যেখানেই শ্রমিক সেখানেই লাল ঝান্ডা চা বাগান তার একটা অন্যতম উদাহরণ ছিলো।চা বাগানের শ্রমিক দীর্ঘ ৩৪বছর লালঝান্ডা কেই বরাবর জিতিয়ে এনেছে আর এই লাল ঝান্ডা সেই চা শ্রমিকদের জন্য বরাবরই আন্দোলন করেছে, সরকার কোন রাজনৈতিক দলের রয়েছে সেটা বড় কথা নয় কিন্তু শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার জন্য লালঝান্ডা নিজের দলের তৈরী সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে চা বাগানে আন্দোলন সংগঠিত করেছে। একটা সময় ছিলো চাবাগানের শ্রমিকের চাওয়া পাওয়া নিয়ে সব সময় লাল ঝান্ডা চা বাগানের মালিকের নিকট আদায় যোগ্য দাবি পেস করে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ন্যায্য পাওনা আদায় করেনিত ।চা বাগানের শ্রমিক সময় মতো বেতন, রেশন, স্বাস্থ্যের পরিষেবা, বাড়িতে রান্নার জ্বালানি অনুসারে লাকড়ি পেতো, শ্রমিক তার কাজের সরঞ্জাম হিসেবে যাবতীয় যা যা প্রয়োজন হতো সমস্ত কিছু পেতো, ঠান্ডার দিনে কম্বল পেতো বর্ষার সময় ছাতা পেতো এবং পায়ে পড়ার চপ্পল জুতাও পেতো। পুজোর সময় ভালো শতাংশের বোনাস পেতো যা পরিবারের সকলের জন্য নতুন বস্ত্রের যোগান মেটাতো, অনেকেই আবার সেই বোনাসের টাকা দিয়ে নিজের দেনাও মিটিয়ে থাকতেন। এই সময়ে চা শ্রমিকরা আনন্দিত হয়ে চা বাগানে কাজ করতেন তাদের  অভাব বলতে তেমন কিছু ছিলো না ,এবং তেমন কিছু চাহিদাও ছিলো না, তাদের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করার জন্য সরকারি স্কুল ছিলো কোথাও কোথাও চা বাগান কর্তৃপক্ষ নিজেই স্কুল খুলে রেখেছিলো শ্রমিকের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করানোর জন্য এবং সেই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন চা বাগানের শিক্ষিতরাই। সেই সময় চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের ছেলে মেয়েরা সরকারের ওয়েলফেয়ার কোটার মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা সুযোগ পেতো, সেই সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে অনেক ছেলে মেয়েরা আজকের দিনে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চাকুরী করছে। কিন্তু আজকের দিনে চা বাগান কেবল মাত্র শ্রমিকদের জন্য শ্রম দিয়ে হাজিরা নেয়ার জায়গাতেই পরিণত হয়েছে। নেই কোনো সুযোগ সুবিধা ,শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা বেতন টুকু পেতে সময় লেগে যায়, বেতনের নির্ধারিত দিন পেরিয়ে যায় কিন্তু শ্রমিক বেতন পায় না। মালিক শুধু শ্রমিকের কাজের টাস্ক টাই বুঝে নেয় কিন্তু শ্রমিকের প্রতি মালিকের যা দায়িত্ব কর্তব্য তা কখনোই পালন করে না।অনেক চা বাগানে মালিক শ্রমিকের বেতন থেকে PF এর টাকা কেটে রাখে কিন্তু সঠিক ভাবে জমা করে না। অনেক শ্রমিক অবসর নিয়েছেন কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের PF, গ্রাজুটির টাকা পাননি।চা বাগানের শ্রমিক আজকের দিনে কেবল বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।লালঝান্ডার সরকারের সময় চা বাগানের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির চুক্তি তিন তিন বছরে হতো কিন্তু বর্তমান তৃণমুল সরকারের সময় সেটা নেই। দীর্ঘ দিন বেতন বৃদ্ধির চুক্তিকে বন্ধ রেখে একবারে 232 টাকা হাজিরা করেছে এই তৃণমুল সরকার কিন্তু লালঝান্ডার সরকারের সময় যে হিসেবে হাজিরার চুক্তি হতো সেটা যদি ধরে এগোনো হয় তবে আজকের দিনের চা শ্রমিকদের বেতন 300 টাকা ছুঁয়ে যেতো।আজকের দিনের তৃণমুল সরকার চা বাগানে শ্রমিকদের পক্ষে না থেকে মালিকদের পক্ষ হয়ে ওকালতি করছে এটা শ্রমিকদের জন্য দুর্ভাগ্য জনক। চা বাগানে লাল ঝান্ডা কে দুর্বল করতে অনেকটা দায়ী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ও আদিবাসী বিকাশ পরিষদ নামের দুই সংগঠন। নতুন রাজ্যে গোর্খাল্যান্ড এর দাবি কে সামনে রেখে  গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা বিগত 2007 সাল থেকে তরাই ডুয়ার্সের মধ্যে জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তোলে ফলে এই আন্দোলনের প্রভাব পরে বিভিন্ন চা বাগান গুলোতে যেখানে নেপালি ভাষাভাষী মানুষ বসবাস। গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি নেপালি ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে এমন ভাবে প্রভাব বিস্তার করে যে তারা রাজ্যে লাল ঝান্ডার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।কাতারে কাতারে নেপালি ভাষা ভাষী মানুষ এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। তাদের ভাবনা গোর্খাল্যান্ড রাজ্য হলেই তাদের উন্নয়ন হবে ,জীবন যাত্রার মান ভালো হবে তারা আর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অধীনে থাকতে চায় না। সেই সময় বিভিন্ন জায়গাতে লাল ঝান্ডার কর্মী সমর্থকদের উপর আক্রমণ নেম আসে, বিভিন্ন চা বাগানের কারখানার গেটে যেখানে শ্রমিক সংগঠনের লাল ঝান্ডা উড়তো সেখান থেকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার কর্মীরা লাল ঝান্ডা কে নামিয়ে বাইকের পেছনে রশি দিয়ে  বেঁধে ঝুলিয়েদেয় মাটিতে গড়িয়ে  শ্রমিক মহল্লায় ঘুরে জনগণের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। প্রাণের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি সেদিন। ঠিক সেই সময় গোর্খা জন মুক্তি মোর্চার আন্দোলনকে প্রতিবাদ জানিয়ে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ নামের সামাজিক সংগঠন সক্রিয় হয় ,তাদের দাবি থাকে তরাই ডুয়ার্সকে ষষ্ঠ অনুসূচী তে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, গোর্খাল্যান্ড এর মধ্যে তরাই ডুয়ার্সের একটুকরো জমি দেয়া যাবেনা। বিভিন্ন জায়গাতে উভয় সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে আগুন জ্বলে, তরাই ডুয়ার্স লাগাতার এই আন্দোলনের জেরে বন্ধ থাকতে দেখা যায়। এই আন্দোলনকে আরো সক্রিয় করতে তৃণমুল ও বিজেপি গোপন ভাবে সম্পূর্ণ মদত দিতে থাকে লাল ঝান্ডার সরকারকে দুর্বল করার লক্ষে। এই আন্দোলনের জেরেই বিভিন্ন চা বাগানের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার  ও আদিবাসী বিকাশ পরিষদের শ্রমিক সংগঠন তৈরি হয়। তরাই ডুয়ার্সের চা বাগানের মধ্যে পুরোটাই আদিবাসি ও নেপালি ভাষা ভাষীর শ্রমিক ফলে তারা মনে করে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ও আদিবাসী বিকাশ পরিষদ শ্রমিক সংগঠন তাদের নিজেদের সংগঠন এই সংগঠন তাদের চাওয়া পাওয়া নিয়ে নিশ্চই আন্দোলন করে এবং আদায় করে নিয়ে আসবে। কিন্তু  2011 সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরে যখন রাজ্যে লাল ঝান্ডা দুর্বল হয় তখন এই দুই সংগঠন তৃণমুল ও বিজেপি পকেটে চলে যায় । বিজেপি ও তৃণমুল তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইচ্ছা মতো এই সংগঠনকে ব্যাবহার করে থাকে। এই অবস্থার মোকা নিয়ে চা বাগানের মালিকরা চা শ্রমিকদের দেনা পাওনা নিয়ে গড়িমসি করতে শুরু করে। শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে অনেক বিভাজন থাকার ফলে শ্রমিকরা জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে না । রাজ্যে তখন তৃণমুল সরকারে চা বাগানের মালিক তখন নিজের ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে নেয় । সরকারের দোহায় দিয়ে শ্রমিকের উপর চলে নির্মম অত্যাচার। সময় মতো বেতন নেই, শ্রমিক তখন চা বাগান ছেড়ে ভিন্ন রাজ্যে যাচ্ছে কাজের উদ্যেশে। যখন চা বাগানে আন্দোলন হচ্ছে বেতনের দাবিতে মালিক তখন বিনা নোটিশ দিয়ে বাগান বন্ধ করে চলে যাচ্ছে। লাল ঝান্ডা দুর্বল তাদের কথা শুনছে না মালিক পক্ষ। শ্রমিকদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই লাল ঝান্ডার নেতৃত্বে চা বাগানের বিভিন্ন দলের শ্রমিকসংগঠন কে নিয়ে তৈরি হয় 2014 সালে জয়েন্টফোরাম। এই জয়েন্ট ফোরামে সমস্ত শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি থাকলেও থাকতো না রাজ্যের তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের  প্রতিনিধি। বর্তমান সময়ে বহুবার এই জয়েন্ট ফোরাম চা শ্রমিকের  মিনিমাম ওয়েজ ও চা শ্রমিকদের বাসস্থানের পাট্টার জন্য দাবি করেছে কিন্তু বর্তমান সরকার উদাসীন। ত্রিপাক্ষিক বৈঠক বসলেও সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ এই তৃণমূল সরকার। সংবাদ মাধ্যমে অনেক সময় দেখা যায় কোথাও কোথাও রাজ্য সরকার চা বাগানের শ্রমিকদের পাট্টা দিচ্ছে তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় পাট্টাতে সেখানে কোন জমি চিহ্নিত করণ নেই।  ফলে চা শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বর্তমানে রাজ্য সরকার চা শ্রমিকদের জন্য 18 টাকা মজুরি বৃদ্ধি ঘোষণা করলেও মালিক পক্ষ তা দিচ্ছে না। মালিক পক্ষ বৃদ্ধি মজুরি না দিতে হয় তার জন্য আদালতে যাচ্ছে, আসলে রাজ্য সরকার আর মালিক পক্ষের মধ্যে  ভালোই সমঝোতা রয়েছে সরকারই মালিক পক্ষ কে আদালতে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে আর চা শ্রমিকদের সাথে চক্রান্ত করছে। চা শ্রমিকরা ধীরে ধীরে সরকারের দ্বিচারিতা বুঝতে পারছে তারাও আজ সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলা শুরু করেছে। বর্তমান সময়ে শ্রমিক মহল্লায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে আগের দিনগুলোয় ভালো ছিলো লাল ঝান্ডাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই তো আজ চা শ্রমিকরা শপথ নিচ্ছে জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমিককে একত্রিত করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং  বাগানের মালিক আর তাদের দালাল এই রাজ্য সরকারকে মোক্ষম জবাব দিতে হবে আর আমাদের অর্জিত অধিকারকে পুনঃ উদ্ধার করতে হবে।