সুন্দরবনের মানুষের জীবিকার সমস্যা ও সেই সমস্যা সমাধানে সম্ভাবনার দিকটি নিয়ে আলোচনা করাই লক্ষ্য।

         সুন্দরবনের মানুষের অধিকাংশের জীবিকা কৃষিকাজ। এখানে মোট কৃষিজমির পরিমাণ ৩ লক্ষ হেক্টর। এর মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ জমি সেচ সেবিত। বাদবাকি জমির প্রায় সবটাতেই মৌসুমি বৃষ্টি নির্ভর খরিফ চাষ হয়। ডাল, তৈলবীজ ইত্যাদি রবি চাষ হয় সামান্য কিছু জমিতে। এটুকু ছাড়া বোরো ধান এখন সুন্দরবনের দ্বিতীয় প্রধান ফসল। সুন্দরবনের কৃষি অর্থনীতির মূল স্তম্ভ খরিফ ধানের চাষ। যা সম্পূর্ণভাবে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। বিগত কয়েক বছর যাবত মৌসুমি   বৃষ্টির আসা-যাওয়ার অনিয়ম ও খামখেয়ালীপনায় যেমন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিজনিত কারণে কৃষি ব্যবস্থাটাই সংকটে। বীজতলা তৈরি, ধানের চারা রোপণে বিপুল সমস্যা। নিম্নচাপজনিত অসময়ের বৃষ্টিতে রবিচাষও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার উত্তরোত্তর অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অল্প সেচে গম চাষের এলাকাও ক্রমশ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। মার খাচ্ছে সূর্যমুখী চাষও।

          বিগত ২০০৯ সালে আয়লার দুর্যোগের পরে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ কৃষি জমিতে লোনা জল ঢুকে পড়ে। এই লোনা জল দীর্ঘদিন কৃষি জমিতে আটকে থাকায় চাষের জমি, ফলের বাগান, মিষ্টি জলের পুকুর ও জলাধারগুলির চরিত্র ভীষণভাবে বদলে যায়। রবিচাষ বন্ধ হয়ে যায়। খরিফ মরশুমে কয়েক বছর অধিক ফলনশীল ধানের চাষ করা যায় নি।

         সমুদ্র সন্নিহিত দ্বীপগুলিতে ভূমিক্ষয় ও ক্রমাগত নদীবাঁধ ভাঙনের ফলে কৃষিজমি ও বসতি এলাকা নদী ও সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিবছর সুন্দরবনের মোট কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। গৃহহীন, জীবিকাহীন পরিবারগুলি পরিবেশ শরণার্থীতে পরিণত হচ্ছে।

        লবণাক্ত জমির জন্য লবণ সহনশীল ধানের বীজ তৈরি ও সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। এছাড়া বিভিন্ন মরশুমে চাষের জন্য তাপমাত্রা নিরপেক্ষ (Thermo-insensitive), সূর্যালোক নিরপেক্ষ (Photo-insensitive), খরা সহনশীল এবং স্বল্পমেয়াদী ফসলের প্রজাতি উদ্ভাবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

         সুন্দরবনের মতো বিশেষ প্রাকৃতিক এবং কৃষি জলবায়ু অঞ্চলের জন্য ভূমি উন্নয়ন ও জল সংরক্ষণ প্রকল্প (Land shaping and water harvesting project) খুবই আদর্শ হিসাবে গৃহীত। এর আরো সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

              এছাড়া পরিবর্তিত জলবায়ুতে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে ও লাভজনক প্রতিদান দিতে পারে এমন ফসল, প্রাণী ও মাছের প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে। সেই সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সময় ও মেয়াদের ভিত্তিতে ঠিক করতে হবে ‘ফসল চক্র’। যাতে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কারণে কোনো একটি ফসল আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্যান্য ফসলে কিছুটা আয় হতে পারে।

           সুন্দরবনের অতীব ভঙ্গুর কৃষিব্যবস্থা সত্ত্বেও প্রধান ফসল ধান ও অর্থকরি ফসল পান, সবজি ইত্যাদির জন্য ফসল বীমা সামগ্রিকভাবে কার্যকর হয় নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকায় বীমা কোম্পানিগুলি সুন্দরবনে শস্যবীমা করার ক্ষেত্রে অনাগ্রহী।ফলে এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকেই সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

          সুন্দরবনে কৃষিতে বিনিয়োগের অভাব একটা বড়ো সমস্যা। উৎপাদনের অনিশ্চয়তার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি চাষে বা কৃষি পরিকাঠামো উন্নয়নে ও নির্মাণে ঋণদানে আগ্রহ দেখায় না।

        সরকারি সংস্থাগুলি ভর্তুকি নির্ভর ও অনুদান ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়ায় স্থায়ী সম্পদ তৈরি হবার ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে।

         সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ও সুন্দরবনের প্রাকৃতিক অবস্থার উপযোগী পরিকাঠামো নির্মাণে অধিকতর বিনিয়োগ এবং পরিপূরক হিসাবে শস্যবীমার সংস্থান করতে হবে।

               ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বাড়তি বিনিয়োগের সাহায্যে যে ফসল উৎপাদন করে সেগুলির  যথাযথ সংরক্ষণ ও বিপণনের কোনো সুসংহত ব্যবস্থা এখনও সুন্দরবনে গড়ে ওঠে নি। বিপণনের প্রায় সমস্তটাই মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়ে-দালাল নির্ভর। তাই চাষি উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষত সবজির মতো বাণিজ্যিক ফসল চাষে বিনিয়োগ বেশি হলেও সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রিত বিপণনের অভাবে কৃষক অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হয়। ধানের ক্ষেত্রেও এই অভাবী বিক্রির সমস্যা প্রকট। সরকার নির্দ্ধারিত সংগ্রহ মূল্য যাই হোক না কেন ৬০০-৭০০ টাকা ধানের বস্তা এখন প্রতি বছরের দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই ভঙ্গুর কৃষি অর্থনীতির মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।

          কৃষিকাজের পর সুন্দরবনবাসীর দ্বিতীয় জীবিকা মৎস্য চাষ। সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্র্যই সামগ্রিকভাবে এখানকার বাস্তুতন্ত্র বা Ecological Balance রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বৈচিত্র্যগত বৈশিষ্ট্যর কারণে এখানে লোনা জলে ও মাটিতে ৫০টির বেশি ব্যাকটেরিয়া জীবাণু, ২০০-র বেশি অণুছত্রাক ও ২০টির বেশি অণুশৈবালের উপস্থিতির কথা জানা গেছে। লতা-পাতা-ফল-মূল, ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু ও অণুছত্রাকের পচন ও বিয়োজনের ফলে তৈরি হয় শর্করা ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য। তার সাথে জৈব নাইট্রোজেন, ফসফেট ও জৈব কার্বন মিশে অণুপ্রাণী জন্মাতে সাহায্য করে। এদের টানেই ছুটে আসে চিংড়ির পোনা ও অসংখ্য ছোটো ছোটো মাছ। এখানে পুষ্ট ও বড়ো হয়ে ফিরে যায় সাগরের জলে। এইজন্যই সুন্দরবন হল বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক আঁতুড় ঘর। কিন্তু প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণে এবং  বাণিজ্যিক স্বার্থ ও মুনাফার লালসায় মৎস্য চাষের মতো জীবিকাও আজ ভঙ্গুর। এক্ষেত্রেও নেই সরকারি রক্ষাকবচ ও ব্যবস্থাপনা।

           জল জঙ্গলের অন্যান্য পেশা যথা মধু সংগ্রহ, জঙ্গলের কাঠ সংগ্রহে যুক্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। জঙ্গলে কাঠ কাটা গত ৩০-৩৫ বছর ধরে নিষিদ্ধ। আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মউলেরা মধু সংগ্রহ করে আনার পরে ফরেস্ট অফিসাররা জোরপূর্বক কম দামে তাদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে টেন্ডার ডেকে বা অকশনে বিক্রি করছেন মধু কোম্পানিগুলিকে।

         এইভাবে বিগত কয়েক বছর ধরে জীবিকার রাস্তা না পেয়ে সুন্দরবনের অসংখ্য যুবক কাজের সন্ধানে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিন রাজ্যে বা দেশে চলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী এখানকার ৮ লক্ষ মানুষ এখন পরিযায়ী শ্রমিক।

           যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস সাধনের কারণে সুন্দরবনের মানুষ পরিবেশ শরণার্থী ও জীবিকাহীন হয়ে পড়ছেন বা পরিযায়ী শ্রমিকের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন, তাকে প্রতিরোধ করতে পারে সুন্দরবনের বিশেষ উদ্ভিদ ম্যানগ্রোভ অরণ্যের নানা প্রজাতি। যার মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি আজ লুপ্ত। ম্যানগ্রোভ উপকূলবর্তী অঞ্চলের জলের গুণমান বজায় রাখে। সাইক্লোন বা সুনামির সময়ে উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঢেউয়ের ধাক্কাকে প্রতিহত করে। ম্যানগ্রোভ অনেক বেশি হারে বাষ্পমোচনের মাধ্যমে বাতাসে একটা সুউচ্চ বাষ্পের দেয়াল তৈরি করে। তাতেই বাধাপ্রাপ্ত হয় শক্তিশালী ঝড়। ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছ তার শক্ত শেকড় দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় ভূমিক্ষয় রোধ করে।অথচ গত চল্লিশ বছরে প্রশাসনের অবহেলা ও মানুষের চেতনার অভাবে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আয়তন অর্ধেক হয়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে ৬৭ শতাংশ ম্যানগ্রোভ। সাম্প্রতিক সময়ে বাসন্তীর ঝড়খালী, গরাণ বোস, গোসাবার হ্যামিল্টন আবাদ, রাঙাবেলিয়া অঞ্চলে নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ সহ নানারকম গাছগাছালি কাটা হয়েছে। ম্যানগ্রোভ প্রাকৃতিক নিয়মেই জন্মায়। ঘন জঙ্গল থেকে জোয়ারের জলে বীজ ভেসে আসে ও ভাটায় কাদায় আটকে গিয়ে চারা জন্মায়। মাছ ধরার নৌকা ও মীন ধরার সময়ে বাদাবনে জাল টানলে ম্যানগ্রোভ চারা নষ্ট হয়। এছাড়া ছাগলের প্রিয় খাদ্য হিসাবেও ম্যানগ্রোভ চারা নষ্ট হয়।

              মীন ধরার চল আগে ছিল না। মুনাফার লোভে ক্ষমতাবান লোকেরা ভেড়ি তৈরি করে লোনা জল ঢুকিয়ে মাছ চাষ শুরু করায় চাষের জমি নষ্ট হচ্ছে। ভেড়ির মীন সাপ্লাইয়ের কাজে কর্মসংস্থানের নামে চলছে নির্লজ্জ শ্রমশোষণ। একই সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে ম্যানগ্রোভ।

        ম্যানগ্রোভ রক্ষার সাথে কর্মসংস্থানকে যুক্ত করা যায়। মানুষের জীবন-জীবিকাকে যুক্ত করে ম্যানগ্রোভ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। ম্যানগ্রোভের বীজ সংগ্রহ ও বপনেও মানুষকে যুক্ত করতে হবে। ম্যানগ্রোভের একরকম প্রজাতি কেওড়া গাছ। কেওড়া ফল সুস্বাদু টক। তার থেকে আচার, চাটনি তৈরি করে বিপণন করা যায়। ম্যানগ্রোভ অরণ্যে মৌচাক তৈরি করে মধু উৎপাদন ও বিপণনের ব্যবস্থা করা যায়।

একনজরে সুন্দরবনের মানুষের কর্মসংস্থানের পথনির্দেশ :

১) ভূমিক্ষয় রোধে ব্যবস্থা ও কৃষিজমি, বাগান ইত্যাদিকে রক্ষা করে কৃষিকাজের উন্নতি ঘটানো।

২) ভূমি উন্নয়ন করা (Land shaping)

৩) লবণাক্ত জল ও আবহাওয়ার উপযুক্ত শস্যবীজ উদ্ভাবন।

৪) তাপ ও সূর্যালোক নিরপেক্ষ, খরা সহনশীল স্বল্পমেয়াদী ফসলের চাষের বীজ উদ্ভাবন।

৫) ফসল চক্র ঠিক করা।

৬) শস্যবীমা ও শস্য বিপণনে সরকারি ব্যবস্থাপনা।

৭) Water harvesting অর্থাৎ জল সংরক্ষণ করে সেচ সম্প্রসারণ ও মিষ্টি জলের মৎস্য চাষ।

৮) কৃষিতে বিনিয়োগ ও পরিকাঠামো উন্নয়নে সহজ শর্তে ঋণদান।

৯) মধু, মাছ ও ফসল বিপণনে সরকারি উদ্যোগ।

১০) ম্যানগ্রোভ বীজ সরবরাহ, রোপণ ও চারা সংরক্ষণে মানুষকে যুক্ত করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান।

১১) সুন্দরবনকে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা। অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র রিসর্ট নির্মাণ বন্ধ করা। পর্যটন শিল্পে সহায়ক হিসাবে স্থানীয় বেকার যুবকদের প্রশিক্ষিত করে নিযুক্ত করতে হবে।

১২) এর জন্য চাই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি। সড়ক ও রেল পরিবহনের সম্প্রসারণ ও উন্নতি।

১৩) যত্রতত্র ভেড়ি ও ইটভাটি নির্মাণ বন্ধ করে একাংশের ক্ষমতাবানের মুনাফা শিকার রোধ করতে হবে।

         প্রসারিত ও উন্নত জনচেতনা এবং প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও উদ্যোগেই সম্ভব সুন্দরবনের মানুষের জীবিকার সমস্যাকে সমাধানের পথে চালিত করা।